রাজ্যসভার একটি সপ্তাহ কার্যত নিষ্ফল কাটিয়া গেল। দিনের পর দিন সভা অচল করিয়া রাখা হইল। কয়েক দিন বিমা বিল লইয়া বিরোধীদের আপত্তি হট্টগোল ও চিত্কার, তাহার পর যুক্ত হইয়াছে বিজেপির খাদ্য প্রক্রিয়াকরণ মন্ত্রী সাধ্বী নিরঞ্জন জ্যোতির একটি অশালীন মন্তব্যের প্রতিবাদে সভার কাজ পণ্ড করার প্রয়াস। ‘সাধ্বী’র মন্তব্য অবশ্যই অত্যন্ত কুরুচিকর এবং আপত্তিকর। কিন্তু তিনি তাঁহার মন্তব্যের জন্য দুঃখপ্রকাশ করিয়াছেন। দেশবাসীর কাছে এবং সাংসদদের কাছেও ক্ষমা প্রার্থনা করিয়াছেন। শুধু তাহাই নহে, প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী ওই মন্তব্যের জন্য নূতন মন্ত্রীকে ভর্ত্সনা করিয়াছেন। এমনকী সভায় দাঁড়াইয়া সভাসদদের কাছে সনির্বন্ধ অনুরোধ জানাইয়াছেন, সাধ্বী নবীন, অনভিজ্ঞ মন্ত্রী, তাঁহার আপত্তিকর মন্তব্যের জন্য সভা তাঁহাকে এ বারের মতো ক্ষমা করিয়া দিক। ইহা প্রকারান্তরে তাঁহার মন্ত্রিসভার সদস্যের হইয়া প্রধানমন্ত্রীর নিজেরই ক্ষমাপ্রার্থনা। ইহার পরেও তাঁহার পদত্যাগের দাবি নৈতিক বিচারে সমর্থনযোগ্য হইতে পারে, সংসদে ‘ভর্ত্সনা’ প্রস্তাবের দাবিও অহেতুক নহে। কিন্তু তাহার জন্য সভার কাজ বন্ধ করিতে হইবে কেন?
রাজ্যসভায় বিজেপির নেতৃত্বাধীন এনডিএ সরকারের গরিষ্ঠতা নাই। যে কোনও বিল এই সভায় পাশ করাইতে হইলে তাই বিরোধী দলগুলির সহযোগিতা অপরিহার্য। দেশের উন্নয়ন ও বিকাশ এবং অর্থনীতির সংস্কারের জন্য প্রয়োজনীয় বেশ কয়েকটি বিল সংসদের চলতি শীতকালীন অধিবেশনে পাশ করানো দরকার। কিন্তু যে ভাবে বিরোধী দলগুলি সভার কাজকর্মে ক্রমাগত বিঘ্ন সৃষ্টি করিয়া চলিয়াছে, তাহাতে শেষ পর্যন্ত কয়টি জরুরি বিল অনুমোদিত হইবে বলা কঠিন। সরকারের গরিষ্ঠতা নাই জানিয়াই বিরোধী দলের সাংসদরা যে রাজ্যসভায় এমন অচলাবস্থা সৃষ্টি করিতেছেন, তাহাতে সংশয় নাই। অসহযোগিতা ও বিক্ষোভের সামনের সারিতে যে-তৃণমূল কংগ্রেসকে দেখা যাইতেছে, সংসদে উপস্থিত তাহার এক সাংসদের বিরুদ্ধেও তো পশ্চিমবঙ্গে বিরোধী দলের মহিলাদের ‘ছেলে পাঠাইয়া ধর্ষণ করাইবার’ প্রকাশ্য হুমকি দেওয়ার অভিযোগ আছে। নিজ দলনেত্রীর কাছে ক্ষমাপ্রার্থনার চিঠি পাঠাইলেও তিনি তো সংসদে তাঁহার ওই মন্তব্যের জন্য ক্ষমাও চাহেন নাই। এখন সেই সাংসদও দিব্য মুখে কালো কাপড় বাঁধিয়া বিক্ষোভ দেখাইতেছেন!
সরকারের কর্মসূচিকে নানা ভাবে বাধা দেওয়ার লক্ষ্য সিদ্ধ করিতেই এ ভাবে সংসদ অচল করার অপপ্রয়াস। তবে এ জন্য বর্তমান শাসক দল বিজেপিও সম্পূর্ণ দায় এড়াইতে পারে না। বিগত কয়েক দশক ধরিয়াই সংসদের কাজকর্ম কার্যত এ ভাবেই চলিয়াছে। ঘন-ঘন সভা মুলতুবি, ওয়াক-আউট, হই-হট্টগোলে সরকার পক্ষকে কথা বলিতে না দিবার চেষ্টাই এখন গণতন্ত্রের অনুশীলন। বিরোধী পক্ষে থাকা-কালে বিজেপিও ইউপিএ সরকারের বিভিন্ন বিলের বিরোধিতায় এ ভাবেই সভা ভণ্ডুল করিত। যে-সব বিলে কংগ্রেস ও বিজেপি সহমত, সেখানেও খুঁটিনাটি বিভিন্ন পদ্ধতিগত ত্রুটির কথা তুলিয়া বিলগুলিকে ক্রমাগত সিলেক্ট কমিটিতে পাঠানো, তাহার পর সভায় সে-বিল পেশ হইলেও তাহার প্রতিবাদ করা, এ ভাবেই বিজেপি বিরোধী দলের কর্তব্য সমাধা করিয়াছে। আজ শাসকের ভূমিকায় বিজেপির দিকে সেই সকল ইষ্টকখণ্ডের পাল্টা পাটকেল ফিরিয়া আসিতেছে। অসহযোগিতার এই প্রতিযোগিতা যে শেষ বিচারে দেশের ক্ষতি করিতেছে, সংসদের অধিবেশন যে ক্রমেই তামাশা বা সার্কাসের মতো নিষ্ফল বিনোদনে পরিণত হইতেছে, সে বিষয়ে কাহারও মাথাব্যথা নাই। সভা ভণ্ডুল করাই এখন জনপ্রতিনিধিত্বের সার হইয়া দাঁড়াইয়াছে। ইহা ভারতীয় গণতন্ত্রের পক্ষে কেবল লজ্জার নহে, গভীর উদ্বেগরও কারণ।