Advertisement
০৫ মে ২০২৪

বিরক্তি ভুলে মানস হাসলেন দিনের শেষে

খাটো ধুতি, ছেঁড়া গেঞ্জির ক্ষয়াটে বৃদ্ধ কাঁদতে কাঁদতে বললেন, ‘‘দেখুন কর্তা দেখুন! আপনার মিটিংয়ে গেছলাম বলে ভোট দিয়ে বেরোতেই আমার হাত ভেঙে দিয়েছে!’’

ভোট দিতে এসেছেন মানস ভুঁইয়া। অভিবাদন জানালেন কেন্দ্রীয় বাহিনীর জওয়ানকে। সোমবার নিশ্চিন্তপুরে স্বাতী চক্রবর্তীর তোলা ছবি।

ভোট দিতে এসেছেন মানস ভুঁইয়া। অভিবাদন জানালেন কেন্দ্রীয় বাহিনীর জওয়ানকে। সোমবার নিশ্চিন্তপুরে স্বাতী চক্রবর্তীর তোলা ছবি।

দেবারতি সিংহচৌধুরী
সবং শেষ আপডেট: ১২ এপ্রিল ২০১৬ ০৪:১৭
Share: Save:

খাটো ধুতি, ছেঁড়া গেঞ্জির ক্ষয়াটে বৃদ্ধ কাঁদতে কাঁদতে বললেন, ‘‘দেখুন কর্তা দেখুন! আপনার মিটিংয়ে গেছলাম বলে ভোট দিয়ে বেরোতেই আমার হাত ভেঙে দিয়েছে!’’ বৃদ্ধের হাত থেকে এক্স-রে প্লেটটা নিয়ে আলোয় একঝলক দেখেই ডাক্তারবাবুর মন্তব্য, ‘‘হাতের হাড় ভেঙেছে তো! বাঁ হাতের কনুইয়ের নীচের হাড়ে চিড়।’’

বাঁ পায়েও যন্ত্রণা হচ্ছে শুনে দেখলেন সেটাও। জানতে চাইলেন, ‘‘ফিমার বোন ফ্র্যাকচার হয়েছে মনে হচ্ছে। এক্স-রে করাসনি কেন?’’ পর ক্ষণেই বৃদ্ধের কাঁধে হাত রেখে আশ্বাস, ‘‘কাঁদিস না। কালই আমি মেদিনীপুরে পাঠিয়ে তোর প্লাস্টার করিয়ে দেব।’’ বৃদ্ধের এ আঘাত যে তাঁর জন্যই, তা জানেন প্রবীণ ‘ডাক্তারবাবু’ মানস ভুঁইয়া। সবংয়ে তাঁর বিরুদ্ধেই তিন দিন আগে তৃণমূল কর্মীকে খুনের প্রধান ষড়যন্ত্রকারীর অভিযোগ দায়ের করেছে তৃণমূল! তাই একরাশ বিরক্তি গলায় নিয়ে মানস বলেন, ‘‘এই হচ্ছে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের গণতন্ত্র! আমাকে জব্দ করতে এমন গরিব চাষিকেও মারতে হচ্ছে ওদের!’’

গনগনে রোদেপোড়া অ্যাসবেস্টসের পার্টি অফিসে তখন পড়ন্ত বিকেল। হঠাৎই সবং ব্লক কংগ্রেসের সাধারণ সম্পাদক আবু কালাম বক্স খবর দিলেন, পাঁচথুবি বুথে ভোট লুঠ হচ্ছে। সেখানে কংগ্রেসের সাত কর্মী তৃণমূলের মারে আহত। আহতদের হাসপাতালে পাঠাতে নিজেই ফোনে কর্মীদের নির্দেশ দিলেন। বিকেল পাঁচটা নাগাদ প্রায় ৮০% ভোট পড়েছে শুনে স্বস্তি পেলেন ঠিকই, কিন্তু দিনভর তাড়া করল সবং আর পিংলা ব্লকের ২৩টা বুথ। ওই সব বুথে কংগ্রেসের এজেন্টদের বসতে দেওয়া হয়নি বলে মানসের অভিযোগ। এ জন্য তাঁর ভোটের ফলে কতটা প্রভাব পড়তে পারে, তা নিয়ে পশ্চিম মেদিনীপুরের জেলা কংগ্রেস সভাপতি বিকাশ ভুঁইয়ার সঙ্গে বসে হিসেব করে ফেললেন। তার ফাঁকেই বেরিয়ে এল ক্ষোভ, ‘‘জ্যোতিবাবুর ২৩ বছর, বুদ্ধবাবুর ১০ বছরে কেউ আমার বিরুদ্ধে একটা টোকা মারারও অভিযোগ আনতে পারেনি। আর এই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় আমার নামে টাকা ছিনতাইকারী, শ্লীলতাহানির মামলা করল!’’ সঙ্গে যোগ করলেন, ‘‘২২টা ভোট করেছি। এমন নোংরা রাজনীতি কোনও দিন দেখিনি!’’

সে জন্যই হয়তো সকাল থেকেই মেজাজ খারাপ মানসের! পাটভাঙা হলুদ পাঞ্জাবী, সাদা ধুতি পরে নিশ্চিন্তপুরের বাড়ি থেকে স্ত্রী গীতাদেবীকে নিয়ে ভোট দিতে বেরোনোর সময় থেকেই। তিন রাত না ঘুমনোর চিহ্নমাত্র নেই চোখেমুখে! পরে বললেন, ‘‘আমাকে হারাতে চক্রব্যূহ তৈরি করেছেন দিদিমনি! আর কেন্দ্রীয় বাহিনী তো রাজ্য প্রশাসনের কোলে ঘুমোচ্ছে!’’ তার পরেই মন্তব্য, ‘‘যদি জিতে আসি, আই উইল টেক আ পয়েন্ট টু মমতা।’’ ঠিকই করে রেখেছিলেন, ভোট দিয়ে সোজা সবং পার্টি অফিসে বসে কোথায় কী হচ্ছে, খবর নেবেন। গোলমালের খবর পেলেও নিজে ঘটনাস্থলে যাবেন না। যানওনি। ‘‘আমাকে গ্রেফতারের জন্য পুলিশ মুখিয়ে আছে! আমি বুথে গেলেই উত্তেজনা তৈরি হবে।’’ দুপুরে কন্ট্রোল রুমের কম্পিউটার থেকে দিল্লিতে মুখ্য নির্বাচন কমিশনার নসীম জৈদীকে অভিযোগ জানালেন, কোথায় কোথায় তাঁর এজেন্টদের বুথ থেকে বার করে দেওয়া হয়েছে। কেন্দ্রীয় বাহিনীর বিরুদ্ধেও অসন্তোষ ফেটে বেরলো, ‘‘বিহারের থেকেও সুষ্ঠু ভাবে পশ্চিমবঙ্গে ভোট হবে বলে কমিশন আশ্বাস দিয়েছিল। কিন্তু সেই আশ্বাস রাখাই হয়নি!’’

এ সবের ফাঁকেই শুনেছেন নারায়ণগড়ে জোটপ্রার্থী সিপিএমের সাধারণ সম্পাদক সূর্যকান্ত মিশ্রকে ঘিরে বিক্ষোভ হয়েছে। বেলা দু’টো নাগাদ সূর্যবাবুকে ফোন, ‘‘আপনার ওখানে কী পরিস্থিতি?’’ কয়েক মিনিটের ফোনালাপ সেরে স্বগতোক্তি, ‘‘আমি আর সূর্যবাবু তো মমতার টার্গেট। কিন্তু মমতা বোধ হয় জানেন না যে সবংয়ের মানুষ রক্তবীজের বংশধর! কিছুতেই হার মানে না!’’

কর্মীর হাড়ে চিড় ধরলেও তাঁর গড়ে শাসক দল ‘ফ্র্যাকচার’ করতে পারবে না বুঝে দিনের শেষে আত্মবিশ্বাসী মানসের মুখে হাসি। ‘‘সবংয়ের মানুষের চোখে চোখ রেখে আমি বুঝি, ওরা আমাকে চায়। মানস ভুঁইয়ার ফ্র্যাকচার আটকাতে সে জন্যই তো আমার কর্মীদের হাত-পা ফ্র্যাকচার হচ্ছে!’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

assembly election 2016 Manas Bhunia
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE