Advertisement
১৮ মে ২০২৪

‘সব সাজানো ঘটনা’ বোঝাতে হরিদেবপুরে শোভন-সফর

হরিদেবপুরের দরির চকে সিপিএম সমর্থক এক পরিবারের উপরে হামলা ও বাড়ির ছোট্ট মেয়েকে মারধরের অভিযোগে দু’দিন ধরে উত্তাল রাজনীতি।

ঢুকতে মানা, আদরে নয়। আহত প্রীতি বরের বাড়ির দরজায় শোভন চট্টোপাধ্যায়। সোমবার। ছবি: রণজিৎ নন্দী

ঢুকতে মানা, আদরে নয়। আহত প্রীতি বরের বাড়ির দরজায় শোভন চট্টোপাধ্যায়। সোমবার। ছবি: রণজিৎ নন্দী

নিজস্ব সংবাদদাতা
শেষ আপডেট: ০৩ মে ২০১৬ ০৪:০০
Share: Save:

উপলক্ষ ছিল প্রতিবাদ।

কীসের? সিপিএমের ‘কুৎসা’র।

হরিদেবপুরের দরির চকে সিপিএম সমর্থক এক পরিবারের উপরে হামলা ও বাড়ির ছোট্ট মেয়েকে মারধরের অভিযোগে দু’দিন ধরে উত্তাল রাজনীতি। সেই ঘটনাকেই ‘অপপ্রচার’ বলে দাবি করে সোমবার সেখানে প্রতিবাদ সভা করতে যান বেহালা পূর্ব কেন্দ্রের তৃণমূল প্রার্থী তথা কলকাতার মেয়র শোভন চট্টোপাধ্যায়। বাচ্চা মেয়েটির গলা জড়িয়ে ধরে চুমু খেয়ে পরিস্থিতি যথেষ্ট ‘শোভন’ করারও চেষ্টা করেন। কিন্তু তার বাড়ির চৌকাঠ মেয়র পেরোতে পারেননি। বাড়ির দরজায় দাঁড়িয়ে একটু কথা বলেই তাঁকে ফিরে যেতে হয়।

গ্রামের সভায় শোভনবাবুর দাবি ছিল, নিগৃহীত বালিকা প্রীতি বরের বয়ান বদলে রাজনীতি করছে কেউ কেউ। মানুষকে তা জানাতেই সভা করতে হচ্ছে। শান্তি বজায় রাখার কথা বলতে হচ্ছে। যদিও প্রীতির মা বাসন্তী বরের পাল্টা দাবি, ‘‘প্রতিবাদ সমাবেশের নামে ফের হুমকি দেওয়া হল। মুখ খুললে ফের হামলা হতে পারে, সভা করে সেটাই জানানো হচ্ছে শাসানির স্বরে।’’

এ দিন সভার আগেই অবশ্য মেয়র মেয়েটির বাড়িতে যান। ঢোকার মুখেই বাসন্তীদেবীর শাশুড়ি বলেন, ‘‘ভিতরে ঢুকতে দেওয়া যাবে না।’’ মেয়র বলেন, ‘‘ঢুকতে চাইছি না। বাইরে থেকেই শিশুটিকে দেখে চলে যাব।’’ বাড়ির চৌকাঠে দাঁড়িয়েই বাসন্তীদেবী তাঁকে বলেন, ‘‘এখনও তৃণমূলের লোকেরা বলছে, বাড়িছাড়া করব।’’ শোভনবাবু বলেন, ‘‘কথা দিচ্ছি, কেউ কিছু করবে না। ঝান্ডা উঁচিয়ে রাজনীতি করবেন। আপনি আমার ছোট বোনের মতো।’’ মেয়রের কাছে ফের প্রীতির মায়ের আবেদন, ‘‘গ্রামে সন্ত্রাস বন্ধের ব্যবস্থা করুন। দাদা হিসেবে এটা করুন।’’ তা-ও করা হবে জানিয়ে মেয়র বলেন, ‘‘কেউ যদি কিছু করে, আমাকে ফোন করবেন। আমি ব্যবস্থা নেব। কোনও ভয় নেই।’’

কিন্তু কেন বাড়িতে ঢুকতে দেওয়া হল না মেয়রকে? বাসন্তীদেবীর কথায়, ‘‘বাড়িতে তখন অনেক অতিথি ছিলেন। তাই ওঁকে ভিতরে আসার কথা বলিনি।’’ এতে অবশ্য এতটুকুও বিচলিত নন শোভনবাবু। তাঁর কথায়, ‘‘এত লোক ছিল যে, বাড়িতে ঢোকা যেত না। বাইরে দাঁড়িয়েই কথা হয়ে গিয়েছে।’’

বাড়িতে না ঢুকলেও মেয়েটিকে বাইরে আনতে বলেন শোভনবাবু। প্রীতিকে আদর করে চুমুও খান। তাঁকেও অবাক করে মেয়রের গলা ধরে পাল্টা চুমু খায় ছোট্ট মেয়ে। তখনও কপালে ব্যান্ডেজ। যাঁর গালে চুমু খেল, তাঁরই এক দল সমর্থক তাকে মেরেছে, তা এখনও মানতে পারছে না ওই বালিকা।

শনিবার বেহালা পূর্ব কেন্দ্রে ভোটের পরে রাতে দরির চক গ্রামে গোলমাল বাধে। অভিযোগ, নিষেধ করা সত্ত্বেও স্থানীয় বাসিন্দা সিপিএমের অমূল্য বরের পরিবার ভোট দিতে যাওয়ায় তৃণমূলের এক দল সমর্থক তাঁর বাড়িতে হামলা চালায়। অমূল্যবাবু বাড়ি ছিলেন না। আক্রোশ গিয়ে পড়ে পরিবারের উপরে। অভিযোগ, রোষের মুখে পড়ে ছোট্ট প্রীতিও। মাথা ফেটে যায় তার।

ঘটনার কথা জানাজানি হলে ধিক্কার শুরু হয় সবর্ত্রই। বীজপুরের পরে ভোটের রাজনীতিতে ফের নিগৃহীত আর এক বালিকা। বাসন্তীদেবীর কথায়, ‘‘ভোট দিয়েছি বলে এমন অত্যাচার। ছোট্ট মেয়েটাকেও রেহাই দিল না।’’ ঘটনায় পুলিশ একাধিক জনকে গ্রেফতারও করে। পরে তাঁরা জামিন পেয়ে যান।

সোমবার ওই গ্রামের ঠাকুরতলায় বিকেল ৪টেয় প্রতিবাদ সভা ডেকেছিল তৃণমূল। সেখানে বলা হয়, মেয়েটিকে মারধর করা হয়নি। ছুটে আসতে গিয়ে লোহার গেটে ধাক্কা লেগে তার মাথা ফাটে। তৃণমূল ওই গ্রামে কোনও হামলা চালায়নি বলেও দাবি করা হয়। যা শুনে হতবাক গ্রামের একাধিক বাসিন্দাও। সভার আগে গ্রামে গিয়ে দেখা যায়, মুখে কুলুপ এঁটেছেন অধিকাংশই। নামপ্রকাশে অনিচ্ছুক এক যুবক বলেন, ‘‘দয়া করে নাম লিখবেন না। তা হলে কিছু বলতে পারি। বুঝছেন তো, জানতে পারলে হামলা করবে।’’ তাঁর দাবি, ভোটের আগের দিন একদল (বেশ কয়েক জন অন্য গ্রামের) তৃণমূল সমর্থক বেছে বেছে বাম সমর্থকদের বাড়ি-বাড়ি গিয়ে ভোট দিতে নিষেধ করে। তা সত্ত্বেও অমূল্য বরের মতো আরও কয়েক জন গোপালনগর স্কুলে গিয়ে ভোট দিলে, সেই আক্রোশেই আক্রমণ শুরু হয়। মার খেয়েছেন বাম সমর্থক এক এজেন্টও।

ওই যুবকের কথা যে ভুল নয়, তা মালুম হল প্রতিবাদ সভা শুরুর আগে গ্রামের চিত্র দেখে। বাইরে থেকে তৃণমূলের অনেকেই আসেন। প্রীতির বাড়ির কাছে ছিল পুলিশ। পুলিশ জানায়, ওই বাড়ির দিকটা বাম সমর্থকদের পাড়া বলে পরিচিত। সভার আগে তৃণমূলের একটি মিছিল এগিয়ে যায় নিগৃহীতার বাড়ির দিকে। বাসন্তীদেবীরা ততক্ষণে বাইরের দরজায় তালা ঝুলিয়ে দিয়েছেন। এ নিয়ে আর এক প্রস্ত ক্ষোভ ছড়ায়।

সভায় কেন্দ্রের প্রার্থী তথা দক্ষিণ ২৪ পরগনার জেলা সভাপতি শোভন চট্টোপাধ্যায় বুঝিয়ে দেন, শান্তি বজায় রাখতেই গিয়েছেন তিনি। সভা শুরুর আগেই পুলিশের মাধ্যমে খবর পাঠান, প্রীতির কাছে যেতে চান। আপত্তি করেননি বাসন্তীদেবীও। তবে মেয়রকে ঢুকতে না দেওয়া নিয়ে গুঞ্জন হয়।

সভায় অবশ্য সে দিনের ঘটনা সাজানো বলেই জানান একাধিক কাউন্সিলর-সহ দলের নেতারা। আর প্রীতির মায়ের কথায়, ‘‘মেয়র তো আমার কাছে স্বীকার করে গেলেন, ওকে মারা হয়েছে।’’ যা শুনে মেয়রের বক্তব্য, ‘‘একটা ছোট্ট মেয়েকে আর রাজনীতির মধ্যে জড়াতে চাই না। ওর উপরে আঘাত আমাকেও ব্যথিত করে। তা সে যে ভাবেই হোক না কেন!’’

ঘটনায় গ্রেফতার হওয়া সর্বেশ্বর মণ্ডলকে পাশে বসিয়ে এ দিন সভা করেন শোভনবাবু। তা নিয়ে নিন্দায় সরব জোট সমর্থিত প্রার্থী অম্বিকেশ মহাপাত্র। নিগৃহীতার বাড়িতে মেয়রের যাওয়া নিয়ে তাঁর প্রতিক্রিয়া, ‘‘ড্যামেজ কন্ট্রোল করতে মেয়েটির বাড়িতে গিয়ে সহানুভূতির নাটক করছে। আর যাঁদের বিরুদ্ধে অভিযোগ, বাইরে তাঁদের নিয়ে প্রতিবাদ সভা করছে।’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE