Advertisement
E-Paper

বেলা বাড়তেই গা-ছাড়া বাহিনীর

সকাল সাড়ে ১০টা। পুরুলিয়ার রঘুনাথপুর বিধানসভার আদ্রার মিশনপাড়া জুনিয়র হাইস্কুলের বুথ। বুথের কাছে ভোটারেরা মোটরবাইক কোথায় রাখবেন, সেই ব্যবস্থা করতে ব্যস্ত কেন্দ্রীয় বাহিনীর জওয়ানেরা।

শুভ্রপ্রকাশ মণ্ডল

শেষ আপডেট: ০৫ এপ্রিল ২০১৬ ০০:৩৭
বুথ চত্বরে ভোটারদের লাইন পড়লেই তা সামলানোর দায়িত্ব রাজ্য পুলিশের। পাড়ার পলমা প্রাথমিক স্কুলের বুথে ভোটার না থাকা সত্ত্বেও রয়েছেন রাজ্য পুলিশের কর্মী।

বুথ চত্বরে ভোটারদের লাইন পড়লেই তা সামলানোর দায়িত্ব রাজ্য পুলিশের। পাড়ার পলমা প্রাথমিক স্কুলের বুথে ভোটার না থাকা সত্ত্বেও রয়েছেন রাজ্য পুলিশের কর্মী।

সকাল সাড়ে ১০টা। পুরুলিয়ার রঘুনাথপুর বিধানসভার আদ্রার মিশনপাড়া জুনিয়র হাইস্কুলের বুথ। বুথের কাছে ভোটারেরা মোটরবাইক কোথায় রাখবেন, সেই ব্যবস্থা করতে ব্যস্ত কেন্দ্রীয় বাহিনীর জওয়ানেরা। বুথ সামলাচ্ছেন জনা আট রাজ্য পুলিশ। পরে এই বুথেই ভোটারদের প্রভাবিত করার অভিযোগে এক পুলিশকর্মীকে দায়িত্ব থেকে সরিয়ে দেয় নির্বাচন কমিশন।

চিত্র ২: সকাল সাড়ে ১১টা। রঘুনাথপুরে গার্লস হাইস্কুলের বুথে মূল গেট পেরিয়েই ডান দিকে সাইকেল স্ট্যান্ডে চলছে ভোটকর্মীদের জন্য রান্না। সেখানেই খোশগল্পে মজে কেন্দ্রীয় বাহিনীর চার জওয়ান। বাইরে চেয়ারে বসে তন্দ্রাচ্ছন্ন রাজ্য পুলিশের এক কর্মী।

চিত্র ৩: দুপুর সাড়ে ১২টা। রঘুনাথপুরে সেনেড়া প্রাথমিক বিদ্যালয়ের বুথ। পাহাড়ের নীচে স্কুলের যে ঘরে ভোটগ্রহণ চলছে, তার জানলা খোলা। তার পাশেই ইভিএম। জানলার বাইরে ছোটখাটো একটা জটলা। লোক আসতে দেখেই জানলা ছেড়ে সরে গেল ভিড়টা। কিন্তু তাদের সরিয়ে দিতে কেন্দ্রীয় বাহিনী কোথায়? জানা গেল, জওয়ানেরা সামনের দিকে ভোটের লাইন সামলাতে ব্যস্ত।

চিত্র ৪: অতি স্পর্শকাতর বলে চিহ্নিত বান্দোয়ানের শিরকা প্রাথমিক স্কুলের বুথে বাহিনীর ১৬ জন জওয়ান থাকার কথা ছিল। দুপুর ১টায় সেখানে গিয়ে দেখা গেল, ৮ জন বুথ সামলাচ্ছেন। বাকিরা প্রায় ৫০ মিটার দূরে গাছতলায় বসে আড্ডায় মেতেছেন।

চিত্র ৫: বান্দোয়ানের গঙ্গামান্না গ্রামে বুথের আশপাশে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে ছিলেন বাহিনীর জওয়ানেরা। সংবাদমাধ্যমের গাড়ি ঢুকতে দেখেই তৎপরতা শুরু। দ্রুত নিজেদের জায়গায় পৌঁছে গেলেন তাঁরা।


ভিতরে চলছে ভোট। রঘুনাথপুর গার্লস হাইস্কুলের বুথের সামনে তখন তন্দ্রাচ্ছন্ন হোমগার্ড।

সোমবার সকাল থেকে বিকেল পর্যন্ত পুরুলিয়ার নানা বিধানসভা কেন্দ্রে এমন সব ভূমিকাতেই দেখা গেল কেন্দ্রীয় বাহিনীকে। নিয়ম অনুযায়ী, কেন্দ্রীয় বাহিনী শুধু বুথ নয়, ভোটারদের মনোবল বাড়াতে তার দেড়শো মিটার এলাকায় টহল দেওয়ার কথা। কিন্তু বিস্তীর্ণ এলাকায় ঘুরেও তেমন কোনও টহলের দৃশ্য চোখে পড়েনি। বাহিনীর জওয়ানদের গতিবিধি সীমাবদ্ধ ছিল শুধু বুথের মধ্যেই।

আদ্রা হয়ে রঘুনাথপুর থেকে চেলিয়ামা, পাড়া হয়ে কাশীপুর, রঘুনাথপুর ছুঁয়ে নিতুড়িয়া— দীর্ঘ রাস্তায় চোখে পড়েনি নির্বাচন কমিশনের পর্যবেক্ষক, পুলিশ পর্যবেক্ষ বা ফ্লাইং স্কোয়াডের গাড়ি। পুরুলিয়া-বরাকর রাস্তায় পলমার কাছে নাকা পয়েন্ট ও শাঁকা রেলগেটের কাছে জিপে কিছু পুলিশকর্মীকে অলস ভাবে বসে খাকতে দেখা যায়। ঝালদা-বেগুনকোদর রাস্তায় জজলং মোড় থেকে মাওবাদী প্রভাবিত বাঘবিন্দা যাওয়ার রাস্তা অথবা বলরামপুর-বাঘমুণ্ডি রাস্তায় বাঁশেটি মোড় থেকে মাওবাদী প্রভাবিত বারডি যাওয়ার জঙ্গলঘেরা ৫ কিলোমিটার রাস্তা, কোথাও কেন্দ্রীয় বাহিনীর দেখা মেলেনি। ঝাড়খণ্ড সীমানা লাগোয়া মাওবাদী প্রভাবিত বুড়িছোড় গ্রামের দম্পতি অশ্বিনী সিংহ ও মিথিলা সিংহের অভিযোগ, ‘‘দিন কয়েক আগে এক দিনই বাহিনী গ্রামে টহল দিয়েছিল। ভোট দিতে যাওয়ার পথে রাস্তায় কোথাও জওয়ানদের দেখিনি।’’ পাড়া বিধানসভার পলমার এক বুথে কর্তব্যরত জওয়ানদের প্রশ্ন করে জানা গেল, তাঁদের বুথেই থাকতে বলা হয়েছে। টহল দেওয়ার নির্দেশ পাননি।

সকালে বুথে-বুথে ভোটারদের লাইন চোখে পড়লেও বেলা যত গড়িয়েছে, বুথ ফাঁকা হয়েছে। আর বাহিনীর জওয়ানদের মধ্যেও তত গা-ছাড়া ভাব দেখা গিয়েছে বলে অভিযোগ। বিকেলে নিতুড়িয়ার গোবাগ গ্রামের বুথে গেটের মুখে বেঞ্চে বসেছিলেন দুই জওয়ান। রাস্তার উল্টো দিকে গাছতলায় বাঁধানো বেদিতে বসে জনা দশেক তৃণমূল কর্মী। আশপাশের বাসিন্দারা জানালেন, সকাল থেকেই বসে রয়েছেন শাসকদলের ওই কর্মীরা। কোনও ব্যবস্থা নেয়নি বাহিনী। নিতুড়িয়ারই রামপুর হাইস্কুলে মূল গেটের সামনে বসেছিলেন দুই জওয়ান। সেখানেও রাস্তার উল্টো দিকে বাঁশঝাড়ের সামনে বসে কয়েক জন। খানিক দূরেই তৃণমূলের ফ্লেক্স লাগানো গাছের কাছে জনা আট-দশ জনের জটলা। রাজ্য পুলিশ শুধু বুথে ভোটারদের লাইন সামলাবে বলে জানিয়েছিল নির্বাচন কমিশন। কিন্তু বিভিন্ন বুথে রাজ্য পুলিশকে বুথের মুখে দাঁড়ানো কেন্দ্রীয় বাহিনীর সঙ্গে গল্পে মাততে দেখা গিয়েছে।

শাসকদলের বিরুদ্ধে বাহিনীকে কার্যত বসিয়ে রেখে একতরফা ভাবে ভোট করানোর অভিযোগ তুলেছে বিরোধীরা। কাশীপুরে কংগ্রেসের সভাপতি কার্তিক মালাকারের অভিযোগ, ‘‘লোকসভা ভোটেও বাহিনীকে বুথে যতটা তৎপর দেখা গিয়েছিল, এ বার তার সিকি ভাগ চোখে পড়েনি।” কাশীপুরের সুতাবই গ্রামের বুথে কেন্দ্রীয় বাহিনী থাকা সত্ত্বেও তৃণমূলের এক কর্মী লাইনে দাঁড়িয়ে টাকা দিয়ে ভোটারদের প্রভাবিত করার চেষ্টা করেছিল বলে অভিযোগ তাঁর। এ দিন সকালে বলরামপুরের গাড়াফুসড়ো প্রাথমিক স্কুলের বুথে প্রিসাইডিং অফিসারের অনুমতি ছাড়াই বেশ কয়েক জনকে ভিতরে নিয়ে গিয়ে ভোট দেওয়ার ব্যবস্থা করে দেওয়ার অভিযোগ ওঠে তৃণমূল কর্মীর বিরুদ্ধে। বুথে ঢুকে রাজ্য পুলিশের এক কর্মী তাকে মদত দেন বলেও অভিযোগ। পরে নির্বাচন কমিশন প্রিসাইডিং অফিসারকে সরিয়ে দেয়। বসানো হয় নজরদারি ক্যামেরাও।

সিপিএমের রঘুনাথপুর শহর কমিটির সম্পাদক লোকনাথ হালদারের অভিযোগ, ‘‘কেন্দ্রীয় বাহিনী থাকা সত্ত্বেও রঘুনাথপুর গার্লস হাইস্কুলে তৃণমূলের পুরপ্রধান ভবেশ চট্টোপাধ্যায় ভোটারদের প্রভাবিত করেছেন, এমনকী হুমকিও দিয়েছেন।” ভবেশবাবু অবশ্য বলেন, ‘‘আমি ভোট দিতে গিয়েছিলাম। পুরপ্রধান হিসেবে কয়েক জন কথা বলেছেন। প্রভাবিত করার কোনও প্রশ্নই নেই।’’ পাড়া বিধানসভায় সিপিএমের দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতা তথা দলের জেলা সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য দীননাথ লোধার আবার অভিযোগ, ‘‘কেন্দ্রীয় বাহিনী থাকা সত্ত্বেও শাঁকড়া গ্রামে আমাদের পোলিং এজেন্টকে হুমকি দিয়ে বসিয়ে রেখে বুথ জ্যাম করেছিল তৃণমূলের লোকজন।’’ পাড়া বিধানসভায় শাসকদলের বিরুদ্ধে ১১টি বুথে নানা দুষ্কর্মের অভিযোগ করেছে সিপিএম। যদিও ওই কেন্দ্রের তৃণমূল প্রার্থী উমাপদ বাউরি যদিও বলেন, ‘‘সিপিএমের পায়ের তলা থেকে মাটি সরছে। তাই এ সব ভিত্তিহীন অভিযোগ করছে।’’

পুরুলিয়ার জেলাশাসক তন্ময় চক্রবর্তী বলেন, ‘‘নির্বাচনে কেন্দ্রীয় বাহিনীকে বসিয়ে রাখা নিয়ে কোনও অভিযোগ পাইনি।’’ তিনি জানান, রাজ্য পুলিশের সম্পর্কে যে সব অভিযোগ এসেছে, প্রতিটি ক্ষেত্রেই ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। কিন্তু কেন কেন্দ্রীয় বাহিনী বুথের দেড়শো মিটার জুড়ে টহল দিল না, সে নিয়ে মুখে কুলুপ জেলা প্রশাসনের কর্তাদের।

(সহ-প্রতিবেদন: প্রশান্ত পাল ও সমীর দত্ত)

ছবি:পৌলমী চক্রবর্তী।

assembly election 2016 west bengal purulia election central force
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy