Advertisement
E-Paper

চোখে ডিজাইনার ঠুলি

‘কবি’ উপন্যাসে বিখ্যাত লাইন আছে, ‘জীবন এত ছোট কেনে’। আসলে মানুষের সমস্যা উলটো। জীবন এত বড় কেন। অধিকাংশ সময়টাই বেচারা মানুষ পেল্লায় বোর হয়। সিরিয়াল দেখে, ভিডিও গেম খেলে, হোয়াটস্‌অ্যাপে জঘন্য চুটকি পড়ে, টুইটারে হাবিজাবি লিখে, ফেসবুকে অবান্তর পোস্ট করে, খিদে না পেলেও পেট ঢাই করে পটেটো চিপস খেয়ে, সে কোনও মতে দিন কাটায়।

চন্দ্রিল ভট্টাচার্য

শেষ আপডেট: ২১ মার্চ ২০১৬ ১৯:৩৮

‘কবি’ উপন্যাসে বিখ্যাত লাইন আছে, ‘জীবন এত ছোট কেনে’। আসলে মানুষের সমস্যা উলটো। জীবন এত বড় কেন। অধিকাংশ সময়টাই বেচারা মানুষ পেল্লায় বোর হয়। সিরিয়াল দেখে, ভিডিও গেম খেলে, হোয়াটস্‌অ্যাপে জঘন্য চুটকি পড়ে, টুইটারে হাবিজাবি লিখে, ফেসবুকে অবান্তর পোস্ট করে, খিদে না পেলেও পেট ঢাই করে পটেটো চিপস খেয়ে, সে কোনও মতে দিন কাটায়। আইপিএল এলে হাঁফ ছেড়ে বাঁচে। কিন্তু শুধু তা নিয়ে থাকলে তো মহান মানুষজাতির চলে না। নিজেকে খুব ব্যস্তসমস্ত ও জরুরি ভাবুক হিসেবে সে আয়নায় জপিয়েছে। তাই কিছু অপ্রয়োজনীয় সময়কাটানিয়া কাণ্ড সে আবিষ্কার করেছে, যারা টেরিফিক গ্রাম্ভারি। তারই একটি: নির্বাচন।

নির্বাচন ছাড়া অনেকে দেশেরই দিব্যি চলছে। কিন্তু গণতন্ত্রের ধামা ধরে আছে যে দেশগুলো, নিজেদের মুখ রাখতে তাদের ক’বছর অন্তর কোটি কোটি টাকার ভুষ্টিনাশ করে প্রমাণ করতে হয়, তারা সভ্যতার রেসে কত এগিয়ে। সেই দেশে কে কবে ছড়ি ঘোরাবে, তা নাকি ঠিক করে দেয় সাধারণ মানুষ। এ দিকে গণতন্ত্রে সাধারণ মানুষ সারা দিন ধরে কী চিল্লাচ্ছে? যে, গদিতে বসা লোকেরা তার কথা মোটে শোনে না, তাকে হ্যারাস করে, তার টাকা চুরি করে, তার গলা টিপে দেয়, বুথের সামনে প্রকাণ্ড পেটায়। সারা দিন ধরে সে গলগল করে কুলকুচির মতো উগরে যাচ্ছে: নেতানেত্রীগুলো মানুষ না, সবক’টা আখের গোছানোর জন্যে পলিটিক্সে নেমেছে, প্রত্যেকটা জেলে ঢোকানো উচিত বা পাগলাগারদে, এরা অশিক্ষিত অসংযত চরিত্রহীন, এদের চেয়ে রামাশ্যামা ও ছোটমামা হাজার গুণ ভাল। তা হলে বাপ এদের ভোট দিচ্ছিস কেন? এদের মধ্যে কে জিতবে কে হারবে তা নিয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা গলার শির ছিঁড়ে এনার্জি খরচ করছিস কেন? কোন কেন্দ্রে কে দাঁড়িয়েছে, কার দাঁড়ানো উচিত ছিল, কে নীতির ধার ধারে না আর কে ভীতি দিয়ে প্রীতি কেনে, তা নিয়ে গোটা সিজন পেট মচকে ভাবনা পাড়ছিস কেন? কারণ, তা-ই করতে হয়। এ অনেকটা বিয়ের মতো ব্যাপার। কেন করবে? কারণ সবাই করে। ভোট কেন জরুরি? কারণ জরুরি।

পণ্ডিত ও মিডিয়া বলে, বাঃ, ঠিকই তো, সাধারণ মানুষই তো হিসেবনিকেশ করে ঠিক করেন, কাকে এ বার দায়িত্ব দেবেন আর কার ওপর থেকে বিশ্বাস প্রত্যাহার করে নেবেন। ক্রিয়াপদে ওই আপনি-আজ্ঞে-বাচক ‘করবেন’, ‘নেবেন’ চালালে সাধারণ মানুষকে সাড়ে ছ’ফুট তোল্লাই দেওয়া যায়। মনে হয়, সাধারণ মানুষ সত্যিই বিশাল হনু। কিন্তু সত্যিই এই দেশটা সাধারণ মানুষে চালাচ্ছে? সত্যিই এই রাজ্যটা সাধারণ মানুষে চালাচ্ছে? চালায়? কোনও দিন চালিয়েছে? না কি সাধারণ মানুষ আসলে সেই পোকামাকড়, যাকে এখুনি দলেপিষে গোল্লা পাকানো হবে, না পাঁচ মিনিট পরে, এইটুকু শুধু অনিশ্চিত? নেতা মিটিং করে, সাধারণ মানুষের বাবা আটকা-অ্যাম্বুল্যান্সে মারা যায়। পার্টির গোষ্ঠীদ্বন্দ্বে গুলি চলে, সাধারণ পথচারীর গায়ে গুলি লাগে। পার্টির গুন্ডারা এসে সাধারণ মানুষকে শাসিয়ে যায়, এই স্থানেকালে কন্টিনিউ করতে গেলে কাকে ভোট দিতে হবে। সাধারণ মানুষ রোগী নিয়ে হাসপাতালের চাতালে, ভাঙা আলমারি নিয়ে থানার উঠোনে, হেড়ো কঙ্কাল নিয়ে লক-আউট কারখানার চত্বরে, বিষে নীল গলা নিয়ে ভেজালমাস্টারের দেউড়িতে কাতরায়। সাধারণ মানুষ সারা ক্ষণ ভয়ে কাঁপে, অবজ্ঞা পেয়ে মাটি চাটে, আর বাসেট্রামে গজগজ করে। সে সর্ব ক্ষণ অখুশি, অভাবী, সর্বোপরি আশাহীন। এক বারের জন্যেও বিশ্বাস করে না, কেউ তার ভাল করবে। কেউ ভাল করতে চায়। সে নিশ্চিত, রাজনীতির গেঁড়েরা সবাই তাকে ঠকাচ্ছে। প্রতিশ্রুতিগুলো সব মিথ্যে, কাজগুলো সব গলদ-ভর্তি। তাই কোনও নেতা বা নেত্রীর অসততা ধরা পড়ে গেলে, তার নামে কেচ্ছা হু-হু উড়লে, সাধারণ মানুষ ভয়ানক খুশি হয়। ফলাও করে চেঁচায়, তুখড় রসিকতা কাটে। তার মনে হয়, যাক, একটা শয়তানের মুখোশ তো খুলে গেল। একটা ভিলেন তো নিকেশ হল। তার মনে প্রতিশোধের হাওয়া, একটা ‘বেশ হয়েছে’ মার্কা তাজা সন্তুষ্টি ফুরফুর করে। তার মানে, সাধারণ মানুষ ও রাজনৈতিক নেতানেত্রীদের সম্পর্ক আসলে শত্রুর। সাধারণ মানুষ সম্বন্ধ করে বিয়েতে রাজনীতিকের ঘরে মেয়ে দেবে না।

এবং এই বৈরিতার মনোভাব, এই তেতো অবিশ্বাস, এই অকৃত্রিম ঘৃণা, সব পার্টির বিরুদ্ধে, সব পার্টির সব লোকের বিরুদ্ধে। নেতাদের অসততা, অন্যায়, দুর্নীতি— এগুলো শুধু গা-সওয়া নয়, মানুষের মতে, নিয়ম। নেতা ঘুষ খেলে সে বলে, ‘সে তো খাবেই। কিন্তু টাকা খেয়ে কাজটা অ্যাট লিস্ট কর!’ বাসে ঠাসা ভিড়ে সেদ্ধ হতে হতে সবাই যখন অফিস যায়, তখন পোঁ-ও-ও পোঁ-ও-ও শব্দ করে কোনও নেতার গাড়ি গেলে সারা বাসময় গালাগালের বন্যা। রাস্তায় ভয়ানক খোঁদলে গাড়ি ঝাঁকুনি খেলে কেউ আনমনে বলে ওঠে, ‘সে দিনই সারানো হল না?’ তক্ষুনি পাশের লোক বলে, ‘সে রকমই সারানো! আরে কন্ট্রাক্টর তো ঠিক জায়গায় ঘুষ দিয়ে রেখেছে, যাতে বৃষ্টি পড়লেই ফের বরাত পায়!’ পুলিশ যখন নেতার কথা শুনে অপরাধীকে ছেড়ে দেয়, সাধারণ মানুষ ফোঁস করে শ্বাস ছেড়ে বলে, ‘সে তো হবেই। পরের জন্মে যেন নেতার ভাগ্নে হই ভগবান!’ জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে, এ দেশের মানুষ রাজনীতির পাণ্ডাদের বিরুদ্ধে আক্রোশ উগরে দেয় আর বিহিত করতে না পারার অক্ষমতায় হাত কামড়ায়। যেন কনসেনট্রেশন ক্যাম্পের লাইনে দাঁড়িয়ে আছে।

তা হলে নির্বাচনে সবাই এত উৎসাহী কেন? কিছু একটা করে অবস্থা বদলাবার নেশায়? না। বারে বারে ঘা খেয়ে, একটু-আধটু বিশ্বাস করে ও তার পর একদম হুবহু আগের ভিলেনটার জেরক্সের মতো থাপ্পড়ই নতুন হিরোর কাছেও খেয়ে, সে এ সব আশাবাদের উদ্ভটতা থেকে রেহাই পেয়েছে। সে নির্বাচন নিয়ে মাথা ঘামায়, কারণ এটাও একটা আইপিএল। এটা নিয়ে মেতে থাকা যাবে বেশ ক’দিন। আর, এই ক’দিন যে সব বড়-বড় লোক ভান করে, সাধারণ মানুষকে তারা খুব সিরিয়াসলি নিচ্ছে, তার চিন্তাভাবনার একটা পেল্লায় মূল্য দিচ্ছে, এইটাকে মিথ্যে জানলেও, তার ইগোয় প্রভূত মালিশ ঘটে। আর, অবশ্যই, প্রথা। সেই এক জন লোক ছিল, নভেম্বর পড়লেই মাংকি ক্যাপ পরে নিত। যদি সে দিন দুশো চল্লিশ ডিগ্রি গরমও পড়ে, কুছ পরোয়া নেহি। ক্যালেন্ডারে নভেম্বর এসেছে, তার মানে শীত। সে রকমই, অধিকাংশ মানুষ একটা দ্যোতককেই আসল জিনিস বলে ভুল করতে অভ্যস্ত। নির্বাচন হলেই যেন গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয়। আর গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হলেই যেন প্রমাণ হয়, দেশটি সাধারণ মানুষকে মর্যাদা দেয়। বাস্তব তার সম্পূর্ণ উলটো কথা কোটিখানেক বার বলুক ও তার নিজের জীবনটাই সেই স্বাক্ষরে দগদগে হয়ে থাক, তবু তাকে ভোট দিয়ে নিজের গুরুত্ব জাহির করতে হবে, ভাবতে হবে, তার ওপরেই আছে ভুবনের ভার।

Chandril Bhattacharya assembly election 2016 west bengal
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy