Advertisement
E-Paper

ধর্ষণে যেমন র‌্যাঙ্ক করেছি, তেমনি এখন দালালমুক্ত নিমতলা, দুটোই তো সত্যি!

দমদমের বাসিন্দা শর্ট ফিল্ম মেকার ‘আম ভোটার’ সৌমিত দেবের কলমে ভোটপুজোর সালতামামিপ্রতি পাঁচ বছরের মত এ বছরও পশ্চিমবঙ্গে ‘সাধারণ মানুষের কথা মাথায়’ রেখে সাড়ম্বরে বিধানসভা নির্বাচন হচ্ছে। মারমার কাটকাট আয়োজন। সমস্ত দায়িত্ব ক্ষমতা অনুযায়ী ভাগ করে দেওয়া ও নেওয়া হয়েছে। শাসক এবং বিরোধী দল নির্বাচনী প্রচারে একে অপরকে পাল্লা দিচ্ছে।

শেষ আপডেট: ২৭ এপ্রিল ২০১৬ ১৭:৩৭

প্রতি পাঁচ বছরের মত এ বছরও পশ্চিমবঙ্গে ‘সাধারণ মানুষের কথা মাথায়’ রেখে সাড়ম্বরে বিধানসভা নির্বাচন হচ্ছে। মারমার কাটকাট আয়োজন। সমস্ত দায়িত্ব ক্ষমতা অনুযায়ী ভাগ করে দেওয়া ও নেওয়া হয়েছে। শাসক এবং বিরোধী দল নির্বাচনী প্রচারে একে অপরকে পাল্লা দিচ্ছে। দলীয় কর্মীরা সেই সমস্ত জৌলুসের প্রপ্‌স যেমন ফেস্টুন, মাইক, হুমকি-রচনাবলি ইত্যাদি সংগ্রহের দায়িত্বে। চ্যানেলের বাজেট অনুযায়ী ক্লাস এ, বি, সি বিদ্বজ্জনেরা তুখোড় তর্ক দেওয়ার দায়িত্বে। কিন্তু যাদের কথা ভেবে এত কিছু, মানে আমরা সাধারণ মানুষরা, আমাদের দায়িত্ব শুধু একটাই। পাঁচ বছরে হালখাতা বা বেহাল-খাতার বউনি থেকে ইয়ার এন্ডিং, সমস্তটা মাথায় রেখে ভোটটা দিয়ে আসা।

জন্মাবধি দেখা শাসকগোষ্ঠীর যে দিন পরিবর্তন হল, নতুন যাঁরা এলেন আপামর সেলেব-আইকনদের সমর্থনে, প্রতিশোধ নয় শান্তি উন্নয়নের বার্তা নিয়ে, তাতে মনে হয়েছিল হয়তো এ বার সত্যিই ম্যাজিক হবে। ম্যাজিক অবশ্য হল। তবে হগওয়ার্টেসের বদলে কলকাতা, বর্ধমানের ছাত্রছাত্রীরা দফায় দফায় মার খেল, রাতের দিকে আলো বন্ধ করে মার। তবে ওইটুকু বাদ দিয়ে যদি পেছনে ফিরে চাওয়া যায় তা হলে শুধুই আলো দেখা যাবে। সেলিব্রেশনের।

পাঁচ বছর আগে রেজাল্টের দিন। রেজাল্ট বেরিয়ে গেছে। বিপুল ভাবে জয়ী হয়েছেন বর্তমান শাসক দল। রাতের দিকে মেট্রো থেকে নামলুম, নেমে অটোর দিকে এগোচ্ছি, হাসিমুখে সাত-আট জন এগিয়ে এলেন হাতে আবির নিয়ে। এত্ত আপনজনের মতো মাখিয়ে দিলেন মুখে যা জিজ্ঞেস টিজ্ঞেসের ধার ধারেনা। বক্সে ‘লাগাবেলু যাব লিপিস্টিপ’ চলছে। ব্যক্তিগত ভাবে ভোজপুরী গান আমার খুবই পছন্দের তাই এই সেলিব্রেশনটাও দারুণ লাগলো।

এরপর দিন গড়াল, দিন গড়াল, সেলিব্রেশন তবু থামে না। ইদিকে বন্ধ চা-বাগানের শ্রমিকদের মরার খবর পড়ছি তো উদিকে মাটি উৎসবের হাসি হাসি মুখে চোখ না গিয়ে যায় কোথায়! জলের কষ্টের মুখে লাথি মেরে হয় জলের দরে না হয় ফ্রিতে সমস্ত কিছু পাওয়া যেতে লাগল। চাল, ডাল, সাইকেল, শাহরুখ খান, সমস্ত কিছু। খালি সারদার পর বেশ কিছু এজেন্টকে আর পাওয়া যায়নি। পাশের পাড়ার নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক দাদার মত।

সাথে আমাদের এলাকায় এমন কোনও রাস্তাও আর পাওয়া যায় না যেটা সন্ধ্যার পর অন্ধকার হয়ে থাকে। সত্যিই পাওয়া। একটা দারুণ ব্রিজ হয়েছে, ফি বছর থিয়েটার-ফিল্ম-ফুড ফেস্টিভ্যাল হচ্ছে। কাউন্সিলার অসম্ভব সৌজন্যে বাড়ির খোঁজ নেন। কারণ আমি সাধারণ মানুষ ক্যাটাগরি এ-তে পড়ি। অর্থাৎ আমার সাথে শাসকগোষ্ঠীর কোনো আঁতাত নেই। আমার বা আমার পরিবারের কেউ সক্রিয় রাজনীতি করেন না, করার সম্ভবনাও নেই। যাঁরা করেন তাঁদের পরিবারের ঝাপসা করে দেওয়া লাইভ টেলিকাস্টে সাড়ে তিন বছরের শিশুরাও বলতে বাধ্য হয়, ‘কাকুলা মেলেছে।’ ফলে আমার ভোট আর যে লোকটা বাড়ি ফিরতে পারছে না তার ভোটের ভিতর পার্থক্য তো হবেই।

সরকারি হাসপাতালে যতই কুকুরের ডায়ালিসিস করানোর মত ‘পশুদরদী মর্মস্পর্শী ঘটনা ঘটুক’, পরিকাঠামো যে বদলেছে এটা অনস্বীকার্য। মেঝেতে বিড়ালের পাশে নিজের স্যালাইন নিজে হাতে ধরে শুয়ে আছে এ জিনিস এখন অবসোলিট। গত পরশুই গিয়ে দেখেছি প্রত্যেকের বেড আছে। বেড়ালগুলো এখন বেডের নীচে ঘুমোয়। মেঝেটা দেখা যায়। ইমার্জেন্সিতে নিয়ে গেলে সেটা যত রাতই হোক, যাই হোক, ডাক্তার পেতে সত্যিই অসুবিধে হয় না, স্ট্রেচার খুঁজে পেতে একটু হয়।

আরও পড়ুন-প্রতিবারই ভোট দি, ফিরি পচা আলু বা কানা বেগুন নিয়ে

আর তা ছাড়া আমি হাতে ওলা পায়ে মেট্রো নিয়ে জিজ্ঞাসা করতেই পারি অত সাইকেল দিয়ে কী হবে? কিন্তু যে সব মেয়েদের আড়াই মাইল হেঁটে ইস্কুল যেতে হতো তাদের কাছে একটা সাইকেল কতটা, মাসে পাঁচশো টাকা রোজগেরের কাছে এক কয়েন মূল্যের চাল বা বিনামূল্যে পড়াশুনো করবার প্রকল্প কতটা, তা এই শহরে বসে আমাদের পক্ষে বোঝা সম্ভব না। কে কি লুজ টক করল আর তাতে কোন ভুল ধরে কোন আঁতেল ‘ফেলিনিশ্রী’ অ্যাওয়ার্ড কুড়োলেন তাতে সেই সমস্ত মানুষের কিচ্ছু যায় আসে না। যাঁদের এক বেলা কাজ না থাকলে পরের বেলায় খাবার জুটবে না, তাঁদের আসলে নাগরিক বিদগ্ধ আলোচনার বিলাসিতার কোনও অবকাশ নেই। গত পাঁচ বছরে রাজ্য যেমন ধর্ষণে র‍্যাঙ্ক করেছে, তেমনই নিমতলার মত জায়গাগুলোকেও দালাল মুক্ত পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন করেছে।

এবং রুবির সামনের ‘ব’ গোলোক, নিউটাউনের রাস্তাজুড়ে টিনের ফুল, মাটির প্যাঁচা, টেরাকোটার স্কাল্পচার, বড় ঘড়ি, বাবুঘাট থেকে প্রিন্সেপঘাট অবদি দুরন্ত রাস্তাটা, কোমর থেকে বৃষ্টির জল হাঁটু অবদি নামিয়ে আনা, মোড়ে মোড়ে ছোটা ভীম ভ্যাট, একের পর এক প্রতিশ্রুতি, ইত্যাদি দেখে ভাল যে লাগে না তাই বা বলি কী করে। কোলেটারাল ড্যামেজ হিসেবে কেটে ফেলা লক্ষ লক্ষ গাছের ক্ষতিপুরণেই হয়ত স্টিল জ্যান্তগুলোর গায়ে কী সুন্দর টুনিলাইট মুড়ে দেওয়া হয়েছে। গত পাঁচ বছরে বেআইনি চোলাই হোক বা আড়ং ধোলাই, বা ভেঙ্গে পড়া উড়ালপুলের ভিক্টিম, ক্ষতিপূরণ হইতে বঞ্চিত হননি কেউ। সরকারের কোনও দায় ‘না’ থাকা সত্ত্বেও, কেউ বঞ্চিত হননি। যেটা সবচাইতে প্রশংসার তা হল ডিস্ক্রিমিনেশন বা পার্শিয়ালিটির কোনও জায়গাই নেই। পরীক্ষার রেজাল্ট পায়নি তো কেউ পায়নি, অনুদান পেয়েছে তো আমার ক্লাবও পেয়েছে। যদিও ‘মন্দজনে’ বলে চাকরি নাকি গেছে বাছাই কিছুর হাতেই।

তাই এই সব মিলিয়ে আমায় যদি কেউ জিজ্ঞেস করে আমি এক বাক্যে সায় দেব যে প্রচুর উন্নয়ন হয়েছে। নিজে আর চাপে পড়ে বেঁধে নেওয়া পট্টি দিয়ে তাকালে যেটুকু দেখতে পাই, তার সবটাই ভাল। সেটা ঝলমলে আলো লাগানো রাস্তা হোক বা সৌন্দার্যায়ন হোক বা স্বাস্থ্য পরিষেবা। বাকি ওই কিছু ছোট্ট সাজানো ঘটনাগুলোর চোখের তলা দিয়ে কখন বেরিয়ে গেছে টেরই পাইনি। ঠিক বিভিন্ন পাঁচ বছরগুলোর মত। সাধারণ মানুষ বলি কতা, এটুকু হতিই পারে।

TMC TMC goons assembly election 2016
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy