হাবরার সভায় গৌতম দেব। রবিবার নির্মাল্য প্রামাণিকের তোলা ছবি।
মেজাজটাই যে আসল রাজা, ফের বোঝালেন তিনি!
শরীর অসুস্থ! কিন্তু মেজাজটা তো চাঙ্গা! তাই রবি-সন্ধ্যায় হাবরায় জোটপ্রার্থীর সমর্থনে প্রচারে হাজির সিপিএমের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য গৌতম দেব। বুঝিয়ে দিয়ে গেলেন, তিনি এখনও চালিয়ে খেলার লোক!
মঞ্চে তাঁকে দেখা গেল সেই পুরনো আক্রমণাত্মক ভঙ্গিতে। পাক্কা ৪০ মিনিট ধরে তিনি এক দিকে বিজেপিকে বিঁধলেন এই বলে, ‘‘ওরা পাঁচ রাজ্যের ভোটে একটিতেও জিতবে না। বিজেপিতে প্রধানমন্ত্রী ছাড়া কোনও নেতা নেই!’’ অন্য দিকে, সরাসরি বললেন, ‘‘মমতাকে না সরালে রাজ্যের ক্ষতি হয়ে যাবে। তৃণমূল দলটাকে পেট্রল-ওয়াশ করতে হবে। মমতা সত্যি কথা খুব কম বলে। সাধারণত ছেলেরা গুল মারে। মেয়েরা গুল মারে ভাবতে পারি না!’’ জেলা তৃণমূল সভাপতি তথা বিদায়ী মন্ত্রী জ্যোতিপ্রিয় মল্লিককে তিনি ‘পশ্চাৎপক্ক’ বলে কটাক্ষ করেছেন, আবার অনুব্রত মণ্ডলের নাম না করে ‘ষাঁড়’ বলে টিপ্পনী কেটেছেন। এ ভাবেই নানা তির্যক এবং শ্লেষাত্মক মন্তব্যে শ্রোতাদের মাত করেছেন আগের মতোই।
হাবরার জোটপ্রার্থী সিপিএমের আশিসকণ্ঠ মুখোপাধ্যায়ের সমর্থনে এ দিন হিজলপুকুরে জনসভার আয়োজন করা হয়েছিল সন্ধ্যায়।
সাড়ে ৬টা নাগাদ গৌতমবাবুর গাড়ি এসে দাঁড়ায় সভামঞ্চের সামনের রাস্তায়। সেখান থেকে সভামঞ্চের দূরত্ব প্রায় ৩০ মিটার। স্নায়ুর অসুখে যিনি এক রকম ঘরবন্দি, সকাল-বিকেল যাঁর ফিজিওথেরাপি চলছে, এ ঘর থেকে ও ঘর যেতেও মাঝেমধ্যে যাঁর সাহায্যের দরকার হয়— সেই গৌতম দেব ওই রাস্তাটা একাই হেঁটে এলেন। তাঁর এক সঙ্গী গাড়িটিকে ঘুরপথে সভামঞ্চের গায়ে নিয়ে যাওয়ার
ব্যবস্থা করছিলেন। কিন্তু গৌতমবাবু অপেক্ষা করেননি।
পরনে সাদা পাজামা-পাঞ্জাবি, মাথায় টুপি। গৌতমবাবুকে এত দিন বাদে সামনে পেয়ে কর্মী-সমর্থকদের আবেগ বাঁধ মানেনি। তাঁর সঙ্গে হাত মেলাতে এগিয়ে আসেন কর্মীরা। মঞ্চের সিঁড়ি দিয়েও তিনি উঠে পড়েন কারও সাহায্য ছাড়াই!
গৌতমবাবুর জন্য রাখা হয়েছিল কাঠের চেয়ার। সেখানে বসে তিনি ভোট নিয়ে আলোচনা জুড়ে দেন রাজ্যের প্রাক্তন মন্ত্রী মোর্তজা হোসেন, সিপিআইয়ের জেলা সম্পাদক স্বপন বন্দ্যোপাধ্যায় এবং নিজের দলের জেলা সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য বাবুল করের সঙ্গে। লিকার চায়ে চুমুক দেওয়ার সময়েই মঞ্চের নীচ থেকে এগিয়ে আসে শ্রোতাদের হাত। ঝুঁকে পড়ে সেই হাতে হাত মেলাতেও দ্বিধা করেননি তিনি! এমনকী, সামনে একটি শিশুকে চুমুও ছুড়ে দেন।
ঘড়ি ধরে ওষুধ খাওয়ার তালিকাটা তাঁর লম্বা। এমনকী বাচনভঙ্গি ঠিক রাখার জন্যও ওষুধ খেতে হয়। বছর খানেক আগে যখন তাঁকে নিয়মিত সভা-সমাবেশে দেখা যেত, অসুখ শরীরে বাসা বেঁধেছিল তার আগেই। সেই সময় বসে বক্তৃতা করতে দেখা যেত তাঁকে। কিন্ত জোট-জোয়ারে গৌতমবাবু যেন পুরনো শক্তি ফিরে পেয়েছেন! এ দিন দাঁড়িয়েই বলে গিয়েছেন তাঁর কথা। শরীরী-ভাষায় অসুস্থতার কোনও ইঙ্গিতই ফোটেনি। সেই দু’হাত তুলে একের পর এক তির ছুঁড়েছেন বিজেপি-তৃণমূলের দিকে।
প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীকে গুজরাত-দাঙ্গার জন্য কাঠগড়ায় তুলেছেন। তবে, প্রত্যাশিত ভাবে বেশি সময় ব্যয় করেছেন তৃণমূলকে তুলোধোনা করতে। তাঁর তোপ, ‘‘মমতা অসভ্যের মতো স্বৈরাচারী মনোভাব নিয়ে চলেছে। দুনিয়ার সমাজবিরোধীদের একত্রিত করেছে। তাদের মারামারি-কাটাকাটি শেখাচ্ছে।’’ স্মৃতি যে তাঁর এখনও প্রবল, সে ইঙ্গিতও গৌতমবাবু দিয়েছেন মমতার আগে করা ‘শেক্সপিয়রের থেকে রবীন্দ্রনাথের কবিতা লেখার অনুপ্রেরণা’র কথা তুলে বা ‘ডহরবাবু’র প্রসঙ্গ এনে। নাম না করে অনুব্রত মণ্ডলকেই ‘গুড়-বাতাসা’ খাওয়ানোর কথা বলেছেন। তাঁর শ্লেষ, ‘‘বীরভূমে ষাঁড়ের মতো একটা মাথামোটা লোক আছে। সে ঘুরে বেড়াচ্ছে। তা সত্ত্বেও বীরভূমে গণ্ডগোল করতে পারেনি ওরা। ষাঁড় গুঁতো দিয়েও কিছু করতে পারেনি। ওঁকে আমরা বাতাসা-গুড় খাওয়াব।’’
প্রতিটি কথার পরেই প্রবল হাততালি মিলেছে। হাত নেড়েছেন গৌতমবাবু। তার পরে গাড়ি পর্যন্ত একাই হেঁটে গিয়েছেন। সেই দৃপ্ত ভঙ্গিতে। সেই চেনা মেজাজে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy