Advertisement
E-Paper

‘দুষ্টু’ লোকগুলো ভ্যানিশ

চিত্র-১: বেলা ১২টা। মহিষবাথানে সবুজ রং করা একতলা অফিসটার সামনে ঘাসফুল পতাকা উড়ছে। ত্রিসীমানায় খাঁ খাঁ শূন্যতা। তিনি বা তাঁর দলবল, কেউ অফিসে নেই।

শুভাশিস ঘটক ও প্রবাল গঙ্গোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ২৬ এপ্রিল ২০১৬ ০১:৪৮
অফিসে তালা। সোমবার, রাজারহাটে সিন্ডিকেটপাড়া। ছবি: শামসুল হুদা।

অফিসে তালা। সোমবার, রাজারহাটে সিন্ডিকেটপাড়া। ছবি: শামসুল হুদা।

চিত্র-১: বেলা ১২টা। মহিষবাথানে সবুজ রং করা একতলা অফিসটার সামনে ঘাসফুল পতাকা উড়ছে। ত্রিসীমানায় খাঁ খাঁ শূন্যতা। তিনি বা তাঁর দলবল, কেউ অফিসে নেই। কনভয় নিয়ে সেই অফিসের সামনে হাজির কমিশনারেটের পুলিশকর্তা। কিন্তু তার আগেই ‘ভ্যানিশ’ মহিষবাথানের সিন্ডিকেট-চাঁই সমীর ওরফে ভজাই সর্দার।

চিত্র-২: বিষ্ণুপুর কুমোরঘাঁটির তৃণমূল কংগ্রেস পার্টি অফিস তালাবন্ধ। ২০০ মিটারের মধ্যে কোনও বুথ নেই। তা সত্ত্বেও সেই অফিসের তালা খোলার সাহস করেননি স্থানীয় নেতৃত্ব। লোক জমা করা তো দূরের কথা। ওই এলাকা আর এক সিন্ডিকেট মাফিয়া গফ্ফর মোল্লা ওরফে মাটি গফ্ফরের সাম্রাজ্য। রবিবার থেকে ‘ভ্যানিশ’ তিনিও।

চিত্র-৩: যাত্রাগাছির মোড়ে নবদিশা সিন্ডিকেটের অফিসে তালা ঝুলছে। প্রতিদিন যেখানে বাইকবাহিনীর জমায়েত হয়, সোমবার দুপুরে সেখানে বাইক তো দূর, একখানা ভাঙা সাইকেল পর্যন্ত নজরে এল না। সেই সিন্ডিকেট নেতা সইফুল ইসলাম রবিবার থেকেই ‘ভ্যানিশ’।

নিউ টাউনে সিন্ডিকেট-চাঁই হিসেবে পরিচিত এই ভজাই, মাটি গফ্ফর, মিনি গফফর, সইফুল ইসলামেরা। তবে স্থানীয় তৃণমূল প্রার্থী সব্যসাচী দত্তের কাছে তাঁরা সকলেই ভোট বৈতরণী পারাপারের ‘মসিহা’। প্রকাশ্যে একাধিক বার সব্যসাচীবাবু ঘোষণা করেছেন, এই সিন্ডিকেট নেতারাই তাঁকে ভোটে জেতাবেন।

ঘটনাচক্রে সেই সিন্ডিকেট নেতাদের এ বার বিধানসভা নির্বাচনে ‘দুষ্টু’ লোকের তালিকায় ফেলেছিল নির্বাচন কমিশন। তাই ভোটের দিনে সেই ‘দুষ্টু’ লোকেদের নিজেদের এলাকার ত্রিসীমানায় ঘেঁষতে দিল না পুলিশ। নিউ টাউন বিধানসভার ভোটারেরা ভোটের দিনে তাদের ভ্যানিশ হয়ে যেতেই দেখলেন।

গত সেপ্টেম্বরে বিধাননগর পুর-নিগমের যে ২৭টি ওয়ার্ডে ভোট হয়েছিল, সেগুলি সম্মিলিত ভাবে রাজারহাট-নিউ টাউন এবং রাজারহাট-গোপালপুর বিধানসভা কেন্দ্রের মধ্যে পড়ে। সব ক’টি জায়গাতেই সে বার ভোট লুঠ করেছিল সিন্ডিকেট মাফিয়া ও গুন্ডা বাহিনী। আর শাসক দলের চাপে পড়ে কার্যত তা দাঁড়িয়ে দেখতে বাধ্য হয়েছিলেন বিধাননগরের পুলিশকর্তারা। কিন্তু এ বার নির্বাচন কমিশনের অধীনে ভোট হওয়ায় পুলিশ তার ক্ষমতা জানান দিতে পিছপা হয়নি। লাঠির ডগায় রেখে দলবল-সহ সিন্ডিকেট চাঁইদের রবিবার রাতের মধ্যেই এলাকা ছাড়া করে দেয় তারা। গ্রেফতার করে এলাকার কয়েক জন ছুটকো-ছাটকা দাদাদেরও। যে এলাকায় যার আধিপত্য, সেখানে কেন্দ্রীয় বাহিনী পাঠিয়ে আর তার বাড়ির সামনে পুলিশের টহলদারি বাড়িয়ে চাঁইদের ঘরে বসিয়ে দেওয়া হয়েছে। নয়তো এলাকা ছাড়া করে দিয়েছে প্রশাসন।

যার নমুনা সোমবার সারা দিন দেখা গিয়েছে নিউ টাউনের বিভিন্ন বুথ এলাকায়। পঞ্চায়েত হোক বা পুর নিগম এলাকা, জটলা দেখলেই ধেয়ে গিয়েছে পুলিশ। ভয় দেখাতে এলে শাসক দলের লোকজনকে তুলে নিয়েছে পুলিশের গাড়ি। পরিণাম, সারা দিনে আর এলাকায় দেখা মেলেনি টুটুন গাজি, মাটি গফ্ফর, মিনি গফ্ফরদের। ফলে তাদের লোকজনও আর রিগিং-সন্ত্রাস করার মতো কোমরের জোর পায়নি। নির্বিঘ্নে সকাল থেকেই ভোটের লাইনে মানুষের ঢল দেখা গিয়েছে। বিশেষ কোনও অভিযোগও তুলতে শোনা যায়নি বিরোধীদের।

সকালে মহিষগোঠ এলাকায় ভজাই সর্দারের বাহিনী দলীয় এজেন্টদের ভয় দেখাচ্ছে বলে অভিযোগ করেছিল সিপিএম। খবর পেয়ে ঘটনাস্থলে পৌঁছে নিউ টাউন থানার পুলিশ বেধড়ক পিটিয়ে পাঁচ জনকে গ্রেফতার করে। নির্দল প্রার্থী হলেও ভজাই সর্দার আসলে সব্যসাচীবাবুর ছায়াপ্রার্থী, এলাকার লোকজনই জানিয়েছেন তা। আফশোস করতে করতে মহিষগোঠে তৃণমূলের দলীয় কার্যালয়ে বসে কয়েক জন কর্মীর আক্ষেপ, ‘‘অতি মাত্রায় সক্রিয়তা দেখাচ্ছে পুলিশ। এত বছর ভোট করছি। এমন দেখিনি। পাড়ার চায়ের দোকানটাও বন্ধ করে দিয়েছে। যাতে সেখানে চা খেতে এসেও লোকজনের জটলা না জমে। একেবারে দমবন্ধ করা অবস্থা করে রেখেছে।’’

নারায়ণপুর এলাকায় পাঁচটি ওয়ার্ডে পুর-ভোটে বিরোধীদের ‘ভুতুড়ে’ ব্যবধানে হারিয়ে ছিল শাসকদল। সেই জয়ের নায়ক সব্যসাচীবাবুর ঘনিষ্ঠ শাহনওয়াজ আলি মণ্ডল ওরফে ডাম্পি। এজেন্ট সেজে বুথে ঢোকার চেষ্টা করেছিল তার লোকজন। কিন্তু বিমানবন্দর থানা আটক করে নিয়ে যায় তাদের। ধৃতদের কাছ থেকে এক গোছা ভোটার স্লিপ উদ্ধার হয়েছে বলে জানিয়েছে পুলিশ। রবিবার রাতেই দুষ্টু নামে এক তৃণমূলের দাদাকে গ্রেফতার করে বাগুইআটি থানা। এলাকা ছাড়া করে দেওয়া হয় নারায়ণপুরের এই মুহূর্তের ত্রাস রাজু পালকে। তাই দোর্দণ্ডপ্রতাপ ডাম্পির গলাতেও বিষাদের সুর, ‘‘কেন্দ্রীয় বাহিনী যা করল, তাতে সাধারণ মানুষ বুথে যেতে ভয় পাবে। পুলিশও এ দিন কোনও কথা শুনতে চায়নি। তা সত্ত্বেও বলছি আমার জায়গা থেকে সাত হাজার ভোটের লিড দেব।’’ এক পুলিশকর্তার কথায়, ‘‘ওই এলাকায় শাসক দলের পক্ষে সাত হাজার ভোটও পড়েছে কি না সন্দেহ। ব্যবধান তো দূর অস্ত্‌।’’ ওই কর্তার ব্যাখ্যা, ‘‘সকাল থেকে মানুষের ভোট দেওয়ার ইচ্ছেটা লক্ষ করেছি। পুর-নির্বাচনে ভোট দিতে পারেননি সাধারণ মানুষ। এ বার মানুষ সকাল থেকে ভোট দিয়ে তা বুঝিয়ে দিয়েছেন। এমনকী কোথায় দিয়েছে, অধিকাংশ তা-ও বলে গিয়েছেন আমাদের।’’

আর সেই ছক যে কাজে লেগেছে, তার নমুনা পাওয়া গেল টিসিএস ব্রিজের কাছে এক পুলিশকর্তার সঙ্গে কথা বলার সময়ে। ফোনে তাঁকে কেউ বললেন, ‘‘স্যার আমাদের চেনা লোকেরাও ভোট দিতে পারছে না। সেটুকু তো করতে দিন।’’ হাসতে হাসতে সেই কর্তার জবাব, ‘‘আর কী হবে ভোট দিয়ে? যেখানে আছ, সেখানেই ভ্যানিশ হয়ে থাকো। গত পুরভোটে এত ভোট দিয়েছ এক-এক জন, আগামী ১০ বছর ভোট না দিলেও চলবে।’’ শুধু প্রার্থীর ভোট ম্যানেজারেরা নন, খোদ শাসক দলের হেভিওয়েট প্রার্থী সব্যসাচী দত্তকেও ছাড় দেয়নি পুলিশ ও কেন্দ্রীয় বাহিনী। বিকেলে যাত্রাগাছির একটি বুথের কাছে নিজের ছেলেদের নিয়ে গিয়েছিলেন প্রার্থী। পথ আগলে দাঁড়িয়েছিল কেন্দ্রীয় বাহিনীর জওয়ান ও পুলিশ। সব্যসাচীবাবুও কেন্দ্রীয় বাহিনীর জওয়ানদের হুমকি দিয়েছেন বলে অভিযোগ। পরে পুলিশ ও কেন্দ্রীয় বাহিনীর জওয়ানেরা সব্যসাচীবাবুকে বুথ থেকে বার করে দেন। এত সত্ত্বেও সব্যসাচীবাবু অবশ্য জয়ের ব্যাপারে আশাবাদী। তিনি বলেন, ‘‘জয়ের ব্যবধান ২০ হাজারের কম হলে বুঝব আমি জিতিইনি।’’

‘দুষ্টু’ লোকগুলো ভ্যানিশ হয়েই রইল আজ সারা দিন।

assembly election 2016 criminals
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy