কাঁঠালিকলার বিপদ তাহার সর্বব্যাপ্ত উপস্থিতিতে। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সেই বিপদেই পড়িয়াছেন। তাঁহার জমানায় দল ও সরকারের মধ্যে পার্থক্য নির্ধারণের তর্কটি পাত্রাধার তৈল বনাম তৈলাধার পাত্রের স্তরও অতিক্রম করিয়া গিয়াছে। মুখ্যমন্ত্রী নিজেকে, এবং তাঁহার দল/সরকারকে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় নামক ঘটটির শীর্ষে স্থাপন করিতে গিয়া খামখা হাস্যাস্পদ হইলেন। যৌন হেনস্থার অভিযোগের নিষ্পত্তি করিবার জন্য বিশ্ববিদ্যালয়-গঠিত যে কমিটিকে কেন্দ্র করিয়া এত কাণ্ড, সেই কমিটি পূর্ববৎ আছে। বঙ্গেশ্বরীর নির্দেশে তাঁহার শিক্ষামন্ত্রী আরও একটি কমিটি গড়িয়া দিলেন। একটি স্বশাসিত প্রতিষ্ঠানের অভ্যন্তরীণ বিষয়ের তদন্ত করিতে এই ভাবে কমিটি গঠন করিয়া দেওয়া যে স্বশাসনের নীতির পরিপন্থী ও ঘোর অনৈতিক, কালীঘাট সম্ভবত তাহা জানে না। অতঃপর কোন কমিটি গ্রাহ্য হইবে, কোনটি কাজ করিবে, মুখ্যমন্ত্রী সম্ভবত ভাবিবার সময় পান নাই। তিনি সমস্যার আঁচ পাইয়াই তাহার ‘সমাধান’ করিয়া দিয়াছেন। ছাত্রছাত্রীরা কমিটির নিকট নিরপেক্ষতা দাবি করিয়াছিলেন। সরকারি কমিটিতে যাঁহারা আছেন, তাঁহাদের অনেকেই এযাবৎকাল নিজেদের নিরপেক্ষতার পক্ষে বিশেষ প্রমাণ পেশ করিতে পারেন নাই। বরং, তাঁহাদের পক্ষপাতের প্রমাণ একত্র করিলে এক মহাভারত হইবে। এমন কমিটি গড়িয়া নিজেদের পক্ষপাতিত্বের আরও একটি প্রমাণ জনসমক্ষে পেশ করিয়া লোক হাসাইবার প্রয়োজন বঙ্গেশ্বরীর ছিল না। কিন্তু, ঘট দেখিলে কাঁঠালিকলা কি দূরে থাকিতে পারে?
কমিটি দেখিয়া যদিও বা কেহ মুখ টিপিয়া হাসে, শঙ্কুদেব পণ্ডার ‘গর্জন’-এর অভিঘাত অট্টহাস্যের কমে থামিবে না। আরাবুল ইসলামাদি নেতারা নিজ নিজ ক্ষমতা অনুসারে তৃণমূল কংগ্রেস ছাত্র পরিষদের জবাবি মিছিলে যাঁহাদের জোগাড় করিয়া আনিয়াছিলেন, তাঁহাদের সারল্য অপার। কেহ ‘বহিরাগত উপাচার্যদের’ তাণ্ডবের প্রতিবাদে আসিয়াছেন তো কাহারও তাগিদ অপহৃত উপাচার্যকে উদ্ধার করিয়া আনিবার, কেহ বা পুলিশি অত্যাচারের প্রতিবাদে মুখর হইতে। অধিকাংশই অবশ্য এত কথাও জানেন না। পাল্টা মিছিলের উত্তরাধিকার শঙ্কুদেবরা আলিমুদ্দিন স্ট্রিট হইতে পাইয়াছেন, কিন্তু তাহার যথার্থ আয়োজনের শিক্ষা অর্জন করিবার সময় বা সুযোগ তাঁহাদের হয় নাই। ‘হোক কলরব’-এর পাল্টা ‘হোক গর্জন’-ই তাঁহাদের সৃষ্টিশীলতার মোক্ষম প্রমাণ। কোনও আত্মসম্মানবোধসম্পন্ন শাসক দল এমন মিছিলের আয়োজন করিবে না, মিছিলে যোগদানের জন্য শিক্ষকদের হুমকি এসএমএস-এ পাঠাইবে না। বঙ্গশাসকদের সে বালাই নাই।
তৃণমূল কংগ্রেস নামক দলটি শিক্ষাগত কৌলীন্যে সমৃদ্ধ, এমন দাবি করা কঠিন। যাদবপুরের মেধামণ্ডিত পরিবেশ তাহাদের নাগালের বহু বাহিরে। যাহা অনায়ত্ত, তাহাকে অধিকার না করিতে পারিলে যে তীব্র আক্রোশ জন্মায়, যাদবপুরের প্রতি তৃণমূলের শীর্ষস্তরে তেমন আক্রোশ আছে বলিয়া কেহ অনুমান করিতে পারেন। হয়তো বা সেই কারণেই এই পরিসরটিকে দখল করিতে শাসকরা উদগ্রীব। এবং, সেই দখলদারির চেষ্টায় তাঁহারা আরাবুল-শঙ্কুদেবের অকুলীন পথই বাছিয়াছেন। অবশ্য, অন্য কোনও পথ তাঁহাদের জানাও নাই। কিন্তু, এই পরিসরের আবেগ বা যুক্তি, কোনওটাই শাসকরা ক্ষমতার দম্ভের চশমা চোখে দেখিতে পাইবেন না। তাঁহারা লোক ধরিয়া আনিয়া মিছিল করিতে পারেন, কিন্তু কোন আবেগে প্রবল বৃষ্টিতেও অর্ধলক্ষ মানুষ, কোনও রাজনৈতিক পতাকা ছাড়াই, রাস্তায় হাঁটেন, তাঁহাদের জানা নাই। কাহারও সন্দেহ হইতে পারে, ২০০৭ সালের নন্দীগ্রাম মিছিলের চরিত্রও হয়তো তাঁহারা বুঝিতে পারেন নাই। দলদাস-কেন্দ্রিকতার পরিসরে যাদবপুর আঁটিবে না, এই কথাটি বঙ্গেশ্বরী এখনও টের পান নাই। ক্রমে বুঝিবেন, দ্বিজত্ব নামক ঘটটি তাঁহাদের অধরা।