এক শিবিরের দুই নেতানেত্রী কোন্দল ভুলে ঘর গুছিয়ে নিয়েছেন। অন্য শিবিরের একদা যুযুধান দুই নেতা দাবি করছেন, কই গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব তো এখানে নেই!
প্রথম পক্ষের দু’জন হলেন সিপিএম প্রার্থী সত্যসেবী কর এবং শর্মিষ্ঠা দত্ত। অন্য দিকে, তৃণমূলের আছেন ধীমান রায় ও সমীর দত্ত। অশোকনগরের ভোট-অঙ্ক নির্ধারণে বাম ও তৃণমূল প্রার্থী সত্যসেবী কর ও ধীমান রায়ের ভাগ্য নির্ধারণে দুই ‘দত্ত’র ভূমিকার কথা ভাসে অশোকনগরের বাতাসে।
সত্যসেবীবাবু গত ভোটে দাঁড়িয়ে ধীমান রায়ের কাছে হেরেছিলেন প্রায় আঠাশ হাজার ভোটে। এ বারও ফের মুখোমুখি তাঁরা। জেলা রাজনীতিতে এক সময়ে প্রয়াত ক্রীড়ামন্ত্রী সুভাষ চক্রবর্তীর স্নেহধন্য ছিলেন দীর্ঘদিনের জনপ্রিয় বাম বিধায়ক ননী করের পুত্র সত্যসেবী।
কিন্তু সুভাষবাবুর নেকনজরে থাকায় আর এক প্রয়াত সিপিএম নেতা নন্দীর অমিতাভ নন্দীর চক্ষুশূল হয়ে ওঠেন। যার ফলে নন্দী-ঘনিষ্ঠ বলে পরিচিত অশোকনগরের প্রাক্তন পুরপ্রধান শর্মিষ্ঠা দত্তের সঙ্গে তাঁর সম্পর্কের ‘ছত্তিশ কা আঁকড়া’ অশোকনগরের মানুষের বিলক্ষণ জানা। একে অন্যের সঙ্গে বাক্যালাপ কার্যত বন্ধ ছিল বহু দিন। পুরসভার তরফে তৎকালীন স্থানীয় বিধায়ক সত্যসেবীবাবুকে সব অনুষ্ঠান, সভা-সমিতিতে ডাকাই হতো না।
এ হেন দুই নেতানেত্রীকে এ বার মিলিয়ে দিয়েছে জোটের আবহ। সত্যসেবীবাবু পুরনো কথা তুলতেই চাইলেন না। প্রবীণ বামপন্থী নেতার সংক্ষিপ্ত মন্তব্য, ‘‘আমরা প্রচারে সকলকে পাশে পেয়ে উজ্জীবিত।’’ আর শর্মিষ্ঠাদেবীর কথায়, ‘‘বিশ্বাস করুন, সমস্ত শক্তি দিয়ে নেমেছি।’’ তার প্রমাণও পাচ্ছেন অশোকনগরের মানুষ। বাম-কংগ্রেস জোটের বড় বড় র্যালি হতে দেখছেন তাঁরা। ছোট-বড় সভাও হচ্ছে নিয়মিত। বিরোধী শিবির যখন এতটা এককাট্টা, তখন কী অবস্থা ঘাসফুলের বাগানে? স্থানীয় নেতাদের দাবি, সব কিছু ঠিকঠাকই চলছিল। মাঝে সুর কাটলেন দিদিমনি নিজেই। ক’দিন আগে বনগাঁর সভায় এসে দলনেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় উপ পুরপ্রধান সমীর দত্তের নাম করে মঞ্চ থেকে জানতে চান, ‘‘কোথায় সমীর, ঝগড়া করছে না তো?’’ হাল্কা চালে তাঁর এই মন্তব্যেই অস্বস্তি দানা বেঁধেছে।
ধীমানবাবুর সঙ্গে সমীরবাবুর পুরনো আকচাআকচি কারও অজানা নয়। কালীঘাটের বাড়িতে ভোটের আগে জেলা নেতাদের সঙ্গে বৈঠকে বিষয়টি উঠেছিল মমতার সামনেই। দলের একটি সূত্র জানাচ্ছে, সেখানে তিনি ধমক দেন সমীরবাবুকে। তারপরে বিষয়টি ধামাচাপা পড়ে গিয়েছিল। ফের খুঁচিয়ে উঠেছে মমতার মন্তব্যে।
অশোকনগর-কল্যাণগড় পুরসভার চেয়ারম্যান সমীর দত্তকে পুরভোটের পরে সরিয়ে ওই পদে বসানো হয় ধীমানবাবুর ছায়াসঙ্গী প্রবোধ সরকারকে। ভোট সামলাতে কোমর বেঁধে নেমে পড়েছেন প্রবোধবাবুও। সমীরবাবুরও দাবি, ‘রক্ত জল করে’ প্রচার চালাচ্ছেন তিনিও। বললেন, ‘‘মনোনয়নের দিন থেকে শুরু করে আমি প্রার্থীকে নিয়ে রোড-শো, মিটিং, মিছিল করছি। বিরোধিতার কোনও প্রশ্নই নেই।’’
এটা ঠিক, যে ধীমানবাবুর সঙ্গে দেখাও যাচ্ছে তাঁকে। তবে অশোকনগরের এক ব্যবসায়ীর কথায়, ‘‘সকলের আন্তরিক ভাবে গা ঘামানোটা জরুরি। কারণ, এ বার টক্করটা কিন্তু বেশ শক্ত।’’ অশোকনগর বিধানসভার অধীনে একটি অশোকনগর-কল্যাণগড় পুরসভা ছাড়াও আছে ৮টি পঞ্চায়েত রয়েছে। পুরসভার ২৩টি আসনের মধ্যে তৃণমূলের হাতে আছে ১৮টি ওয়ার্ড। বামেদের দখলে ৫টি। পঞ্চায়েতগুলির মধ্যে একটি বাদে সব ক’টিই তৃণমূলের দখলে।
সব মিলিয়ে এককালের উদ্বাস্তু-প্রধান এলাকা অশোকনগর হালফিলে তৃণমূলের সাজানো বাগান। কী ভাবে জমি তৈরি করছেন? উত্তরে সত্যসেবীবাবু জানান, জোট একটা বড় ব্যাপার। তা ছাড়া, সারদা, নারদ কেলেঙ্কারিতে মুখ পুড়েছে শাসক দলের। উড়ালপুল কাণ্ডেও তারা ব্যাকফুটে। সত্যসেবীবাবু বলেন, ‘‘অশোকনগরের শিক্ষিত সমাজ আশা করছি এ সব নিয়ে ওয়াকিবহাল।’’
এর উল্টো পিঠে নিজের বিধায়ক ভাতায় গত পাঁচ বছরে অশোকনগরে উন্নয়নের পুস্তিকা দেখান ধীমানবাবু। ‘কল্যাণী স্পিনিং মিল’-এর মতো বন্ধ কারখানার কর্মীদের বিকল্প কাজের ব্যবস্থা থেকে শুরু করে রাস্তা, আলো, বিদ্যালয় উন্নয়নের কথা তুলে ধরেন তিনি।
স্কুলে পড়ার সময় থেকেই ঘোরতর বামবিদ্বেষী ধীমানবাবু সাদা জামা দিয়ে দেওয়ালের কাস্তে-হাতুড়ি-তারা মুছে বড়দের কাছে কানমলা খেয়েছিলেন। ঘটনাচক্রে তিনিই অশোকনগরে বামেদের দীর্ঘদিনের মৌরুসিপাট্টা মুছে দেন ২০১১ সালে। সেই আত্মবিশ্বাসটা এখনও আছে চোখেমুখে। বললেন, ‘‘কোনও গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব নেই। আমরা যথেষ্ট আশাবাদী।’’এর আগে ২০০১ সালে তৃণমূলের হাত ধরে এখানকার চিরাচরিত বাম দুর্গে ফাটল ধরিয়েছিল বিজেপি। উপনির্বাচনে জয়ী হন বিজেপির বাদল ভট্টাচার্য। সেটাই ছিল এ রাজ্যে বিজেপির প্রথম বিধানসভা আসন। সেই জনভিত্তি কিছুটা হলেও অটুট আছে। যে কারণে ভাল ফল আশা করছেন বিজেপি প্রার্থী তনুজা চক্রবর্তীও।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy