৩২ হাজার শিক্ষকের সকলেই দুর্নীতির সঙ্গে যুক্ত, তা তদন্তে প্রমাণ করা যায়নি। দুর্নীতির উৎস এখনও প্রমাণিত নয়। কয়েকজন ‘অযোগ্য’ শিক্ষকের জন্য সমস্ত প্রাথমিক শিক্ষকের চাকরি কেড়ে নেওয়া যুক্তিযুক্ত নয়। বুধবার কলকাতা হাই কোর্টের ডিভিশন বেঞ্চ তাই রায় দিয়েছে কর্মরত প্রাথমিক শিক্ষকদের পক্ষেই। আর তার পর ফের মামলার হুঁশিয়ারি দিচ্ছেন বঞ্চিত প্রার্থীরা।
বুধবার ৩২ হাজার প্রাথমিক শিক্ষকের চাকরি বহাল রাখার নির্দেশ আসার পর নতুন করে লড়াইয়ে নামতে চাইছেন বঞ্চিতেরা। ২০১৪ প্রাথমিক এ বঞ্চিত চাকরিপ্রার্থী অর্ণব ঘোষ বলেন, “নিয়োগের ক্ষেত্রে একাধিক অনিয়ম হয়েছিল। সেই তথ্য আমরা তুলে ধরেছিলাম আদালতের কাছে। আদালতের পূর্ণাঙ্গ রায় আমাদের হাতে আসেনি। আমরা এ বিষয় নিয়ে উচ্চতর আদালতে যাব।”
প্রায় একই কথা শুনিয়েছে বঞ্চিত চাকরিপ্রার্থী অচিন্ত্য সামন্ত। তাঁর দাবি, একের পর এক অভিযোগ ছিল। তাঁরা চেয়েছিলেন দুর্নীতির আশ্রয় নিয়ে চাকরি পাওয়া শিক্ষকেরা উপযুক্ত শাস্তি পান। অচিন্ত্য বলেন, “এই রায় আমরা খুশি নই। ভেবেছিলাম ন্যায় বিচার পাব। প্রচুর অভিযোগ ছিল। আমরা ন্যায় বিচারের জন্য উচ্চতর আদালতে যাব।”
এ দিকে কর্মরত প্রাথমিক শিক্ষক শেখ নাসিম আলি এ দিন বলেন, “এটা আমাদের দীর্ঘদিনের লড়াইয়ের জয়। আমরা কোথাও কোনও আন্দোলন করিনি। আমরা ভারতীয় বিচারব্যবস্থার উপর রেখেছিলম। যারা বঞ্চিত তাঁরা ফের সুপ্রিম কোর্টে যেতে পারে। আমরা এখানে যে রকম প্রমাণ করেছি। ওখানেও আমরা জয়লাভ পাব।”
এর আগে ১২ মে ২০২৩ কলকাতা হাই কোর্টের তৎকালীন বিচারপতি অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায়ের সিঙ্গল বেঞ্চ ৩২ হাজার প্রাথমিক শিক্ষকের নিয়োগ বাতিলের নির্দেশ দিয়েছিল। পরে প্রাথমিক শিক্ষা পর্ষদ এই রায়কে চ্যালেঞ্জ করে ডিভিশন বেঞ্চে যায়। সেখানেও সিঙ্গেল বেঞ্চের রায়কে বহাল রাখে। এর পর সরকার, পর্ষদ ও কর্মরত শিক্ষকেরা সুপ্রিম কোর্টের দ্বারস্থ হন। সেখানেই অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায়ের রায়ে স্থগিতাদেশ দেওয়া হয়। এর পরে মামলা ফের ঘুরে আসে কলকাতা হাই কোর্টে বিচারপতি তপব্রত চক্রবর্তী এবং বিচারপতি ঋতব্রতকুমার মিত্রের ডিভিশন বেঞ্চে। গত ১২ নভেম্বর মামলার শুনানি শেষ হয়। সেই মামলারই রায় ঘোষণা হল ৩ ডিসেম্বর।
উল্লেখ্য, টেট পরীক্ষার বিজ্ঞপ্তি প্রকাশিত হয় ৬ মার্চ ২০১৪। প্রায় ১৫ লক্ষ পরীক্ষার্থী আবেদন করেছিলেন। ২০১৫ সালের নভেম্বরে পরীক্ষায় বসেন প্রায় ১৩ লক্ষ পরীক্ষার্থী। সেপ্টেম্বর ২০১৬-য় ফলপ্রকাশের পর দেখা যায় প্রায় ১ লক্ষ ২৪ হাজার প্রার্থী উত্তীর্ণ হয়েছেন। তবে কত নম্বর পেয়ে তাঁরা পাশ করেছেন তার কোনও হিসাব দেওয়া হয়নি। ৪২,৪৪৯ শূন্যপদের জন্য নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ হয় সে সময়ই। অক্টোবর থেকে শুরু হয় ইন্টারভিউ প্রক্রিয়া।
২০১৭ থেকে শুরু হয় নিয়োগ। প্রথমে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ১১০০০ এবং তার পর প্রশিক্ষণহীন প্রায় ৩২০০০ প্রার্থী নিযুক্ত হন প্রাথমিক শিক্ষক হিসাবে।
কিন্তু সেখানেই অভিযোগ ওঠে, নিয়োগের সময় কোনও প্যানেল প্রকাশ হয়নি, এসএমএস-এ নিয়োগ হয়েছে রাতের অন্ধকারে। মামলাকারী বঞ্চিতদের অভিযোগ, কারা চাকরি পেলেন তা কেউ জানতে পারলেন না। শিক্ষা পর্ষদ সেই তালিকা প্রথম প্রকাশ করে করে ২০২২-এর নভেম্বরে। ২০১৪ টেট-এ প্রাপ্ত নম্বর সে-ই প্রথম জানতে পারেন প্রার্থীরা। নিয়োগের মেধাতালিকাও প্রকাশ করা হয়। তার পরেই কলকাতা হাই কোর্টে মামলা করেন প্রিয়াঙ্কা নস্কর, ২০২৩-এর সেপ্টেম্বরে।
কী কী অভিযোগ ছিল?
- নিয়ম মেনে অ্যাপটিটিউড টেস্ট হয়নি।
- এই পরীক্ষার জন্য সুনির্দিষ্ট কোনও নির্দেশিকাই ছিল না।
- প্যানেল প্রকাশ করা হয়নি নিয়ম মেনে।
- তৃতীয় পক্ষ সংস্থা এস বসু রায় অ্যান্ড কোম্পানি-কে দিয়ে প্যানেল তৈরি করা হয়। যা সরকারি অনুমোদনহীন।
- আইন অনুযায়ী সিলেকশন কমিটি গঠন করা হয়নি।
- সংরক্ষণ নীতিও মানা হয়নি ফলপ্রকাশের ক্ষেত্রে।
- কম নম্বরপ্রাপ্ত প্রার্থীও চাকরি পেয়েছেন বা বেশি নম্বরপ্রাপ্ত প্রার্থীর থেকে আগে কাজ পেয়েছেন।