Advertisement
২০ এপ্রিল ২০২৪

মারাকানার বহিষ্কৃত রাজপুত্রের সম্মান-সিংহাসনে সগর্ব প্রত্যাবর্তন

দিনটা ছিল ব্রাজিলের ১৩ জুলাই মধ্য বিকেল। দিনটা দাঁড়াল স্পেনের ৭ মে সন্ধ্যারাত। একটা বিশ্বকাপ ফাইনাল। একটা চ্যাম্পিয়ন্স লিগ সেমি ফাইনাল। ঠাটেবাটে-রণসম্ভারে-ঐশ্বর্যে তুলনাই হয় না। একটা প্রতি বছর হয়। একটা চার বছর পর পর। তবু এ সব তো অঙ্কের হিসেব। হৃদয়ের হিসেবে লিওনেল মেসি মাত্র দশ মাস সময় নিলেন ১-১ করতে! মারাকানায় সেই দগ্ধ করে দেওয়া বিকেলে গোল্ডেন গ্লাভস আর সেরার পুরস্কার নেওয়ার জন্য পাশাপাশি হাঁটছিলেন ওরা দু’জন।

গোলের পর মেসি। ছবি: রয়টার্স।

গোলের পর মেসি। ছবি: রয়টার্স।

গৌতম ভট্টাচার্য
কলকাতা শেষ আপডেট: ০৭ মে ২০১৫ ২১:০০
Share: Save:

দিনটা ছিল ব্রাজিলের ১৩ জুলাই মধ্য বিকেল।

দিনটা দাঁড়াল স্পেনের ৭ মে সন্ধ্যারাত।
একটা বিশ্বকাপ ফাইনাল। একটা চ্যাম্পিয়ন্স লিগ সেমি ফাইনাল। ঠাটেবাটে-রণসম্ভারে-ঐশ্বর্যে তুলনাই হয় না। একটা প্রতি বছর হয়। একটা চার বছর পর পর। তবু এ সব তো অঙ্কের হিসেব। হৃদয়ের হিসেবে লিওনেল মেসি মাত্র দশ মাস সময় নিলেন ১-১ করতে!
মারাকানায় সেই দগ্ধ করে দেওয়া বিকেলে গোল্ডেন গ্লাভস আর সেরার পুরস্কার নেওয়ার জন্য পাশাপাশি হাঁটছিলেন ওরা দু’জন। জার্মানির ন্যয়ার আর আর্জেন্টিনার মেসি। প্রথম জনকে দেখে মনে হচ্ছিল রাজমুকুট মাথায় গলাতেই যাচ্ছেন। দ্বিতীয় জনের রক্তশূন্য মুখের পেশি বলছিল সোনার বল নিতে যাচ্ছেন যাতে কাঁটা ভর্তি। যে কাঁটা গলায় নিয়ে তাঁকে রাজত্ব ছেড়ে হেরোদের জন্য নির্ধারিত বনবাসে চলে যেতে হবে।
হেরে যাওয়ার পর অনেক বিশ্বখ্যাত ক্রীড়াবিদের চেহারা সামনে থেকে দেখেছি। মর্মভেদী, যন্ত্রণায় হৃদয় এফোঁড়ওফোঁড় হয়ে যাওয়া এক-একটা চেহারা। উইম্বলডনে দ্রুত হেরে যাওয়া ম্যাকেনরো। কাপ ফাইনাল হেরে যাওয়া জোহানেসবার্গের সচিন। জীবনের শেষ ইনিংসে চার রানে আউট হওয়া গাওস্করের টেলিফোনের গলা।
কিন্তু মারাকানার মেসির মতো মর্মান্তিক কিছু দেখিনি। ফিফা প্রধানের কাছে পুরস্কার নেওয়ার জন্য যখন হেঁটে যাচ্ছেন মনে হচ্ছিল জীবন থেকে মৃত্যুর অলিন্দের দিকে এগোচ্ছেন। এমনই রক্তশূন্য আর বায়বীয় দেখাচ্ছিল তাঁকে।
এমন তো নয় যে জার্মানরা দাঁড় করিয়ে ফাইনালে হারিয়ে দিয়েছে। ঠিক উল্টো। আর্জেন্টিনা সুযোগ ওপেন করেছিল বেশি। মেসি নিজেই তো বাঁ পায়ে একটা চোদ্দো গজের শট বাইরে মারেন। খেলার অন্তিম মুহূর্তে যখন ল্যাটিন আমেরিকার সম্পন্ন বাড়ি থেকে ধারাভির বস্তি সবাই তাঁর মারণ ফ্রি কিকে গোল শোধ হওয়ার স্বপ্ন দেখছে, তিনি মেসি বল উড়িয়ে দিয়েছেন ক্রস বারের কত ওপরে। হেরে যাওয়াটা বড় কথা নয়। খেলায় তো হারজিত থাকেই।
কিন্তু নিজের পেশায় চুড়ান্ত অসম্মানিত হয়ে এমন রক্তাক্ত হতে কে চায়।
তাই কাল মধ্যরাতে বার্সেলোনার দ্বিতীয় গোলের পর লিওনেল মেসির নিজের মাপে অপ্রকৃতিস্থ উচ্ছ্বাস পালনের সাদা তর্জমা বহু দূরে বসেও যেন করতে পারছি। নিজের মধ্যে আবার নিজে জিতলাম। নিষ্ঠুর বনবাসের পর আবার ফিরে এলাম সেই ক্ষত্রিয় প্রধান হয়েই। ন্যয়ার বলেছিলেন মেসির মুখ বন্ধ করে দেবেন। তা দুটো অসামান্য গোলে তাঁর মুখ বাকি মরসুমের জন্য বন্ধ থাকা উচিত। আর ওই থিওরিটাও কপচানো যেন কমে—গোলকিপার করে দিচ্ছে সুইপার ব্যাকের কাজ।
ওসব রাঙামুলো প্রতিদ্বন্দ্বীর জন্য হয়। বেলজিয়াম। ইরান। দক্ষিণ কোরিয়া। বিপক্ষে নেইমার, মেসি আর সুয়ারেজ থাকলে কীসের সুইপার ব্যাক। বরঞ্চ অন্য একটা তত্ত্ব দানা বাঁধা উচিত, আর্জেন্টিনা টিমটা আর একটু ব্যালান্সন্ড হলে, সে দিন দি মারিয়া খেললে কি মারাকানায় বিশেষ পুরস্কারটা পেতেন ন্যয়ার?
মেসির মারাকানা আততায়ীদের ছ’জন বায়ার্ন টিমে ছিলেন। প্রত্যেকেই ডাকসাইটে তারকা। ন্যয়ার, বোয়াতেং, মুলার, লাম, সোয়াইনস্টাইগার এবং মারাকানার নায়ক মারিও গোটজে। এঁরা চিত্রার্পিতের মতো দেখলেন বহিষ্কৃত সম্রাটের রাজ্যতে পুনরাভিষেক।
বহু বছর আগে ভিভ রিচার্ডসের একটা ইন্টারভিউ নিতে গিয়ে তাঁকে প্রচণ্ড আবেগাচ্ছন্ন হয়ে পড়তে দেখেছিলাম। ভিভ এমনিতে ইমোশনাল। কিন্তু এতটা আবেগ কখনও দেখিনি যখন বলেছিলেন, “বিশ্বকাপে যে চক্রান্ত করে আমায় বাদ দেবে, আমায় এ ভাবে পেছন থেকে ছুরি মারবে স্বপ্নেও ভাবিনি। এর পর কাউন্টি চ্যাম্পিয়নশিপে যখন সবার নীচে থাকা গ্ল্যামরগানকে চ্যাম্পিয়ন করলাম, তখন মাঠে হয়তো দর্শক বেশি ছিল না। কিন্তু ঈশ্বরের সঙ্গে কথা বলাটা তাতে আটকায়নি। আমি ওঁকে বললাম, ঈশ্বর তুমি জানতে আর আমি জানতাম এমনটাই হওয়ার কথা ছিল।”
জয়ের উত্সব চুকে যাওয়ার পর রাতে একা হয়ে যাওয়া মেসিও কি কথা বললেন তাঁর ঈশ্বরের সঙ্গে যে, মানুষ কখনও শুধু ম্যাচই জেতে না, নিজের কাছেও জেতে। আপনাকে ধন্যবাদ সেই মুহূর্তটা আমদানির জন্য। কিন্তু ঈশ্বর আপনি আর আমি দু’জনেই জানতাম, এমনটাই হওয়ার ছিল!

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE