অর্থনীতির স্বাস্থ্যোদ্ধারে বিনিয়োগের ভূমিকা প্রশ্নাতীত। ভারতে বিনিয়োগ অথবা তাহার অভাব লইয়া আলোচনাও কম হয় না। কিন্তু, সেই আলোচনার কেন্দ্রস্থলটি অধিকার করিয়া থাকে রোগের উপসর্গগুলি। সমস্যার মূল কারণ তর্কে ঠাঁই পায় না। বিশ্বব্যাঙ্কের ‘ইজ অব ডুয়িং বিজনেস’ সমীক্ষায় সেই প্রশ্নটিকে একটি দৃষ্টিকোণ হইতে দেখা হয়। ব্যবসার উপযুক্ত পরিবেশের দৃষ্টিকোণ। ওয়ার্ল্ড ইকনমিক ফোরাম-এর গ্লোবাল কম্পিটিটিভনেস ইনডেক্স-কে তাহার সম্পূরক সমীক্ষা বলা চলিতে পারে। ‘কম্পিটিটিভনেস’ বা প্রতিযোগিতার সামর্থ্যে কোন দেশ কোথায় আছে, এই সমীক্ষা তাহা নিরূপণ করে। কোনও দেশের যে প্রতিষ্ঠান, নীতি বা বিষয়গুলি সেই দেশের অর্থনৈতিক উৎপাদনশীলতার স্তর নির্ধারণ করে, সেগুলিই সেই দেশের প্রতিযোগী-সামর্থ্যের ভিত্তি। এই সমীক্ষা সেই ভিত্তিগুলির নিরিখেই বিভিন্ন দেশের ক্রম নির্ধারণ করে। অর্থাৎ, এই সূচকটি কোনও দেশের বাণিজ্যসফল হইয়া উঠিবার প্রস্তুতির সূচক। ভারতে যে বিষয়টি লইয়া আলোচনা অত্যন্ত কম, এই সূচকটি তাহার উপর আলোকপাত করিতেছে।
এই দফার সমীক্ষায় মোট ১৪৪টি দেশ অন্তর্ভুক্ত হইয়াছিল। ভারত তাহার মধ্যে ৭১তম স্থান অধিকার করিয়াছে। এশিয়ায় প্রথম দশটি শক্তির মধ্যে ভারত নাই। ব্রিকস-এর সদস্য দেশগুলির মধ্যেও ভারত সর্বশেষ। কিন্তু, ভারতের এই অবস্থানটিকে বিশ্লেষণ করিলে শুধু যে অন্ধকার পড়িয়া থাকিবে, তাহা নহে। এই সমীক্ষাটি মোট ১২টি বিষয়ের উপর জোর দিয়াছে। বিষয়গুলি তিনটি শ্রেণিতে বিভক্ত। প্রথম, প্রাথমিক শর্ত। তাহার চারটি উপাদান। দেশের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের কুশলতায় গোটা দুনিয়ায় ভারতের স্থান ৭০তম, পরিকাঠামোর ক্ষেত্রে ক্রম ৮৭, অর্থনৈতিক পরিস্থিতিতে ক্রম ১০১ এবং স্বাস্থ্য ও প্রাথমিক শিক্ষায় ৯৮। সব মিলাইয়া, প্রাথমিক শর্তের ক্ষেত্রে দুনিয়ায় ভারতের ক্রম ৯২। দ্বিতীয় শ্রেণি হইল কুশলতাবৃদ্ধির উপাদানসমূহ। এই শ্রেণিতে মোট ছয়টি উপাদান। তাহার মধ্যে, বাজারের আয়তনে ভারত গোটা দুনিয়ায় তৃতীয় স্থানে। আর্থিক বাজারের উন্নয়নের নিরিখে ভারতের স্থান ৫১। কিন্তু, উচ্চশিক্ষা (৯৩তম), পণ্যের বাজারে কুশলতা (৯৫তম), শ্রম বাজারের কুশলতা (১১২তম) এবং প্রযুক্তির (১২১তম) দুরবস্থার দৌলতে এই শ্রেণিতে ভারতের সার্বিক ক্রম দুনিয়ায় ৬১তম। কিন্তু তৃতীয় শ্রেণির দুইটি উপাদান, উদ্ভাবনী শক্তি ও পরিশীলনের ক্ষেত্রে ভারতের অবস্থান ৫৯তম ও ৫৭তম ভারতের অন্য সূচকগুলির তুলনায় যাহা লক্ষণীয় ভাবে উন্নত।
ভারতের সমস্যাটি স্পষ্ট। যে ক্ষেত্রগুলিতে ব্যক্তি-উদ্যোগই মূল, তাহাতে ভারত মন্দ করে নাই। কিন্তু যেখানে রাষ্ট্রের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ, ভারত সেখানেই ধরাশায়ী। শ্রম আইন সংস্কার অথবা প্রযুক্তি বা পরিকাঠামোর উন্নতিসাধনের ন্যায় বিনিয়োগের সহিত প্রত্যক্ষ সম্পর্কযুক্ত ক্ষেত্রে যেমন সরকারি তৎপরতা প্রয়োজন, তেমনই প্রাথমিক শিক্ষা, স্বাস্থ্য বা উচ্চশিক্ষার ন্যায় সামাজিক ক্ষেত্রেও সরকারকে উদ্যোগী হইতে হইবে বাণিজ্যের স্বার্থেই। এই ক্ষেত্রগুলিতে ভারত যে পিছাইয়া আছে, তাহা নূতন তথ্য নহে। কিন্তু, গোটা দুনিয়ার সঙ্গে তুলনা করিলে যে লজ্জাজনক ছবিটি স্পষ্ট হইয়া উঠে, তাহা সরকারকে কাজের প্রেরণা দিতে পারে। সেই প্রেরণায় কাজ হইলে ভাল। নচেৎ, বিনিয়োগের ময়দানে পরাজয়ের লজ্জাই ভারতের ভবিষ্যৎ।