Advertisement
E-Paper

কোন্দল আছেই, দীপালির ভরসা অঙ্ক

এখানে বিরোধী কেউ নেই। গত পাঁচ বছর ধরে রাজনৈতিক বিরোধিতা কাকে বলে, তা প্রায় ভুলতে বসেছে সোনামুখী। সোনামুখীর জনশ্রুতি, এ দলের শত্রু যদি কেউ থেকেও থাকে, তা বাইরে নয়, আছে সে দলের অন্দরেই। সাধে কী আর ভোটের মুখে দলনেত্রীকে সভা করে বলতে হয়, আর কাউকে নয়, তাঁকে দেখেই যেন জনতা ভোট দেয়! দলটার নাম যে তৃণমূল, সেটা বলে দেওয়ার জন্য কোনও পুরস্কার নেই।

স্বপন বন্দ্যোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ০৬ এপ্রিল ২০১৬ ০১:৫৯
দীপালির মনোনয়নের দিন পাশে ছিলেন দলের নেতা সুরজিৎ মুখোপাধ্যায়। ভোটযুদ্ধে থাকছেন কি, প্রশ্ন নিচুতলাতেই।—নিজস্ব চিত্র

দীপালির মনোনয়নের দিন পাশে ছিলেন দলের নেতা সুরজিৎ মুখোপাধ্যায়। ভোটযুদ্ধে থাকছেন কি, প্রশ্ন নিচুতলাতেই।—নিজস্ব চিত্র

এখানে বিরোধী কেউ নেই। গত পাঁচ বছর ধরে রাজনৈতিক বিরোধিতা কাকে বলে, তা প্রায় ভুলতে বসেছে সোনামুখী।

সোনামুখীর জনশ্রুতি, এ দলের শত্রু যদি কেউ থেকেও থাকে, তা বাইরে নয়, আছে সে দলের অন্দরেই।

সাধে কী আর ভোটের মুখে দলনেত্রীকে সভা করে বলতে হয়, আর কাউকে নয়, তাঁকে দেখেই যেন জনতা ভোট দেয়!

দলটার নাম যে তৃণমূল, সেটা বলে দেওয়ার জন্য কোনও পুরস্কার নেই। সোনামুখীতে তাই তৃণমূলের লড়াই যত না বাম-কংগ্রেস জোট বা বিজেপির সঙ্গে, তার চেয়েও বেশি বোধহয় নিজের সঙ্গেই।

তার একটা কারণ যদি হয় গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব, অন্যটি অবশ্যই সোনামুখীর বিদায়ী বিধায়ক, এ বারের প্রার্থী দীপালি সাহা। ২০১১ সালে প্রথম বার বিধায়ক হওয়ার পর থেকেই যাঁর নামের সঙ্গে জুড়ে রয়েছে নানা বিতর্ক।

সে গত লোকসভা নির্বাচনে প্রিসাইডিং অফিসারকে মারধর করে ছাপ্পা ভোট দেওয়া ও বুথ দখলের অভিযোগই হোক, কিংবা গত বছর পুরভোটের সময় থানায় বিক্ষোভ দেখিয়ে পুলিশকর্মীদের উদ্দেশে শাসানি।

অথচ ভোটের পাটিগণিতের হিসাবে পঞ্চায়েত থেকে লোকসভা হয়ে পুরসভা নির্বাচন—সব ক্ষেত্রেই প্রধান প্রতিপক্ষ বামপন্থীদের অনেকটা পিছনে ফেলে দিয়েছে তৃণমূল। পুরসভা, পঞ্চায়েত সমিতি, এলাকার ভিতরে থাকা বিষ্ণুপুর লোকসভা কেন্দ্র সবই রয়েছে তৃণমূলের দখলে। তা সত্ত্বেও এ বার বিধানসভা ভোটের আগে তাঁরা যে খুব স্বস্তিতে নেই, তা আড়ালে মানছেন সোনামুখীর অনেক তৃণমূল নেতা-কর্মীই।

তাঁদের কথায়, একে তো বারবার অবাঞ্ছিত বিতর্কে জড়িয়ে দলকে বিড়ম্বনার মুখে ফেলেছেন দীপালিদেবী। এর সঙ্গে রয়েছে, দলেরই পুরপ্রধান সুরজিৎ মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে দীপালি-গোষ্ঠীর চিরকালীন লড়াই। যা বারবার প্রকাশ্যে এসেছে নানা চেহারায়।

ঘটনাচক্রে এ দিনই সিপিএমের রাজ্য সম্পাদক সূর্যকান্ত মিশ্র সোনামুখীতে সভা করতে এসে বলেন, ‘‘তৃণমূলে এতই গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব যে দলনেত্রীকে বলতে হচ্ছে, একে ভোটে দেবেন না, ওকে দেবেন না, আমাকেই ভোটটা দেবেন। সারা রাজ্যের সব আসনে যেন তিনি একাই লড়ছেন!’’

তৃণমূলের এই কাঁটা দু’টিকে কাজে লাগিয়ে জোর কদমে দীপালির বিরুদ্ধে প্রচারে নেমেছেন বাম-কংগ্রেসের জোট প্রার্থী সিপিএমের অজিত রায়। প্রচারে নিয়ে আসছেন বাইপাস, বাসস্ট্যান্ড, স্টেডিয়াম, দমকল, ১০০ বেডের হাসপাতাল ইত্যাদি না পাওয়ার প্রসঙ্গও। সিপিএমের কর্মীরাও গ্রামে গ্রামে প্রচারে এই বিষয়গুলিকে ভোটারদের সামনে নিয়ে যাচ্ছেন।

এলাকার বাসিন্দা সিপিএমের জেলা কমিটির সদস্য সুব্রত মুখোপাধ্যায় কিছুটা খুশির সঙ্গে দাবি করছেন, ‘‘এ বার দীপালির সঙ্গে আমাদের লড়াইটা অনেক সহজ হয়ে গিয়েছে। কারণ, সবাই জানেন একজন বিধায়ক হয়েও গত লোকসভা নির্বাচনে যে ভাবে প্রিসাইডিং অফিসার-সহ ভোটকর্মীদের মারধর করে ভোট লুঠে তাঁর নাম জড়াল তাতে আখেরে তাঁর ভাবমূর্তির ক্ষতি হয়েছে। তিনি আর যেই হোন জনপ্রতিনিধি হওয়ার যোগ্য নন। ব্যাপারটা তাঁর বিরুদ্ধ গোষ্ঠীর লোকেরাও ভাল ভাবে নেয়নি। এলাকার নানা অনুন্নয়নের ক্ষোভের সঙ্গে এটাও আমাদের কাছে প্লাস পয়েন্ট হয়ে উঠেছে।’’

বাম-কংগ্রেস জোট প্রার্থী করেছে সিপিএমের একেবারে গ্রাম স্তরের নেতা অজিত রায়কে। যিনি এ যাবৎ ভোটে লড়েছেন শুধু পঞ্চায়েতেই। ১৯৯৩ থেকে পাঁচ বছর ছিলেন সোনামুখীর পাঁচাল গ্রাম পঞ্চায়েতের সদস্য। ১৯৯৮ সালে সোনামুখী পঞ্চায়েত সমিতির বনভূমি কর্মাধ্যক্ষ হন।

সিপিএমের কৃষক সমিতির জেলা সম্পাদক মণ্ডলীর সদস্য অজিতবাবু পথে প্রচারে প্রশ্ন ছুঁড়ছেন— ‘‘গতবার ভোটের আগে দীপালিদেবী যে সব প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন সেগুলির কী হল? না হয়েছে বাসস্ট্যান্ড, বাইপাস, স্টেডিয়াম, দমকল, মডেল স্কুল। বলেছিলেন পাত্রসায়র ব্লকের হামিরপুর-নারায়ণপুর গ্রামে শালী নদীর উপর সেতু হবে। কিচ্ছু হয়নি। সারা জেলায় নানা জল প্রকল্পের কাজ হল। এখানে কিছুই হল না।’’

তাঁর দাবি, প্রতিশ্রুতি ভঙ্গের জন্য মানুষ তৃণমূলের দিক থেকে মুখ ঘুরিয়ে নিয়ে তাঁকেই ভোটটা দেবেন।

বস্তুত তা যে একেবারেই ঠিক নয়, তেমনটা নয়। বিষ্ণুপুর-সোনামুখী বাস রাস্তার পাশেই কল্যাণপুর। নিজের জমিতে কাজ করছিলেন এক চাষি। অনুযোগের সুরে তিনি বলেন, ‘‘প্রতি বছর হাতির দল ফসলের ক্ষতি করছে, মানুষ মারছে, ঘরবাড়ি ভাঙছে। কিন্তু ঘটনার পরে বিধায়ককে খুব কম সময়েই আমরা কাছে পেয়েছি।’’

সোনামুখীর শহরের কোনও কোনও বাসিন্দার মুখেও এও শোনা যাচ্ছে, দীপালিদেবী তিনবারের কাউন্সিলর। গতবারের বিধায়ক। কিন্তু প্রাপ্তি বলতে চোখে পড়েছে, সোনামুখী-বড়জোড়া রোডের শালী নদীর সেতু উঁচু হচ্ছে। আর কিছুই তো দেখা যাচ্ছে না। বাসস্ট্যান্ড না হওয়ায় যানজটে এখনও মানুষ নাকাল হচ্ছেন।

দীপালিদেবী অবশ্য দাবি করছেন, ‘‘সিপিএম একটানা ৩৪ বছর কাটিয়ে সোনামুখীকে কী দিয়েছে? আমরা কাজ শুরু করেছি। এ বার ভোটে জিতে সে সব কাজ শেষ করব।’’ গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব থেকে তাঁর বিরুদ্ধে ওঠা যাবতীয় বিতর্কের কথা তিনি উড়িয়ে দিয়েছেন। দীপালিদেবীর দাবি, দলে দ্বন্দ্ব নেই। ও সব সংবাদমাধ্যমের বানানো। ভোট লুঠ-ঠুটও মিথ্যা রটনা।’’

তিনি এ কথা বললেও তৃণমূল সূত্রেই খবর, দীপালিদেবীর মনোনয়নের সময় পুরপ্রধান সুরজিৎ মুখোপাধ্যায় থাকলেও প্রচারে তাঁকে সে ভাবে দেখা যাচ্ছে না। এমনকী সুরজিৎ অনুগামীদেরও দেখা যাচ্ছে না দীপালিদেবীর ভোট প্রচারে। যদিও এ নিয়ে একটি কথাও বলতে চাননি সুরজিৎবাবু।

তবে দীপালিদেবীর ঘনিষ্ঠেরা দাবি করছেন, তাঁরা জয়ের ব্যাপারে ১০০ শতাংশ আশাবাদী। কারণ গত বিধানসভা ভোটে দীপালিদেবী বাম প্রার্থীর তুলনায় ৭,২৮৯ ভোটে জিতেছিলেন। ২০১৪ লোকসভা ভোটে এই কেন্দ্রে সেই ব্যবধান বেড়ে দাঁড়ায় ১০,৮৭৩। কংগ্রেসের সঙ্গে বামেদের ভোট প্রাপ্তি জুড়লেও এগিয়ে রয়েছে তৃণমূলই।

বিধানসভা ভোটের তুলনায় লোকসভায় এই কেন্দ্রে বিজেপি প্রায় ১০ শতাংশ বেশি ভোট পেয়েছিল। এ বার তাদের প্রার্থী কলকাতার বাসিন্দা দেবযানী রায় কর্মীদের নিয়ে সোনামুখীর গাঁয়ে-গঞ্জে ঘুরছেন। তিনি পার্ক স্ট্রিট ধর্ষণ-কাণ্ড নিয়ে ছবিও করেছেন। তিনি বলছেন, ‘‘যেখানেই যাচ্ছি অনুন্নয়ন নিয়ে ক্ষোভের কথাই শুধু শুনছি। সেই ক্ষোভ আমাদের ভোট বাক্সে পড়বে।’’

সোনামুখীর চষা জমি থেকে সবাই সোনার ফসল ঘরে তোলার দাবিদার। শাসকদলে দ্বন্দ্ব, বিতর্ক যাই থাক, বিরোধীদের মূল লড়াই কিন্তু ভোটের অঙ্কের সঙ্গেই।

assembly election 2016 Dipali Saha Trinamool Congress tmc Sonamukhi statistics
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy