Advertisement
E-Paper

সম্মতির অধিকার মেয়েদের প্রাপ্য নয়?

বার বার গলা ফাটিয়ে বলা দরকার, সম্মতির তোয়াক্কা না করা মানে ধর্ষণ করা। সেটা অচেনা লোক হলেও সত্য, প্রেমিক হলেও সত্য, স্বামী হলেও সত্য। বাসে-ট্রামে-বাড়িতে-অফিসে অনেক কিছু মুখ বুজে সহ্য করা মানে সম্মতি দেওয়া নয়। সিপিএমের এ বারের নির্বাচনী ইস্তাহারের ১৭ নম্বর পাতায় একটি বাক্যবন্ধের দিকে চোখ গেল। জমি অধিগ্রহণ সম্পর্কে নিজেদের অবস্থান ব্যাখ্যা করে সেখানে বলা হয়েছে, আগে থেকে সব তথ্য জেনে বুঝে পূর্ণ সম্মতি (ফুল অ্যান্ড প্রায়র ইনফর্মড কনসেন্ট) ছাড়া জমি অধিগ্রহণ সমর্থনযোগ্য নয়।

জাগরী বন্দ্যোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ০৮ এপ্রিল ২০১৪ ০০:১৩

সবচেয়ে আগে জানতেই হবে কাকে বলে সম্মতি
বের্টোল্ট ব্রেশট,
যে বলে হ্যাঁ, যে বলে না

সিপিএমের এ বারের নির্বাচনী ইস্তাহারের ১৭ নম্বর পাতায় একটি বাক্যবন্ধের দিকে চোখ গেল। জমি অধিগ্রহণ সম্পর্কে নিজেদের অবস্থান ব্যাখ্যা করে সেখানে বলা হয়েছে, আগে থেকে সব তথ্য জেনে বুঝে পূর্ণ সম্মতি (ফুল অ্যান্ড প্রায়র ইনফর্মড কনসেন্ট) ছাড়া জমি অধিগ্রহণ সমর্থনযোগ্য নয়।

প্রস্তাবটির ভালমন্দ বা সিপিএমের অতীত-বর্তমানের নিরিখে এই উচ্চারণের তাৎপর্য কতটা, সে আলোচনায় যাচ্ছি না। মনের মধ্যে গুনগুন করে উঠছে অন্য কয়েকটি প্রশ্ন। কৃষকের ‘সম্মতি’ ছাড়া অধিগ্রহণে সমর্থন নয়, এটুকু বলাই যথেষ্ট মনে করা হয়নি এখানে। কোন সম্মতিকে সম্মতি বলে ধরা হবে, তার জন্য দুখানি মানদণ্ড যোগ করা হয়েছে। আর তার মধ্যে দিয়েই পরোক্ষ ভাবে মেনে নেওয়া হয়েছে, আপাতভাবে যাকে সম্মতির ‘হ্যাঁ’ বলে মনে হচ্ছে, তার ভিতরে অনেকখানি ‘না’ প্রচ্ছন্ন থাকতে পারে। সিঙ্গুরে ইচ্ছুক চাষির সংখ্যা খাতায় কলমে অনেক অনেক বেশি হওয়া সত্ত্বেও অত বড় উন্নয়ন যজ্ঞ আক্ষরিক অর্থেই মাঠে মারা গেল কেন, সেটা বুদ্ধবাবুরা এ বার ভেবে দেখবেন আশা করি।

ভাবনার পথনির্দেশ কিন্তু ওই বাক্যবন্ধেই রয়েছে। পূর্ণ সম্মতি মানে, সম্মতি স্বতঃই পূর্ণ নয়; ছলেবলেকৌশলে আদায় করা সম্মতি তো নয়ই, আবার স্ব-অধীন সম্মতির মধ্যেও থেকে যেতে পারে নানা সংশয় আর দোলাচল। সম্মতির নির্মাণ যখন একটি রাজনৈতিক প্রকল্প, এই বহুমাত্রিকতার কথা মনে রাখাটা সেখানে রাজনৈতিক দায়।

কৃষক চেক নিয়েছেন, অতএব তিনি আগাগোড়া জমি দিতে আন্তরিক ইচ্ছুক ছিলেন এমন না-ই হতে পারে। ভয় আর ভাবনা তাঁর সিদ্ধান্তের নির্ণায়ক হয়ে থাকতে পারে।

অনিচ্ছুক চাষি শেষমেশ চেকের লাইনে দাঁড়ালেন, অতএব তিনি অনিচ্ছা ঝেড়ে ফেলেছেন এমন না-ই হতে পারে। অনটনের জ্বালা তাঁকে বাধ্য করে থাকতে পারে।

অতএব সবচেয়ে আগে জানতেই হবে, কাকে বলে সম্মতি। সম্মতি দেওয়া মানেই সব সময় সম্মত হওয়া নয় সম্মতিকে তাই কষ্টিপাথরে যাচাই করে নেওয়া দরকার। কী ভাবে?

ইস্তাহারে সে কথাও বলা আছে: সম্মতি দেওয়ার আগে সম্মতিদাতা সব দিক জেনেবুঝে সম্মতি দিচ্ছেন কি না, সেটা দেখতে হবে। অর্থাৎ ধরে নেওয়া যেতে পারে, কী উদ্দেশ্যে জমি নেওয়া হচ্ছে, কতটা জমি নেওয়া হচ্ছে, জমির চরিত্র বদল হলে সমাজ-অর্থনীতি-পরিবেশের দিক থেকে কী কী বদল আসতে পারে, ক্ষতিপূরণ ও পুনর্বাসন প্যাকেজ দীর্ঘমেয়াদে যথাযথ কি না, এই সব কিছু তথ্যের অধিকারের মধ্যে পড়ে বলেই সম্মতিদাতাকে নিশ্চিত হতে হবে, জমি দিয়ে তিনি ঠকছেন না, বরং উপকৃত হচ্ছেন। লক্ষণীয়, এই কথাগুলো সম্মতির সঙ্গে পৃথক মাপকাঠি হিসেবে জুড়তে হচ্ছে। মানে, প্রকারান্তরে মেনে নেওয়া হচ্ছে, এ দেশে না-জেনে, আধখানা জেনে, ভুল জেনে সম্মতি দিয়ে ফেলা বা দিতে বাধ্য হওয়ার রেওয়াজ আছে। ইস্তাহার বলছে, কৃষক সব দিক জেনেবুঝে সর্বতোভাবে ‘হ্যাঁ’ না বললে অধিগ্রহণে সমর্থন নয়। অর্থাৎ, সব দিক জেনেবুঝে সর্বতোভাবে ‘হ্যাঁ’ না বললে তা সম্মতি বলে গ্রাহ্য নয়। জমি আন্দোলনের সুবাদেই সম্মতি শব্দটা একটা নতুন রাজনৈতিক মাত্রা পেল। আধিপত্যের নির্মাণ থেকে মুক্ত হয়ে অধিকার বুঝে নেওয়ার দাবি হয়ে উঠল।

সম্মতির বহুমাত্রিকতাকে চিহ্নিত করা এবং গুরুত্ব দেওয়ার এই দাবি নারী আন্দোলনে দীর্ঘ দিন ধরেই আছে। সম্মতি বা কনসেন্টের প্রশ্নটি লিঙ্গ-সম্পর্কের পরতে পরতে জড়ানো, আর সেখানেই তার পদদলন সবচেয়ে বেশি। যতটা সহজে চাষির জমি দখল করা যায়, ঝুপড়ি-বস্তির উপরে বুলডোজার চালানো যায়, তার চেয়েও বেশি সহজে মেয়েদের উপরে জোর খাটানো যায়। রাস্তার অচেনা লোকই হোক, স্বামী বা প্রেমিক হোক কি জন্মদাতা পিতাই হোক, মেয়েরা সবার কাছেই ধর্ষিত হতে পারে--- কারণ, এদের কারও কাছেই তার সম্মতি-অসম্মতির কোনও মূল্য নেই। ঠিক যে আস্ফালনে গরিব মানুষকে তুইতোকারি করা যায়, ‘ছোটলোকের আবার মুখে মুখে কথা’ বলে তড়পে ওঠা যায়, সেই একই গলাবাজিতে যে কোনও পুরুষ ‘মেয়েছেলেদের সঙ্গে তক্ক করি না’ বলে শ্লাঘা বোধ করে। এই ঘটনাগুলোর অন্তর্লীন সূত্রটি এক: সম্মতি বা অসম্মতি একটি স্বাধীন মত, এবং ক্ষমতার রাজনীতি বিশ্বাস করে স্বাধীন মত বিনিময়, প্রয়োজনে মতান্তরে জড়ানোর খেলাটা শুধু সমানে সমানেই চলতে পারে। এ ক্ষেত্রে উচ্চবর্গের কাছে নিম্নবর্গ যা, পুরুষের কাছে নারীও তাই।

কিন্তু গণতন্ত্রে ভোটের মূল্য সকলের জন্যই এক, এবং সংখ্যা বড় বালাই, তাই নিচুতলার সম্মতি-অসম্মতি নিয়েও এখন ভাবতে হচ্ছে। জমি আন্দোলনকে ঘিরে সম্মতি শব্দটা রাজনীতির লব্জ হয়ে উঠছে। মেয়েদের লড়াইটা অবশ্য আরও অনেক জটিল, বহুস্তরী। মেয়েরা আজও একটি স্বতন্ত্র ভোটব্যাঙ্ক নন। সেই কারণে নিজের সম্মতি আর অসম্মতির অজস্র ধাপগুলো প্রতিটি স্তরে নিজের মতো করে দরকার। বার বার গলা ফাটিয়ে বলা দরকার, আমার সম্মতির তোয়াক্কা না করা মানে আমাকে ধর্ষণ করা। সেটা অচেনা লোক হলেও সত্য, প্রেমিক হলেও সত্য, স্বামী হলেও সত্য। আমি বাসে-ট্রামে-বাড়িতে-অফিসে অনেক কিছু মুখ বুজে সহ্য করি। সহ্য করা মানে সম্মতি দেওয়া নয়। পারিবারিক শান্তি বজায় রাখতে, চাকরি টিকিয়ে রাখতে আমাকে অনেক আপসও করতে হয়। আপস করা আর সম্মত হওয়া এক নয়। নির্বাচনী ইস্তাহার যদি জমিদাতাদের পূর্ণ সম্মতির কথা বলে, আমিও আমার সম্মতির অধিকার চাই। আমিও বলতে চাই, সবচেয়ে আগে জানতেই হবে কাকে বলে সম্মতি।

কাকে বলে, জানি কি সত্যিই? অভিধানে সম্মতি মানে খুঁজতে গিয়ে দেখছি, ‘অনুকূল মত, সমর্থন; অনুমতি, অভিমত’। অনুকূল মত, সমর্থন, অনুমতি... বোঝা গেল। কিন্তু অনুকূল মত আর অভিমত কি এক? সম্মতির মধ্যে কি অনুকূল মত আর অভিমত দু’রকম সম্ভাবনাই স্বতন্ত্র ভাবে রয়ে গিয়েছে? আবার দুটি সম্ভাবনাই যদি স্বতন্ত্র ভাবে রয়ে যায়, তা হলে ক্ষেত্রবিশেষে তাদের মধ্যে দ্বন্দ্বের সম্ভাবনাও অস্বীকার করা চলে না! সম্মতি কি তবে সতত নিজের মধ্যে একটা অন্তর্নিহিত দোলাচল বহন করে চলে? সম্মতি কি তবে একটি প্রক্রিয়া, একটি হয়ে

ওঠার আখ্যান?

বিরিঞ্চিবাবার গল্পে বুঁচকি যখন ‘যাঃ’ বলেছিল, সত্যকে বোঝানো হয়েছিল, ‘দূর গাধা! যাঃ মানেই হ্যাঁ!’ নির্মল কমেডিতে আপাত না মানে হ্যাঁ হতেই পারে। কিন্তু সমাজে সেটাই মর্মান্তিক প্রহসনে পরিণত হয়, যখন ধর্ষক পুরুষ, জমিলোলুপ কর্পোরেট, প্রতারক প্রোমোটার, আজ্ঞাবহ প্রশাসন আর রক্তচক্ষু পার্টি ক্যাডাররাও সমস্বরে বলতে থাকে, ‘না মানেই হ্যাঁ’।

না মানে যে হ্যাঁ নয়, সেটা তো বুঝতে হবেই। হ্যাঁ মানেই যে হ্যাঁ নয়, সেটাও এখন থেকে সমান ভাবে মনে রাখা দরকার।

jagari bandopadhyay
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy