Advertisement
E-Paper

পাহাড় হাসবে বটে, তবে তা ধ্বংসের হাসি

একটু সকাল সকাল উঠে চলেছি মংপু। দার্জিলিংয়ের সকালের ভিড় পার হয়ে, ছোট ছোট রাস্তার চড়াই পেরিয়ে গাড়ি এসে পড়ল একটা খুব সুন্দর রাস্তায়। দু’ধারে বড় বড় গাছ, মেঘ আর কুয়াশায় মাখামাখি হয়ে আছে। রাস্তায় গাড়ি প্রায় নেই বললেই চলে। ভিজে পাতার ঘ্রাণ আর প্রচুর অক্সিজেন বুক ভরে নিতে নিতে পৌঁছে গেলাম মংপু। রবিঠাকুরের মংপু।

বাদশা মৈত্র

শেষ আপডেট: ১৬ এপ্রিল ২০১৬ ১৪:১৩

একটু সকাল সকাল উঠে চলেছি মংপু। দার্জিলিংয়ের সকালের ভিড় পার হয়ে, ছোট ছোট রাস্তার চড়াই পেরিয়ে গাড়ি এসে পড়ল একটা খুব সুন্দর রাস্তায়। দু’ধারে বড় বড় গাছ, মেঘ আর কুয়াশায় মাখামাখি হয়ে আছে। রাস্তায় গাড়ি প্রায় নেই বললেই চলে। ভিজে পাতার ঘ্রাণ আর প্রচুর অক্সিজেন বুক ভরে নিতে নিতে পৌঁছে গেলাম মংপু। রবিঠাকুরের মংপু। বহু বার পাহাড়ে এসেছি, কিন্তু মংপু আসা হয়নি কখনও।

রবীন্দ্র ভবন এখানকার অন্যতম আকর্ষণ। পাশেই দীর্ঘ দিন ধরে বন্ধ হয়ে পড়ে আছে একটা বিরাট কুইনাইন ফ্যাক্টরি। এই ফ্যাক্টরির সেই সময়কার চিফ কেমিস্টের বাড়ি ছিল এটি। রবীন্দ্রনাথ বহু সময় কাটিয়েছেন এই বাড়িতে। বহু লেখা লিখেছেন এখানে বসে। একবার তাঁর উপস্থিতিতে তাঁর জন্মদিনে পালন করা হয়েছিল এখানে। বাড়ির প্রতি কোণায় এখনও যেন তার স্পষ্ট উপস্থিতি টের পাওয়া যায়। রবীন্দ্রনাথের ব্যবহৃত লেখার চেয়ার, টেবিল, তাঁর খাট, কিছু চিঠিপত্র ছড়িয়ে আছে এ দিক-ও দিক। অনেক ছবি আছে তাঁর নিজের হাতে আঁকা। কিছু তার মধ্যে অবশ্য ফটো প্রিন্ট, বহু দুষ্প্রাপ্য ফটোগ্রাফ আছে এখানে। তার মধ্যে একটা, যেখানে রবিঠাকুরের মুখে স্মিত হাসি, কিন্তু হাসিটা শুধু চোখ দুটোর মধ্যে ছড়িয়ে আছে। সে যে কি অপূর্ব একটা ছবি! ওই চোখ দুটোর সামনে বসেই দীর্ঘ সময় পার করে দেওয়া যায়।

তবে এর মাঝে বহু সমস্যা মাথায় নিয়েও এক অসামান্য মানুষ শিশিরবাবু প্রাণ দিয়ে আগলে রেখেছেন এই ভবন। জন্মসূত্রে নেপালি, ভাঙা ভাঙা বাংলা বলেন, তিনিই এখানকার গাইড এবং কেয়ারটেকার, রবিঠাকুর তাঁর কাছে ঈশ্বর। তিনিই সব কিছুর শেষ কথা। একটু বেঁকে দাঁড়িয়ে, চোখ বুজে, এক অননুকরণীয় ভঙ্গিতে কথা বলে যান অনর্গল। জোরাজুরি করলে রবীন্দ্রনাথের ছবির সামনে বসে অশুদ্ধ বাংলা উচ্চারণে উদাত্ত কণ্ঠে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের গান গেয়ে যান স্থির হয়ে। সুর-তাল বলতে পারব না। কিন্তু গান শুনে বলেছিলাম, দেবব্রত বিশ্বাস বেঁচে থাকলে এই গান শুনে আপনাকে বুকে জড়িয়ে নিতেন আমি নিশ্চিত। এখানে এলে এই মানুষটার সঙ্গে কাটানোর জন্য কিছুটা সময় হাতে নিয়ে আসা অবশ্য উচিত।

অভিযোগ করতে শেখেননি, কিন্তু আফশোস আছে, অর্থের অভাবে এ বাড়ির অনেক কিছুই নষ্ট হয়ে যাচ্ছে ধীরে ধীরে। সরকার বা অন্য কোনও সাহায্য পেলে আর একটু যত্ন নিয়ে রাখা যেত এই বাড়ির সব কিছু। আরও কিছু বেশি মানুষকে হয়তো নিয়ে আসা যেত এখানে। শিশিরবাবুর বিশ্বাস, রবিঠাকুরের লেখা, তাঁর গান, তাঁর কবিতা— এই সব না থাকলে তাঁর এই পৃথিবীতে আসার কোনও প্রয়োজন ছিল না। ফেরার পথে গাড়িতে এই সব নানা কথার মাঝে, মৃদু স্বরে গোর্খাল্যান্ড প্রসঙ্গটা এক বার তুলেছিলাম। ততোধিক মৃদু স্বরে উত্তর দিলেন, হোক না গোর্খাল্যান্ড, হলেই বা ক্ষতি কী, এর থেকে খারাপ কী আর হবে? জানি না, কথা বলতে আর চাইলেন না, নাকি সত্যি ওনার নামার জায়গা চলে এসেছিল। আস্তে করে বললেন, ‘গাড়ি রোকো’, কোনও কথা না বলে নেমে গেলেন। তবে চলে যাওয়ার আগে একবার পিছনে তাকিয়ে একটা অমলিন হাসি হেসে বিদায় নিলেন। নিমেষে হারিয়ে গেলেন পাহাড়ের বাঁকে। শুধু কানে লেগে রইল সেই উদাত্ত কণ্ঠের গান-‘মরণ বলে আমি তোমার জীবন তরী বাই’। গাড়ি এগোল কালিম্পংয়ের পথে।

সিলভার ওক-এ দুপুরের খাওয়া সেরে বেরোতেই খবর পেলাম সামনেই বিমল গুরুঙ্গ-এর মিটিং চলছে। এই কেন্দ্রে এ বার গুরুঙ্গের এক সময়কার ছায়াসঙ্গী হরকাবাহাদুর ছেত্রী, গুরুঙ্গের পার্টির বিরুদ্ধে লড়ছেন। তাড়াতাড়ি পৌঁছে গেলাম মিটিংয়ের কাছে। একটু অপেক্ষা করতেই বেরিয়ে এলেন বিমল গুরুঙ্গ। নিজের পরিচয় দিলে কথা শুরু হল। সাংবাদিক নই, অভিনেতা শুনে প্রথমে একটু মেপে নিলেন উদ্দেশ্যটা ঠিক কী। তারপর আনন্দবাজার শুনতেই একদমে অনেক কথা বলে গেলেন। মূল বক্তব্য একটাই এই সরকার তাঁদের সঙ্গে যে আচরণ করেছে তাতে তাঁরা খুশি নন। জিটিএ-কে বাদ দিয়ে সব কাজ সরকার নিজে করতে চাইছে, যেটা জিটিএ গঠনের চুক্তির পরিপন্থী। পাহাড় নিয়ে মুখ্যমন্ত্রীর ঘোষণার সঙ্গে বাস্তবের কোথায় ফারাক, তার দীর্ঘ তালিকা সামনে রেখে জানতে চাইলেন, আপনারাই বলুন, সরকারের বিরুদ্ধে যাওয়া ছাড়া কী করার আছে আমাদের? স্টেজে ডাক পড়েছে। চলে যেতে হবে এক্ষুনি। তবে যাওয়ার আগে বুঝিয়ে দিয়ে গেলেন, হাল ছাড়ার লোক নন তিনি। সরকারের এই বঞ্চনার বিরুদ্ধে তাঁর লড়াই চলবে জীবনের শে‌ষ দিন অবধি। মিটিং থেকে বেরিয়ে রাস্তায় নেমে সাধারণ মানুষের সঙ্গে কথাবার্তায় আবারও প্রায় একই ছবি উঠে এল। অসন্তোষের আগুন ধিক ধিক করে জ্বলছে সবার মধ্যেই।

একই চিত্র দার্জিলিংয়েও। অভিযোগগুলোও প্রায় সব এক রকম। প্রকাশভঙ্গির পার্থক্য আছে। কিন্তু কোথাও যেন সবার কথাগুলোই এক সুতোয় বাঁধা। এ ক’দিন পাহাড় ঘুরে, মানুষের সঙ্গে কথা বলে, একটা কথা আজ খুব স্পষ্ট করে অনুভব করছি, অভিযোগের আগুনের আঁচ যত বাড়বে, সমতলের সঙ্গে পাহাড়ের মানুষের বিচ্ছিন্নতাবোধ তত তীব্র থেকে তীব্রতর হবে। বাইরে থেকে এই সমস্যার সমাধান হবে না। যতই পাহাড়কে জোর করে হাসানোর চেষ্টা হোক না কেন, পাহাড় তত দিন হাসবে না, যত দিন না এখানকার মানুষ তাঁদের প্রাপ্য সম্মান পাবেন, অসুখে ডাক্তার পাবেন, বাড়ির কাছে কলেজ পাবেন। আইনের জোরে পাহাড়কে সমতলের সঙ্গে বেঁধে রাখার চেষ্টা না করে, একটু ভালবাসা, একটু আন্তরিকতা, একটু সহমর্মিতা। সঙ্গে একটু আত্মসমালোচনা আজ খুব প্রয়োজন। অন্যথায় পাহাড় হাসছে শুনে, পাহাড় একদিন সত্যি সত্যি হেসে উঠবে। সে হাসি প্রলয়ের হাসি। সে হাসি ধ্বংসের হাসি। সেই দিন আসার আগে আমাদের সবাইকে এক বার শেষ চেষ্টা করতে হবে এক থাকার। একসঙ্গে থাকার।

যে কোনও মূল্যে আমি সেই চেষ্টার অংশীদার হতে রাজি আছি!

assembly election 2016 Badshah Moitro darjeeling
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy