ইতিহাস আপনাকে পুনরাবৃত্ত করে না, তবে যদি কখনও বা করেও, তবে প্রথম ক্ষেত্রে যাহা বিয়োগান্ত ঘটনা হইয়া ওঠে, দ্বিতীয় ক্ষেত্রে তাহাই প্রহসনে পরিণত হয়। জনতা পার্টির বিভিন্ন সাবেক শরিকের তরফে গত শতাব্দীর সত্তরের দশকের ‘জনতা’ পরীক্ষাটিকে পুনরুজ্জীবিত করার প্রয়াস দেখিয়া কার্ল মার্ক্সের কথাটি মনে পড়িতে পারে। মুলায়ম সিংহ যাদব, লালুপ্রসাদ যাদব, নীতীশ কুমার, শরদ যাদব ও এইচ ডি দেবগৌড়া সম্প্রতি সেই পুনরুজ্জীবনের উদ্যোগ শুরু করিয়াছেন। লক্ষ্য: বিজেপি’র অভিযান প্রতিহত করা। তাঁহাদের নেতৃত্বাধীন আঞ্চলিক দলগুলি গত লোকসভা নির্বাচনে বিজেপির হাতে পর্যুদস্ত হয়। হয়তো তাঁহাদের ধারণা, ভোট-বিভাজন ঠেকাইয়া ঐক্যবদ্ধ লড়াই দিতে পারিলে বিপর্যয়ের পুনরাবৃত্তি রোধ করা সম্ভব। অপ্রাসঙ্গিক হইয়া পড়ার গ্লানি ঘুচাইয়া জাতীয় রাজনীতির কেন্দ্রে পুনঃস্থাপিত হওয়ার আকাঙ্ক্ষাও থাকা সম্ভব। নির্বাচনী গণতন্ত্রে সেই বাসনা পূরণের সম্ভবপরতাও উড়াইয়া দিবার নয়।
কিন্তু সম্ভবপরতা এবং সম্ভাব্যতা এক নহে। জনতা পার্টির উত্থানের পর্বটি ছিল ইন্দিরা গাঁধীর নেতৃত্বাধীন জরুরি অবস্থার রাজনৈতিক স্বৈরতন্ত্রের বিরুদ্ধে বিভিন্ন সমাজতন্ত্রী, দক্ষিণপন্থী গণতন্ত্রী ও আঞ্চলিক বা প্রাদেশিক শক্তির জোটবন্ধনের পর্ব। সে-দিনের ‘জনতা’ আন্দোলনের নেতৃত্ব দিয়াছিলেন জয়প্রকাশ নারায়ণ। সঙ্গে ছিলেন রামমনোহর লোহিয়া ও কর্পূরী ঠাকুরের ভাবশিষ্যরা। সেই সূত্রেই লালুপ্রসাদ, নীতীশ কুমার, মুলায়ম সিংহদের মঞ্চালোকে উঠিয়া আসা। পরবর্তী কালে মণ্ডল কমিশনের সংরক্ষণ রাজনীতির সুবাদে এই প্রাদেশিক মনসবদাররা বিভিন্ন অনগ্রসর জাতের নিজস্ব সংগঠনের নেতা হইয়া ওঠেন। কিন্তু জনতা পার্টির বৃহত্তম শরিক সে দিন ছিল ভারতীয় জনসংঘ তথা বিজেপি, আজ যাহার বিরুদ্ধে জোট গড়িতেই সাতাত্তরের পরীক্ষামূলক পুনরুজ্জীবনের প্রয়াস। সে-দিনের সেই নিরীক্ষা তিন বৎসরও স্থায়ী হয় নাই, তীব্র অভ্যন্তরীণ শরিকি দ্বন্দ্বে জোট ছত্রভঙ্গ হইয়া যায়, যাহার মূলে ছিল নেতৃবহুল ওই জোটের প্রতিটি নেতার উচ্চাভিলাষ, প্রত্যেকেই ছিলেন প্রধানমন্ত্রিত্বের দাবিদার। আজ যে পুনরুজ্জীবিত জনতা পার্টির ছায়া ক্রমে স্পষ্ট হইতেছে, তাহার শরিক নেতারাও কি সকলেই তীব্র উচ্চাকাঙ্ক্ষী নহেন? জনতা পার্টি ক্ষমতাসীন হওয়ার পর যে ব্যাধিতে আক্রান্ত হয়, তাহার পুনরুজ্জীবনের কারিগররা সেই ব্যাধির জীবাণু বহন করিতেছেন।
এই আঞ্চলিক মনসবদারদের পারস্পরিক সম্পর্কও মধুর নয়। সে দিন পর্যন্ত নীতীশ-লালু দ্বন্দ্ব বিহার রাজনীতিকে রক্তাক্ত করিয়াছে। বিজেপির চাপে পরস্পরের কাছাকাছি আসার তাগিদ নিতান্তই সুবিধাবাদী। মুলায়ম সিংহের সহিত লালুপ্রসাদের সম্পর্কও বিশেষ নিবিড় নয়। এই সব কয়টি সাবেক জনতা শরিকের সম্মিলিত শক্তিও অকিঞ্চিৎকর। একান্নবর্তী পরিবার হইলেই দুর্বলতা কাটানো যাইবে, এমন নিশ্চয়তা নাই। বিশেষত বিজেপি যখন এই সব দলেরই গণভিত্তিতে ধস নামাইয়াছে। অনগ্রসর, এমনকী দলিতরাও যে আর বিজেপিকে অচ্ছুত গণ্য করিতেছে না, হিন্দি বলয়ের নির্বাচন তাহার প্রমাণ। উপরন্তু আঞ্চলিক বিভিন্ন দলের জনসমর্থন আকৃষ্ট করার চৌম্বক-শক্তি নরেন্দ্র মোদীর আছে। মহারাষ্ট্রে শিব সেনা এবং হরিয়ানায় চৌটালা অনুগামীদের বিপর্যয় তাহার প্রমাণ। যুযুধান দুই শিবিরের দ্বৈরথ অতএব চলিতেই থাকিবে।