সার্ক সম্মেলনে মোদী। ছবি: এএফপি।
কেউ কারও সঙ্গে কথা বললেন না। এমনকী, একে অন্যের দিকে তাকালেনও না!
নেপালের কাঠমান্ডুতে শুরু হয়েছে ১৮তম সার্ক সম্মেলন। বুধবার আটটি দেশের প্রতিনিধিরা দু’দিনের ওই সম্মেলনে হাজির হয়েছেন। অথচ, উপমহাদেশের দুই রাষ্ট্রনেতা নরেন্দ্র মোদী এবং নওয়াজ শরিফ একে অন্যের সঙ্গে কথা বললেন না, তাকালেনও না। উল্টে, মুম্বইয়ে ২৬/১১-র জঙ্গি হামলার কথা উল্লেখ করে উপমহাদেশে সন্ত্রাসবাদী কার্যকলাপে মদত দেওয়া বন্ধ করতে কড়া বার্তা দিয়েছেন মোদী। বস্তুত, সোমবারই এ দেশের বিদেশ মন্ত্রক জানিয়ে দিয়েছিল, সার্ক সম্মেলনে আলাদা করে পাকিস্তানের সঙ্গে কোনও বৈঠক করবে না ভারত।
দিল্লি থেকে কাঠমান্ডু। ছ’মাস আগের ছবিটাই পাল্টে গেল। সে দিন প্রধানমন্ত্রী মোদীর শপথগ্রহণ অনুষ্ঠানে তাঁকে হাসি মুখে দেখা গিয়েছিল। পরের দিন মোদী-শরিফ দু’জনকেই সৌহার্দ্যপূর্ণ ভঙ্গিমায় দেখেছিল গোটা বিশ্ব। বিগত কয়েক বছরের চেনা ধারণা পাল্টে প্রতিবেশী দুই দেশের দুই রাষ্ট্রনেতার নতুন ছবি ধরা পড়েছিল এ বছরেরই মে মাসে। ভারত-পাক সম্পর্কের শীতলতা কাটাতে সেই দৃশ্য অনেকটা আস্থা গড়তে পেরেছিল উপমহাদেশের কূটনীতিতে। কিন্তু কিছু দিনের মধ্যেই পরিস্থিতি পাল্টে যায়। ভেস্তে যায় দু’দেশের শান্তিপ্রক্রিয়া। সীমান্তে সংঘর্ষবিরতি চুক্তি বার বার লঙ্ঘন করে পাকিস্তানই শান্তির সেই বাতাবরণ ভেঙেছে বলে ভারতীয় বিদেশ মন্ত্রকের দাবি। এর মধ্যে যদিও বিদেশ সচিব পর্যায়ের বৈঠকও বাতিল করেছিল ভারত। গত মে-তে প্রধানমন্ত্রীর শপথগ্রহণ অনুষ্ঠানের পর এই প্রথম মোদী-শরিফের দেখা হওয়ার সম্ভাবনা ছিল। কিন্তু পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে ছবিটা পাল্টে গেল।
ছ’মাস আগের সৌহার্দ্য নয়, বরং মোদী ছ’বছর আগের এক জঙ্গিহানার উল্লেখ করে কার্যত বিঁধেছেন পাকিস্তানকে। ঘটনাচক্রে এ দিনই মুম্বই হামলার ছ’বছর পূর্তি। মোদী বলেন, “মুম্বইয়ের ওই জঙ্গিহানায় নিহতদের জন্য সীমাহীন বেদনা আজও অটুট।” ২০০৮-এর এই দিনেই মুম্বইয়ের বিভিন্ন জায়গায় জঙ্গিহানায় নিহত হয়েছিলেন ১৬৪ জন। ওই জঙ্গি হামলার পিছনে পাকিস্তানের মদত ছিল বলে অভিযোগ। ছ’বছর আগের ওই ঘটনার উল্লেখ করে মোদী সন্ত্রাসবাদীদের মদত দেওয়া বন্ধ করতে পাকিস্তানকে কার্যত বার্তা দিয়েছেন বলে কূটনৈতিক মহলের ধারণা। তিনি বলেন, “যদি আমরা প্রত্যেকে দেশের নিরাপত্তা এবং নাগরিকদের জীবন নিয়ে আরও বেশি স্পর্শকাতর হই, তবে তা পারস্পরিক সহযোগিতায় প্রেরণা জোগাবে।”
সার্ক গোষ্ঠীভুক্ত দেশগুলি তো বটেই, এ বারের সার্ক সম্মেলনে হাজির হয়েছেন পর্যবেক্ষক ন’টি দেশের প্রতিনিধিরাও। অস্ট্রেলিয়া, চিন, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, ইরান, জাপান, কোরিয়া, মরিশাস, মায়ানমার এবং আমেরিকা সার্ক-এর পর্যবেক্ষক দেশ। বাংলাদেশ, নেপাল, ভুটান, পাকিস্তান, মলদ্বীপ, আফগানিস্তান, শ্রীলঙ্কা এবং ভারত এই আট দেশের সমন্বয়ে গঠিত সার্ক-এ চিনের অন্তর্ভুক্তি নিয়ে সম্প্রতি সরব হয়েছে নেপাল। চিন ঢুকে পড়া মানেই, গোটা বিষয়টি তারা নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করবে বলে আশঙ্কা ভারতের। তাই, পরিস্থিতির দিকে কড়া নজর রেখেছে এ দেশের বিদেশ মন্ত্রক।
এ দিন সম্মেলন শুরু করেন নেপালের প্রধানমন্ত্রী সুশীল কৈরালা। তার পরেই ভাষণ দেন পাক প্রধানমন্ত্রী শরিফ। সার্কের উন্নয়নে পর্যবেক্ষক দেশগুলির ভূমিকা যে গুরুত্বপূর্ণ সে কথা সবাইকে মনে করিয়ে দেন তিনি। তিনি বলেন, “প্রতিবেশী দেশের সঙ্গে সহযোগিতার রীতি পাকিস্তান সর্বদাই মেনে চলে। সার্ক-এর অন্তর্ভুক্ত সমস্ত দেশের সঙ্গেই বন্ধুত্বের সম্পর্কে বিশ্বাসী আমরা। পারস্পরিক সম্পর্ক বাড়াতেও আমরা আগ্রহী।” শিক্ষায় জোর দেওয়ার পাশাপাশি তিনি সার্ক গোষ্ঠীভুক্ত দেশগুলির উন্নয়নে ভিসা পদ্ধতির বদল আনার বিষয়ে উদ্যোগী হওয়ার কথা বলেন। আগামী বছর সার্ক সম্মেলন ইসলামাবাদে করার আবেদন জানান তিনি।
মোদী যদিও এ দিন তাঁর বক্তব্যে উপমহাদেশের উন্নয়নকেই অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করেছেন। তাঁর মতে, এই উপমহাদেশকে গোটা বিশ্বের কাছে তুলে ধরতে উন্নয়নই একমাত্র পথ। এই প্রসঙ্গে তিনি বেশ কয়েকটি উপায়ের কথা বলেন। ভারত কী ভাবে গোষ্ঠীভুক্ত দেশগুলির উন্নয়নে কাজ করতে চায়, এ দিন তারও আভাস দিয়েছেন মোদী। ২০১৬-র সার্ক দিবসের আগেই ভারত একটি উপগ্রহ উৎক্ষেপণ করবে বলে জানিয়েছেন তিনি। সেই উপগ্রহের সব রকম সুবিধা পাবে সার্ক গোষ্ঠীভুক্ত দেশগুলি। মুক্ত বাণিজ্যের পাশাপাশি এই দেশগুলির মধ্যে বিদ্যুৎ-সহ অন্যান্য পণ্য আমদানি-রফতানির ক্ষেত্রে আরও জোর দেওয়ার কথা বলেন তিনি। এ বিষয়ে সার্ক গোষ্ঠীভুক্ত দেশগুলির জন্য ৪-৫ বছরের বাণিজ্যিক ভিসা ব্যবস্থা আগামী দিনে আনবে ভারত। সড়কপথে তো বটেই, প্রয়োজন মতো এই দেশগুলির মধ্যে রেলপথে যোগাযোগ তৈরি করার প্রস্তাব দেন মোদী। রেল বা বিমানপথে বাণিজ্য শুরু করলে তাতে আখেরে এই উপমহাদেশেরই লাভ। তিনি এই প্রসঙ্গে আন্তর্দেশীয় বাণিজ্য করিডরের কথা উল্লেখ করেন। তাঁর কথায়: “দেশের উন্নয়নে আমরা পরিকাঠামোকে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিয়েছি। সার্ক-এর ক্ষেত্রেও একই নীতি হওয়া উচিত। কারণ উপমহাদেশের একমাত্র দুর্বলতা এই পরিকাঠামো।” পাশাপাশি, তিনি এ দিন সার্ক গোষ্ঠীভুক্ত দেশগুলির প্রতিনিধিদের জানিয়ে দেন, অসুস্থ ব্যক্তি এবং তাঁর এক জন সহকারীর জন্য বিশেষ চিকিৎসা ভিসার বন্দোবস্তও করছে ভারত সরকার।
মোদী এ দিন সার্ক গোষ্ঠীভুক্ত দেশগুলিতে পর্যটনে উন্নয়নের কথা বলেন। তাঁর কথায়, “আমাদের ঐতিহ্যের যে নিজস্ব শক্তি আছে, তাকে ব্যবহার করতে হবে। বিশ্ববাসীকে তা জানাতে হবে।” অতীতের বুদ্ধ সার্কিটের উল্লেখ করে তিনি বলেন, “ওখানেই থেমে থাকলে আমাদের চলবে না।”
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy