বর্তমানে বিভিন্ন পেশার ক্ষেত্রে জরুরি ইংরেজি ভাষায় কথোপকথন। এর ফলে যাঁরা ইংরেজিতে সড়গড় নন, তাঁদের সুবিধার্থে গড়ে উঠেছে নানা ‘স্পোকেন ইংলিশ’ সংস্থা। কিন্তু সে সব ব্যবস্থা তাঁদের জন্য, যাঁদের সবটাই দৃষ্টিগোচর। দৃষ্টিহীন বা দৃষ্টিপ্রতিবন্ধীরাও তথাকথিত বিদেশি ভাষায় স্বচ্ছন্দ হয়ে বিভিন্ন চাকরিতে যাতে যোগদান করতে পারেন, তার জন্য খুব কমই পদক্ষেপ করা হয়। এ বার সেই ভাবনা থেকেই কৃত্রিম মেধার সাহায্য নিয়ে নয়া উদ্যোগ যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের। এই গবেষণার জন্য মিলেছে কেন্দ্রীয় অনুদানও।
কৃত্রিম মেধা বা আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স (এআই)-কে কাজে লাগিয়ে কী ভাবে দৃষ্টিহীন পড়ুয়াদের ইংরেজি ভাষায় সাবলীল করে তোলা যায়, তা নিয়েই গবেষণা হবে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে। বিশ্ববিদ্যালয়ের এই প্রকল্পের মূল উদ্যোক্তা স্কুল অফ কগ্নিটিভ সায়েন্সের অধ্যাপিকা অমৃতা বসু। তিনি বলেন, “মাতৃভাষা যতটা সহজে শেখা যায়, যে কোনও বিদেশি ভাষা শেখা ততটা সহজ নয়। দৃষ্টিহীনদের ক্ষেত্রে এই পথটা আরও কঠিন। সেই ভাবনা থেকে এই গবেষণার কাজ।”
বর্তমানে ইংরেজিতে ভাষায় সাবলীল হয়ে ওঠার জন্য তাই প্রতিবন্ধকতাহীন মানুষের পাশাপাশি দৃষ্টিহীনদের জন্যও কিছু সংস্থা এগিয়ে এসেছে। তারাও ‘স্পোকেন ইংলিশ’-এর পাঠ দিচ্ছে দৃষ্টিহীন পড়ুয়াদের। তা হলে কোথায় আলাদা এই গবেষণার কাজ? অমৃতা বলেন, “আমরা কৃত্রিম মেধার বিভিন্ন টুলের মাধ্যমে তাঁদের শুধু ‘স্পোকেন ইংলিশ’ শেখাবো, এমনটা নয়। তাঁরা কতটা শিখতে পারছেন, সেই ডেটা সংগ্রহ করে, আরও উন্নত এআই স্পোকেন ইংলিশ টুল বা প্রযুক্তি তৈরি করব।” সঙ্গে যোগ করেন, ‘‘গবেষণার মাধ্যমে আমরা দেখব, এই এআই নির্ভর প্রযুক্তির মাধ্যমে সত্যিই তাঁরা ইংরেজিতে কথা বলায় স্বচ্ছন্দ হচ্ছেন কি না। যদি প্রযুক্তিটি তাঁদের উন্নতিতে কাজে লাগে, তা হলে শুধু বিশ্ববিদ্যালয়ের গণ্ডির মধ্যে আটকে না রেখে বৃহত্তর সমাজের কাছেও তা সহজলভ্য করে তোলার চেষ্টা করা হবে।’’
বিশ্ববিদ্যালয়ের 'রাজারমান্না চেয়ার প্রফেসর' এবং কগনিটিভ সায়েন্স বিভাগে সংশ্লিষ্ট প্রকল্পটির পরামর্শদাতা অনুপম বসু জানান, গবেষণার কাজটি সম্পন্ন হবে বেশ কয়েকটি ধাপে। প্রথমে, তাঁদের ‘স্পোকেন ইংলিশ’ শেখার ক্ষমতার উপর ভিত্তি করে কৃত্রিম মেধা নির্ভর কিছু টুল তৈরি করা হবে। এগুলিকে বলা হচ্ছে ‘মডেলিং টুল’। এর পর তৈরি করা হবে ‘টিউটরিং টুল’। যার মাধ্যমে দৃষ্টিহীন পড়ুয়াদের ইংরেজিতে কথোপকথন শেখানো হবে। এর পর তাঁদের ফিডব্যাক নিয়ে এআই টুলগুলিকে ক্রমাগত উন্নত বা আপগ্রেড করা হবে। গবেষণার কাজটি চলবে তিন বছর ধরে।
অমৃতার কথায়, “যাঁরা দৃষ্টিহীন তাঁদের কাছে পারিপার্শ্বের সমস্ত জিনিস সম্পর্কে একটা আলাদা ধারণা রয়েছে। দৃষ্টিহীনদের মধ্যেও রয়েছে প্রকারভেদ। কেউ জন্মান্ধ, আবার কেউ দুর্ঘটনায় দৃষ্টিশক্তি হারিয়েছেন। এমনকি এঁদের মধ্যেও প্রতি ব্যক্তির আলাদা চিন্তাভাবনা বা বোঝার ক্ষমতা রয়েছে। তাই যে কোনও নতুন ভাষা শেখার ক্ষেত্রেও তাঁদের মধ্যে পার্থক্য দেখা যায়।”
দীপঙ্কর এবং অমৃতা দু’জনেই জানান, উচ্চশিক্ষা ক্ষেত্রে অধিকাংশ পড়ুয়াই উচ্চ মাধ্যমিক উত্তীর্ণ হওয়ার পর বেছে নেন আর্টসের নানা বিষয়। খুব কম সংখ্যক পড়ুয়াই সায়েন্স, ইঞ্জিনিয়ারিং, টেকনোলজি এবং ম্যানেজমেন্টের বিভিন্ন বিষয় নিয়ে পড়ার আগ্রহ প্রকাশ করেন। এর কারণ খুঁজতে গিয়ে জানা গিয়েছে, যে হেতু নির্দিষ্ট কিছু বিষয়ে উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে পড়াশোনার মাধ্যম হিসাবে বাংলা ভাষাকে বেছে নেওয়া যায়, তাই তাঁরা সেই পথে পা বাড়ান। কিন্তু তাঁরা যাতে যে কোনও বিষয় নিয়েই পড়তে পারেন এবং বর্তমান অর্থনীতি বা পেশা জগতে ইংরেজি ভাষার যে অপরিসীম গুরুত্ব রয়েছে, সেখানে তাঁরা যাতে পিছিয়ে না পড়েন, তা ভেবে দেখাও জরুরি।
আরও পড়ুন:
কিন্তু দৃষ্টিহীনেরা কৃত্রিম মেধার মাধ্যমে ইংরেজি শেখার পর কী ভাবে তাঁদের পারদর্শিতার মূল্যায়ন করা হবে? অমৃতা জানান, বিভিন্ন ‘কগ্নিটিভ প্যারামিটার’ খতিয়ে দেখা হবে। তার জন্য মস্তিষ্কের ইলেক্ট্রোএনসেফালোগ্রাম (ইইজি) করে এবং বিভিন্ন খেলা ও প্রশ্নাবলির মাধ্যমে তাঁদের ফিডব্যাক নিয়ে সেই ডেটা বিশ্লেষণ করা হবে। এর মাধ্যমে স্পোকেন ইংলিশ শেখার জন্য ব্যক্তিনির্ভর এআই প্রযুক্তি তৈরি করা সম্ভব হবে।
প্রকল্পের কাজ হবে বিশ্ববিদ্যালয়ের মূল ক্যাম্পাসেই। বিভিন্ন বয়স এবং অঞ্চলের পড়ুয়াদের নিয়ে এই গবেষণার কাজ সম্পন্ন হবে। যেখানে প্রথমে বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়ুয়ারা যেমন অংশগ্রহণ করবে, তেমনি রাজ্যের অন্যান্য সংস্থার সঙ্গেও একযোগে গবেষণার কাজ করা হবে।
উল্লেখ্য, চলতি বছরে দেশের কেন্দ্রীয় শিক্ষা মন্ত্রকের তরফে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে কেন্দ্রীয় অনুদানের জন্য সর্বাধিক দু’টি গবেষণাপত্র চেয়ে পাঠানো হয়। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের তরফেও পাঠানো হয় দু’টি গবেষণাপত্র। যার মধ্যে একটির জন্য হায়ার এডুকেশন ফান্ডিং এজেন্সি (হেফা)-র সিএসআর (কর্পোরেট সোশ্যাল রেসপনসিবিলিটি) অনুদান মেলে বলে জানান বিশ্ববিদ্যালয়ের মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের অধ্যাপক দীপঙ্কর সান্যাল। গত মার্চ মাসেই কেন্দ্রের তরফে সে কথা জানানো হয়। অনুদান হিসাবে বরাদ্দ হয় ৫০ লক্ষ টাকা।