Advertisement
E-Paper

স্লোগান দিয়ে ছাত্রদের বিচার করা চলে না

ছাত্রদের মনের কথাটা বুঝতে চাইলে তাঁদের কথা শুনতে হবে ধৈর্য ধরে। অবশ্য এই উত্তাল পরিস্থিতিকে কাজে লাগিয়ে আর কোনও উদ্দেশ্য সাধন করতে চাইলে অন্য কথা। সৌমিত্র বসুযাদবপুরে ছাত্রদের আন্দোলনের শুরুটা হয়েছিল যৌন হয়রানি প্রতিরোধে নির্মিত অভ্যন্তরীণ অভিযোগ অনুসন্ধান কমিটির দুই সদস্যকে সরানোর দাবিতে। শেষ দাঁড়িয়েছে উপাচার্য, সহ-উপাচার্য, রেজিস্ট্রারের পদত্যাগের দাবিতে। দিন সাতেকের মধ্যে কেন এখানে এল ব্যাপারটা?

শেষ আপডেট: ২২ সেপ্টেম্বর ২০১৪ ০০:০০

যাদবপুরে ছাত্রদের আন্দোলনের শুরুটা হয়েছিল যৌন হয়রানি প্রতিরোধে নির্মিত অভ্যন্তরীণ অভিযোগ অনুসন্ধান কমিটির দুই সদস্যকে সরানোর দাবিতে। শেষ দাঁড়িয়েছে উপাচার্য, সহ-উপাচার্য, রেজিস্ট্রারের পদত্যাগের দাবিতে। দিন সাতেকের মধ্যে কেন এখানে এল ব্যাপারটা?

একটা কারণ অস্বচ্ছতা। ইতিহাস বিভাগের এক ছাত্রী শ্লীলতাহানির যে অভিযোগ করেছেন তিন ছাত্রের বিরুদ্ধে, তার তদন্ত ঠিক মতো হচ্ছে কি না, এই ছিল গোড়ার প্রশ্ন। ছাত্রদের দাবি ছিল, ওই কমিটি সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশ মেনে গড়া হয়নি। কমিটিতে বিশ্ববিদ্যালয়ের বাইরের সদস্য নেই। যে সদস্যরা আছেন, তাঁদের উপর ওই ছাত্রী ভরসা রাখতে পারছেন না। প্রমাণ, তিনি পুলিশে অভিযোগ করেছেন কমিটির দুই সদস্যের নামে, তার কপি ছাত্রদের কাছে আছে। বিশাখা নির্দেশিকা মেনে ওই দুই সদস্যকে বদলানো উচিত। এ বিষয়ে কর্তৃপক্ষের কাছে জানা গিয়েছিল, ছাত্রদের ধারণা ভুল। কমিটিতে বাইরের সদস্য রয়েছে। কমিটি বদলানো যাবে না, কারণ ছাত্রীটি যে তদন্তে খুশি নন, তা তিনি বিশ্ববিদ্যালয়কে জানাননি।

কিন্তু বাইরের সদস্য কারা? কমিটি তৈরির নিয়ম কী, কেন তা লঙ্ঘিত হওয়ার অভিযোগ ভুল, তা ছাত্রদের বোঝাবে কে? ওই ছাত্রী অসন্তুষ্ট কি না, তা-ই বা জানবে কে? শোনা গিয়েছে, ওই ছাত্রী নাকি তাঁর আইনজীবীকে সঙ্গে নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে এসে কর্তৃপক্ষের সঙ্গে দেখা করতে চেয়েছিলেন, কিন্তু আইনজীবী আনার নিয়ম নেই, এই বলে বিশ্ববিদ্যালয় তাঁকে প্রত্যাখ্যান করেছে। এ বিষয়ে ছাত্রদের মনে ধোঁয়াশা আছে। তাঁরা বলছেন, যদি তেমন নিয়ম থেকেই থাকে, মেয়েটিকে ডেকে আলাদা করে কি কথা বলা যেত না? তিনি বাস্তবিকই তদন্তে অখুশি কি না, কেন অখুশি, তা কি বিশ্ববিদ্যালয়ের জানার দরকার ছিল না?

ছাত্রদের তরফেও তথ্যে ঘাটতি লক্ষ করা যাচ্ছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের অভ্যন্তরীণ অনুসন্ধান কমিটি তৈরির নিয়ম বাস্তবিক লঙ্ঘিত হয়েছে কি না, কমিটিতে বাইরের সদস্য কেউ আছেন কি না, সে বিষয়ে তাঁরা খুব স্পষ্ট নন। পুলিশে ছাত্রীর দায়ের করা অভিযোগের কপিও তাঁরা বিশ্ববিদ্যালয়কে দিতে পারেননি। তথ্য না থাকা, না দেওয়া, না পাওয়া, এই পরিস্থিতির একটা বড় কারণ।

কমিটির তদন্তে গাফিলতির যে অভিযোগ উঠেছে, তা কতটা ধোপে টেকে, তা বোঝা যেত যদি মুখোমুখি আলোচনা হত। তা কেন করা গেল না, সেই প্রশ্নটা বড় হয়ে উঠছে। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় ন’বছর আগে কাউন্সেলিং সেন্টার খোলা হয়েছিল। বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক অধ্যাপক তার সঙ্গে যুক্ত। ব্যক্তিগত সমস্যা থেকে সহপাঠী বা শিক্ষকদের সঙ্গে সমস্যা, সব কিছু নিয়েই সেখানে কথা হয়। ছাত্রছাত্রীরা প্রতিবাদ করলে তাঁদের সঙ্গে কথা বলে সমঝোতায় পৌঁছনোর ঘটনা আগেও ঘটেছে। ছাত্রদের সঙ্গে কথা বলে সহমত তৈরির দক্ষতা যাঁদের রয়েছে, দেখা গেল তাঁদের এ ব্যাপারে তেমন ভাবে কাজে লাগানো হল না। কথা বলা, কথা শোনা, কথা বোঝা আর বোঝানোর প্রক্রিয়াটা যেন শুরুই হল না, এমনটাই মনে করছে ছাত্রছাত্রীদের একাংশ। কার কোন কথাটা যুক্তিসঙ্গত, কোনটা নয়, তা দু’তরফের কাছেই স্পষ্ট হওয়ার সুযোগ মিলল না। এই অস্পষ্টতার মধ্যে, যা ছিল ছাত্রদের ন্যায় পাওয়ার তাগিদ, তার সঙ্গে কিছু অযৌক্তিক দাবিও যুক্ত হয়ে গেল।

এখনকার পরিস্থিতি থেকে দুটো দিকে ঘুরতে পারে যাদবপুর-কাণ্ড। একটি সম্ভাবনা হল, কর্তৃপক্ষ এবং রাজ্য সরকার অনমনীয় অবস্থান নিতে পারেন। দার্জিলিঙের আন্দোলন যে ভাবে আদালত ‘বেআইনি’ বলে রায় দিয়েছিল, এবং সেই রায় কঠোর ভাবে প্রয়োগ করেছিল সরকার, এ ক্ষেত্রেও তা হতে পারে। সে ক্ষেত্রে যে কেউ আন্দোলন করলে গ্রেফতার করা হতে পারে। অধ্যাপক, ছাত্ররা অনুপস্থিত থাকলে শাস্তি দেওয়া হতে পারে। যাঁরা কর্তৃপক্ষের সমালোচনা করবেন, তাঁদের বিশেষ ভাবে চিহ্নিত করে ব্যবস্থা নেওয়া হবে, এমন ইঙ্গিত ইতিমধ্যেই মিলেছে। মোট কথা, একটা ভয়ের বাতাবরণ তৈরি করে সকলকে নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা হতে পারে।

দুই, ফের আলোচনার রাস্তা নেওয়া যেতে পারে। ছাত্রেরা কিন্তু তার দরজা বন্ধ করে দিয়েছেন, এমন কোনও ইঙ্গিত গোড়া থেকে এখনও অবধি মেলেনি। পাঁচ দিন তাঁরা অবস্থান করেছেন ন্যায়বিচারের দাবিতে, দোষীর শাস্তির দাবিতে। যাকে কোনও মতেই অযৌক্তিক দাবি বলা চলে না। শুক্রবার সহ-উপাচার্য এবং রেজিস্ট্রারকে দফতরে ঢোকার পথে আটকালেও, আলোচনার পর বাধা তুলেও নেন। শনিবারও রাজ্যপালকে তাঁদের দাবি জানানোর পর তাঁর সিদ্ধান্ত জানার জন্য অপেক্ষা করেছেন তাঁরা। ফলে যদি এই পরিস্থিতির সমাধান করাই প্রধান লক্ষ্য হয়, তা হলে কথার মাধ্যমে তা করার পথ বন্ধ হয়নি। সে ক্ষেত্রে ছাত্রছাত্রীদের প্রতি শ্রদ্ধা, সহনশীলতা ও সহমর্মিতার মনোভাব থাকা একান্ত আবশ্যক। প্রাকশর্তও বলা চলে।

ছাত্রদের ভালবাসা মানেই কিন্তু শ্রদ্ধা করা নয়। তাঁদের কথা শোনার ইচ্ছা, ধৈর্য থাকতে হবে। আন্দোলনের উত্তাপে তাঁরা যে স্লোগান তুলছেন, তাকেই বড় করে ধরে নিলে ভুল হবে। তাঁদের মনের কথা বোঝার ইচ্ছেটা জাগিয়ে রেখে, তাঁদের কথা শুনতে হবে ধৈর্য ধরে। শনিবার রাজ্যপাল যে ভাবে দেড় ঘণ্টা সময় দিলেন, তা সেই ধৈর্যেরই পরিচয় দেয়। এটা কিন্তু যে কোনও আলোচনার জন্যই খুব জরুরি।

তবে এই উত্তাল পরিস্থিতিকে কাজে লাগিয়ে আর কোনও উদ্দেশ্য সাধন করতে চাইলে অন্য কথা।

যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে দর্শনের শিক্ষক। সম্প্রতি বিশ্ববিদ্যালয়ের একজিকিউটিভ কাউন্সিলের সদস্যপদে ইস্তফাপত্র পেশ করেছেন।

post editorial soumitra basu
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy