কালীঘাটের বাড়িতে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এবং অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়। সঙ্গে মেয়ে আজানিয়া। বৃহস্পতিবার সুদীপ আচার্যের তোলা ছবি।
বাইরে উল্লাসের গর্জন। ধীরে ধীরে জমা হচ্ছেন কর্মী-সমর্থকরা। কিছু ক্ষণ পরে বেরিয়ে এলেন তিনি। যাঁর উদ্দেশে এত ক্ষণ ধরে একটু একটু করে সাজানো হয়েছে অভিনন্দনের পসরা। যুদ্ধজয়ের হাসি লেগে আছে প্রশান্ত মুখে। উপস্থিত স্বজনদের সঙ্গে সামান্য আলাপ সেরে চিত্রসাংবাদিকদের ছবি-শিকারের সুযোগ দিয়ে সবুজ কার্পেটের উপর দিয়ে হেঁটে গেলেন সাংবাদিক সম্মেলন কক্ষের দিকে।
৩০ এপ্রিল, যে দিন মমতার নিজের কেন্দ্র ভবানীপুরের ভোট ছিল, সে দিন সকাল থেকে তাঁর বাড়ির ধারে-কাছে ঘেঁষতে পারেনি সংবাদমাধ্যম। কিন্তু ফল প্রকাশের দিন আগে থেকেই দু’টি মণ্ডপ তৈরি করিয়ে রেখেছিলেন মমতা। সকাল ৮টা থেকেই সেখানে সেখানে গুটি গুটি আসতে শুরু করেন সাংবাদিক, চিত্র সাংবাদিকরা। হরিশ চ্যাটার্জি স্ট্রিট আর কালীঘাট সেতুর সংযোগস্থলে তখন পুলিশের ভিড়। তৃণমূল কর্মীরা আছেন ছড়িয়ে-ছিটিয়ে। চার দিক উদ্বিগ্ন প্রতীক্ষায় থমথম করছে। মমতার বাড়ির দরজাও বন্ধ।
১০টা বাজার মিনিট দশেক আগে থেকে ছবিটা ধীরে ধীরে বদলাতে শুরু করল। প্রথমে এক জন শীর্ণকায় মহিলা বাড়ির পাশ থেকে রাস্তায় বেরিয়ে এলেন শাঁখ বাজাতে বাজাতে। তার পর আরও নানা দিক থেকে বাড়তে লাগল শঙ্খধ্বনি। সঙ্গে যোগ হল উলু, বাঁশি ও কাঁসর। সবুজ আবির মেখে ভিড় জমাতে শুরু করলেন ভক্তরা। এর পর সময় যত গড়িয়েছে, ততই তৃণমূলের উচ্ছ্বাস উড়েছে সবুজ আবিরে। সপসপে বৃষ্টিতেও আবির খেলায় ঘাটতি পড়েনি। বরং সকৌতুক চিৎকার শোনা গিয়েছে— ‘‘বৃষ্টি পড়ছে। আকাশে তো সূর্য নেই!’’
এ সবের মধ্যেই ১১টা ১০ নাগাদ অভিনেতা-সাংসদ দেব ঢুকলেন। তার ১০ মিনিট পরে শিশুকন্যাকে কোলে নিয়ে অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়। আরও কিছু ক্ষণ পরে সম্মেলন কক্ষে প্রবেশ মমতার। তাঁর সঙ্গে ডেরেক ও’ ব্রায়েন, মুকুল রায়, অভিষেক, দেব, রাজ চক্রবর্তী এবং রুদ্রনীল ঘোষ। শ্রীকান্ত মোহতার জন্য অপেক্ষা করছিলেন নেত্রী। তিনি আসার পর কথা শুরু করলেন। দুই-তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতায় ভরিয়ে দেওয়ার জন্য কৃতজ্ঞতা জানালেন মানুষকে। তার পর তৃপ্ত গলায় বললেন, ‘‘গত বার ২০ মে শপথ নেওয়া হয়েছিল। এ বার ২০ মে থেকে ৩০ তারিখ পর্যন্ত স্থানীয় স্তরে সামাজিক-সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে বিজয় উৎসব হবে। মনীষীদের স্মরণ করা হবে। যেমন আমরা করে থাকি।’’ ওই বিজয় উৎসবে কৃতী ছাত্রছাত্রীদেরও সংবর্ধনা দেওয়া হবে বলে মমতা জানান।
এ বছর ২০ মে শুক্রবার পড়েছে। মমতা বলেন, এই তারিখটা তাঁদের কাছে পরিবর্তনের দিন। তার উপর শুক্রবারটা সর্বধর্ম সমন্বয়েরও দিন। তাই ওই দিনই সাড়ে ১২টায় দলীয় বিধায়কদের ডাকা হয়েছে। আর
২৭ মে আগামী শুক্রবার, তাঁর সরকার দ্বিতীয় বারের জন্য শপথ নেবে। তৃণমূল সূত্রের খবর, এ বার রেড রোডে শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠান হবে বলে আপাতত ঠিক হয়েছে। এ বার
কি শপথে রবীন্দ্রসঙ্গীত বাজবে? মমতার জবাব, ‘‘আগের বার তো শপথে রবীন্দ্রসঙ্গীত বাজেনি। বিজয়োৎসবে বেজেছিল।’’
নেত্রীই এ দিন জানান, প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী এবং কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী
অরুণ জেটলি ফোন করে তাঁকে অভিনন্দন জানিয়েছেন। অভিনন্দন-বার্তা পাঠিয়েছেন রেলমন্ত্রী সুরেশ প্রভু এবং অমিতাভ বচ্চন। বিপুল জয়ের পর তাঁর লক্ষ্য কী? মমতা বলেন, ‘‘আমাদের দায়বদ্ধতা এবং দায়িত্ববোধ বাড়ল। আমার একটাই স্বপ্ন— বাংলাকে বিশ্বশ্রেষ্ঠ করা।’’
এত জয়ের মধ্যেও মমতা এ দিন ভোট পর্বে পুলিশি বাড়াবাড়ির অভিযোগ তুলতে ছাড়েননি। তিনি বলেন, ‘‘পুলিশের কিছু বাড়াবাড়ি তো হয়েইছে। কেন্দ্রীয় বাহিনীর নাম করে অ্যাম্বুল্যান্সে তালা দিয়ে দেওয়া হয়েছে। ওষুধের দোকানে মানুষ লাইন দিয়েছে। গায়ের জোরে সেটা বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। ভবানীপুরে হুমকি দিয়ে ভোট কমিয়ে দেওয়া হয়েছে।’’ মমতার অভিযোগ, যাদবপুরে ৯০ শতাংশের উপরে ভোট পড়েছে। বাইরে থেকে কিছু পুলিশ এসেছিল। তাদের উপর কাউকে কাউকে সাহায্য করার দায়িত্ব ছিল। যাদবপুরে সেই ফর্মুলাই কাজ করেছে।
বিপুল জনাদেশ নিয়ে ক্ষমতায় ফিরে এ বার কি তবে অভিযুক্ত পুলিশদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেবেন? মমতার জবাব, ‘‘আমি কী করব? মানুষই করবে। মানুষ তো ইতিমধ্যেই কারও কারও বিরুদ্ধে এফআইআর করেছে। আমি এর মধ্যে ঢুকব কেন?’’ এর পর তাঁর সংযোজন, ‘‘আপনারাই (সংবাদপত্র) তো মেরুদণ্ড সোজা করে দিয়েছেন! আমাকে আর মুখ খোলাচ্ছেন কেন?’’ এ দিন বিকেলে কলকাতার পুলিশ কমিশনার সৌমেন মিত্র, ডিজি (ওএসডি) সুরজিৎ কর পুরকায়স্থ, পুলিশ কমিশনারের পদ থেকে নির্বাচন কমিশনের দ্বারা অপসারিত রাজীব কুমার, মুখ্যসচিব বাসুদেব বন্দ্যোপাধ্যায় এবং স্বরাষ্ট্রসচিব মলয় দে মমতার বাড়ি গিয়ে তাঁর সঙ্গে দেখা করেন।
ভবানীপুরে ভোট গণনাকেন্দ্রেও এ দিন ছিল উৎসবের ছবি। সামিয়ানা খাটিয়ে আচার্য জগদীশচন্দ্র বসু রোডের উড়ালপুলের তলায় বসার জায়গা তৈরি করেছিল তৃণমূল। ন’টা নাগাদ রাজ্য জুড়ে জয়ের ছবিটা স্পষ্ট হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই ভিড় জমে সামিয়ানার তলায়। সাড়ে বারোটা নাগাদ সেখানে পৌঁছন সুব্রত বক্সী এবং মমতার ভাই কার্তিক বন্দ্যোপাধ্যায়। শুরু হয় স্লোগান এবং আবির খেলা। মুখ্যমন্ত্রীর হয়ে শংসাপত্র নেন তাঁর নির্বাচনী এজেন্ট শুভাশিস চক্রবর্তী এবং সুব্রতবাবু।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy