Advertisement
E-Paper

রবিদা তৃণমূলে! মন মানে না জঙ্গলের

বিরোধী-কাঁটা এক রকম। কিন্তু, নিজের দলেরই কাঁটা ফুটলে বড্ড লাগে। একটু বেশিই লাগে! নানুরে সে কাঁটা টের পেয়েছিলেন তৃণমূল প্রার্থী গদাধর হাজরা। কাঁটার নাম কাজল শেখ।

দেবারতি সিংহচৌধুরী

শেষ আপডেট: ২২ এপ্রিল ২০১৬ ০৩:৩৩
সাহায্যের হাত। পূর্বস্থলী দক্ষিণ কেন্দ্রের তৃণমূল প্রার্থী স্বপন দেবনাথ। (ডান দিকে) চায়ে চুমুক দিচ্ছেন কাটোয়ার তৃণমূল প্রার্থী রবীন্দ্রনাথ চট্টোপাধ্যায়।

সাহায্যের হাত। পূর্বস্থলী দক্ষিণ কেন্দ্রের তৃণমূল প্রার্থী স্বপন দেবনাথ। (ডান দিকে) চায়ে চুমুক দিচ্ছেন কাটোয়ার তৃণমূল প্রার্থী রবীন্দ্রনাথ চট্টোপাধ্যায়।

বিরোধী-কাঁটা এক রকম। কিন্তু, নিজের দলেরই কাঁটা ফুটলে বড্ড লাগে। একটু বেশিই লাগে!

নানুরে সে কাঁটা টের পেয়েছিলেন তৃণমূল প্রার্থী গদাধর হাজরা। কাঁটার নাম কাজল শেখ। নানুর থেকে অজয় পেরিয়ে বর্ধমানের যে তল্লাট, সেই কাটোয়ায় একই কাঁটা বিঁধল তৃণমূল প্রার্থী রবীন্দ্রনাথ চট্টোপাধ্যায়ের গায়ে। এ কাঁটার নাম জঙ্গল শেখ।

১৭ তারিখ বীরভূমের ভোটে নানুরের ৫০টিরও বেশি বুথে দলেরই এজেন্ট বসতে দেননি এলাকার তৃণমূল নেতা কাজল। সেই ৫০ বুথের ভোটে হেরেও যেতে পারেন, গদাধর— জেলা তৃণমূলে এমন উদ্বেগ শোনা যাচ্ছে। কাজল পণ করেছিলেন গদাধরকে জিততে দেবেন না। কাটোয়া পুরসভার তৃণমূল কাউন্সিলর জঙ্গলেরও শপথ, দলের প্রার্থী রবীন্দ্রনাথবাবুকে ময়দান সহজে ছেড়ে দেওয়া হবে না। ফলে নানুরে যা হয়েছিল, বৃহস্পতিবার তৃতীয় দফার ভোটে তারই যেন প্রতিচ্ছবি কাটোয়ায়। দলবল নিয়ে তিনটি বুথ দখল করে রবিবাবুর অনুগামীদের মারধর করে, হুমকি দিয়ে কংগ্রেসের নামে ‘ছাপ্পা’ দেওয়ার অভিযোগ উঠল জঙ্গলের নামে।

একটু পিছিয়ে যাওয়া যাক। গত বছর এপ্রিলে পুরভোটের দিন কাটোয়া রণক্ষেত্র কংগ্রেস-তৃণমূল সংঘর্ষে। গুলিবিদ্ধ হন এক কংগ্রেসকর্মী। তারই বদলায় কাটোয়ার ‘ত্রাস’ জঙ্গলের এক অনুগামীকে খুন করার অভিযোগ ওঠে বিধায়ক রবিবাবু-সহ কিছু কংগ্রেস কর্মীর বিরুদ্ধে। বলা হয়, জঙ্গল-ত্রাস থেকে নিষ্কৃতি পেতেই নাকি পুরভোটের পরে কংগ্রেস ছেড়ে তৃণমূলে যান কাটোয়ার দু’দশকের বিধায়ক রবিবাবু। তৃণমূল সূত্রের খবর, তখন থেকেই জঙ্গলের চক্ষুশূল বিদায়ী বিধায়ক। এ বার তাঁর জয় যাতে মসৃণ না হয়, সে বন্দোবস্ত আগাম করে রেখেছিলেন জঙ্গল। প্রচারের শুরু থেকেই জঙ্গল রবীন্দ্রনাথবাবুর বিরুদ্ধাচারণ করছে জেনেও তাঁকে সতর্ক করার বদলে প্রচ্ছন্ন মদতের অভিযোগ আছে তৃণমূলের বর্ধমান (গ্রামীণ) জেলা সভাপতি স্বপন দেবনাথের বিরুদ্ধেও। এ দিনও রবি-বিরোধিতায় জঙ্গলকে স্বপনবাবু ‘সঙ্গত’ দিয়েছেন বলে অভিযোগ পৌঁছেছে দলের শীর্ষ নেতৃত্বের কাছে।

সকাল সওয়া দশটা। দলের এক শীর্ষ নেতা জানতে পারেন, কাটোয়ার ১৩ ও ১৯ নম্বর ওয়ার্ডের তিনটি বুথে তৃণমূলের এজেন্ট সরিয়ে জঙ্গল ভোট-লুঠ করছেন। বুথের লাইনে দাঁড়িয়ে ‘হাত’ চিহ্নে ভোট দেওয়ার জন্য ভোটারদের চাপ দিচ্ছেন। এই অভিযোগ শুনেও স্বপনবাবু পুলিশকে নীরব থাকার নির্দেশ দিয়েছেন, জেলারই এক পুলিশকর্তার থেকে তা জানতে পেরে ওই শীর্ষ নেতা স্বপনবাবুকে ফোন করে সতর্ক করেন। ভোট মিটতেই স্বপনবাবুর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার হুঁশিয়ারিও তিনি দিয়েছেন বলে দলীয় সূত্রের খবর।

পুলিশকেও জঙ্গলের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে বলা হয়। পুলিশ সক্রিয় হয়ে জঙ্গল ও তাঁর দলবলকে সরিয়ে দেয়। জঙ্গল দমে গেলেও স্বপনবাবু শেষ চেষ্টা করতে কসুর করেননি। পূর্বস্থলীর হেমায়েতপুরের কার্যালয়ে জেলার অতিরিক্ত পুলিশ সুপারকে ফোনে ধরার নির্দেশ দেন। দেহরক্ষী ফোন ধরালে স্বপনবাবু তাঁকে বলেন, ‘‘কাটোয়ার জঙ্গল তো আমাদের দলের কাউন্সিলর। সে বুথে যেতে পারবে না কেন? পুলিশ লাঠি হাতে তেড়ে যাচ্ছে কেন? আপনি দেখুন।’’ স্বপনবাবুর কথাতেও অবশ্য কাজ হয়নি।

ভোট শুরুর পরে ঘণ্টাখানেক রয়্যাল এনফিল্ডে নিজের ১৩ নম্বর ওয়ার্ডের কেশিয়া, পাহাড়পুরের বুথে বুথে অবাধে ঘুরে বেরিয়েছেন জঙ্গল। কিন্তু, তৃণমূল হাইকমান্ড থেকে ‘সবুজ সঙ্কেত’ পেয়ে তাঁর নামে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি হতেই পলাতক জঙ্গল। দিনভর পুলিশ তাঁকে পায়নি। পুলিশের ভয়েই কেশিয়ায় প্রাসাদোপম চার তলা বাড়িতে ঘণ্টাখানেক লুকিয়ে থেকে ভোট-পর্বে ‘নিষ্ক্রিয়’ থেকেছেন। তখন স্ত্রী আনহারা বিবির পাশে বসে বলছিলেন, ‘‘বুথে গেলেই পুলিশ জেলে পুরবে বলেছে। আজ ভোটটা দিয়ে আর বাড়ি থেকে বেরোব না।’’

রবীন্দ্রনাথবাবুর প্রসঙ্গ উঠতেই শক্ত হল চোয়াল। মাথাটা সামনে ঝুঁকিয়ে কাটা কাটা স্বরে বললেন, ‘‘এখানে তৃণমূল বলতে কী ছিল? আমি-ই কাটোয়ায় তৃণমূল এনেছি। পুরভোটে বুথ দখল করে ১০টা ওয়ার্ড জিতেছি, এটা তৃণমূলের সব নেতা জানেন। স্বপনবাবু, অরূপ বিশ্বাস...সবাই জানেন। কিন্তু কী হল! সেই রবিদা এলেন তৃণমূলে! আর উনিই প্রার্থী বিধানসভায়!’’ মানলেন রবিবাবুর একটা মিছিল-মিটিংয়ে যাননি। বললেন, তাঁর ওয়ার্ডে রবিবাবু জিতবেন না। এই ওয়ার্ডের অধিকাংশ বাড়ির দেওয়ালে রবিবাবুর নাম নেই।

তবু আত্মবিশ্বাসী সত্তর ছুঁইছুঁই রবিবাবু বলছেন, ‘‘এলাকার মানুষ আমার চেনা। তাঁদের সঙ্গে নিয়েই আমার বছরের পর বছর কেটেছে। মানুষ জানে, কেন কংগ্রেস ছেড়ে তৃণমূলে যেতে হয়েছে। আমাকে বিশ্বাস করে কাটোয়া।’’ দুশ্চিন্তা খালি জঙ্গলকে নিয়েই। জঙ্গল তাঁর বিরুদ্ধে প্রচার করেছেন, জানেন রবিবাবু। বললেন ‘‘অনেক বার তৃণমূলের শীর্ষ নেতাদের জানিয়েছি, জঙ্গলের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে। এ বার আবার আমার কর্মীদের ক্ষতি না করে দেয় ও!’’ জানালেন, ‘অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় নিজে জঙ্গলের আচরণে অসন্তুষ্ট।

জঙ্গল কিন্তু মনেপ্রাণে রবি-বিরোধী। তাঁর অভিযোগ, ‘‘তিন বছর আগে আমি তখন জেলে। আমার মেজ ছেলে খুন হল। ছোট ছেলেটাকে ট্রাক্টরে পিষে মারল। সবই ওই রবিদার কংগ্রেসের জন্য। ওদের ছেড়ে দেব?’’ যদিও রবিবাবুর দাবি, ‘‘তখন তো জঙ্গল সিপিএমে। সিপিএমের অন্তর্দ্বন্দ্বেই ওঁর ছেলে খুন হয়েছে। আমার সঙ্গে এর কী যোগ!’’ নিজের দলের জেলা সভাপতি প্রসঙ্গে মুখ খুলতে চাননি এই প্রবীণ নেতা। আর স্বপন দেবনাথের মোবাইলে যতবারই কল করা হয়েছে, তাঁর নিরাপত্তারক্ষী ফোন ধরে বলেছেন, ‘স্যারের শরীর খারাপ। কথা বলতে পারবেন না’।

সে কি নিজের জেলায় ‘নিজের’ পুলিশই কথা শুনল না বলে? উত্তরটা জানার কোনও উপায় নেই।

ছবিগুলি তুলেছেন সুদীপ আচার্য, অসিত বন্দ্যোপাধ্যায় ও নিজস্ব চিত্র।
(সহ প্রতিবেদন: কেদারনাথ ভট্টাচার্য)

assembly election 2016 Rabindranath Chattopadhyay
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy