Advertisement
২৬ এপ্রিল ২০২৪
North Dinajpur

Bengal Election: মেরু-মুখী ভোটেই কি লেখা হবে ভাগ্য

চাকলাহাটে সঙ্ঘ তথা বিজেপির পথসভা শুনতে শুনতে পাশে দাঁড়ানো প্রদীপ চৌধুরী, উত্তম চৌধুরীদের কাছ থেকে জানা গেল, উজ্জ্বলা গ্যাসের পরিষেবা এখানকার মানুষ পান না।

প্রতীকী ছবি।

প্রতীকী ছবি।

দেবাশিস চৌধুরী
কলকাতা শেষ আপডেট: ১৮ এপ্রিল ২০২১ ০৫:৪০
Share: Save:

সুই নদীর জলে তখন পড়ন্ত বিকেলের ছায়া। বসন্তের বিকেল। হাল্কা হাওয়ায় কাঁপছে কয়েক ধাপ নীচের রাস্তায় দাঁড়ানো ছোট্ট গাড়ির উপরের পতাকা ক’টি। কাঁপছে বক্তার কন্ঠস্বরও। দিল্লির সরকার কী কী দিয়েছে, সেই তালিকা তুলে ধরছিলেন তিনি। মনে পড়ছিল, একটু আগে ইটাহার বাসস্ট্যান্ডে চায়ের দোকানে বসে স্থানীয় ব্যবসায়ী হায়দার আলি কী ভাবে পাঁকাল মাছের মতো প্রশ্ন এড়িয়ে যেতে যেতে শেষে বলে গেলেন, ‘‘কে কী দিয়েছে, হিসেব করলেই তো বুঝতে পারবেন, কার দিকে পাল্লা ভারী।’’

তার পরে মুচকি হেসে মন্তব্য, ‘‘দুয়ারে সরকার কর্মসূচিতে অনেকে উপকৃত হয়েছেন। তাই এখানে এমআইএম এলেও দাঁত ফোটাতে পারবে না।’’

কয়েক মিনিট পরে চাকলাহাটে সঙ্ঘ তথা বিজেপির পথসভা শুনতে শুনতে পাশে দাঁড়ানো প্রদীপ চৌধুরী, উত্তম চৌধুরীদের কাছ থেকে জানা গেল, উজ্জ্বলা গ্যাসের পরিষেবা এখানকার মানুষ পান না। তাঁরা বলেন, ‘‘এখানে ভোটে সম্প্রদায়গত সমীকরণ কাজ করতে পারে।’’

ইটাহার থেকে এর আগে দু’বার জিতেছেন অমল আচার্য। তৃণমূলের জেলা সভাপতি ছিলেন লোকসভা ভোটের সময়েও। এ বারে টিকিট না পেয়ে পা বাড়িয়েছেন বিজেপির দিকে। প্রদীপ চৌধুরী বলেন, ‘‘অমল অনুগামীদের মধ্যে হিন্দু ভোট বিজেপিতে যাবে।’’

অমলের এলাকা বলে পরিচিত রায়গঞ্জও। জেলার সদর শহর। তবে ইসলামপুরের সঙ্গে দূরত্ব অনেকটাই। যে দূরত্বের ফাঁদে পড়েছেন খোদ তৃণমূল জেলা সভাপতি কানাইয়ালাল আগরওয়াল। শহর এবং লাগোয়া গ্রামাঞ্চলের অনেকটা জুড়েই একটা কথা— বাইরের লোককে কাছে পাব না। বিপরীত মত যে নেই, তা নয়। তবু, কানাইয়ার জোর তাতে বাড়ছে কি?

তাঁর পুরনো তালুক ইসলামপুরে বরং হাতযশ তৈরি হয়েছে কানাইয়ার। কারণ, পুলিশ জেলা, জমি জট কাটিয়ে বাইপাস তৈরির পিছনে তাঁর হাত আছে বলে মনে করেন অনেকেই। শহরের ভিতর দিয়ে গিয়েছে জাতীয় সড়ক। এত দিন সব দূরপাল্লার গাড়ি যেতে শহর ভেদ করে। বাইপাস হওয়ার পরে রাস্তায় ভিড় একটু কমেছে। কিন্তু তাতে শহরের নিশি জাগরণের অভ্যাস খুব বেশি টাল খায়নি। প্রার্থীরাও অনেক রাত অবধি প্রচার করছেন। বিজেপির সৌম্যরূপ মণ্ডল বা তৃণমূলের আব্দুল করিম চৌধুরী, যাঁকেই ধরতে যান রাত সাড়ে দশটা-এগারোটা সব থেকে ভাল সময়।

শহরের পিডব্লিউডি গেস্ট হাউসের উল্টো দিকে ক্লাব ঘরে বসে আড্ডা দেন সব বয়সের মানুষ। রাজনীতির সঙ্গে কোনও যোগ নেই। ভোটের হাওয়া জিজ্ঞেস করতেই বলেন, ‘‘ও তো করিম চৌধুরী জিতবেন। আচ্ছা, এক কাপ চা খাবেন তো?’’ চায়ের সুবাস এই শহরের সারা শরীরে। গভীর রাতে প্রচার সেরে ফিরে করিম সাহেবের সঙ্গীও এক কাপ চা। আর এই চায়ের কাপেই ক্ষোভের সর পড়েছে পাশের কেন্দ্রের বিধায়ক, তথা তৃণমূল প্রার্থী হামিদুলের বেলায়।

সকাল গড়াচ্ছে। রোদের তাপ বাড়ছে। বাগানে ফার্স্ট ফ্লাশ উঠে গিয়েছে। এখন সেকেন্ড ফ্লাশের আগে গাছের পরচর্যা। সে সবই সারতে এসেছিলেন নফিজন নেছা এবং মর্জিনা খাতুন। হাতের কাজ গুটিয়ে বাড়ি যাওয়ার জন্য তৈরি হচ্ছেন তখন। কথায় কথায় বার হয়ে এল অনেক ক্ষোভ। চায়ের ন্যূনতম মজুরিও পান না। ঘরের টাকা, বাচ্চাদের বইপত্র, কিছুই আসে না হাতে। কথায় কথায় বলেন, ‘‘দিদি ভাল। কিন্তু দিদির ভাইয়েরা একদম ভাল না। বলে গেল দেব। কিন্তু কিছু দিল কি?’’ ক্ষোভ গিয়ে পড়ে স্থানীয় গ্রাম পঞ্চায়েতের প্রধানের উপরেও। তা হলে কি হামিদুল রহমানের অবস্থা কিছুটা নড়বড়ে? দলুয়ায় পথের পাশে দোকানে বসে মহম্মদ সোলেমান বলেছেন, ‘‘ক্ষোভ আছে। ভোট কমবে। কিন্তু বদলের সম্ভাবনা কম।’’

এতটা নিশ্চিত করে কিন্তু চাকুলিয়ার লোকজনেরা দাঁড়াতে পারছেন না বর্তমান বিধায়ক ইমরান আলি রমজের (ভিক্টর) পাশে। অথচ এলাকায় কাজের মানুষ, কাছের মানুষ হিসেবে পরিচিত ভিক্টর। প্রচারে বার হলে ভোটাররা এসে হাতে দিয়ে যান ভোটের খরচপাতি, এতটাই উজ্জ্বল তাঁর ভাবমূর্তি। তবু বিহারের গা ঘেঁষা এই কেন্দ্রের ভোটার, বিজুলিয়ার মসিউর রহমান, দোস্ত মহম্মদরা বলেন, ‘‘ভয় হয়, ভিক্টর যদি জিততে না পারেন, আর তাঁর সঙ্গে তৃণমূলের ভোট কাটাকাটিতে যদি বিজেপি বেরিয়ে যায়!’’ কিসানগঞ্জ পেরিয়ে পশ্চিমবঙ্গে ঢুকেই যে বাজার, সেই রামগঞ্জের বাপি দুবে আর করিষেন্দু দুবের কথা মনে পড়ে যায়। একটু আগেই বাপি বলছিলেন, ‘‘আমরা বরাবর ফরওয়ার্ড ব্লক প্রার্থীকেই ভোট দিয়েছি। এ বারে ভাবছি, সেটা কি ঠিক হবে?’’ মেনে নিলেন, তাঁরা নরেন্দ্র মোদীর ভক্ত।

করণদিঘি বিধানসভায় বড় বাজার দোমহনায়। সেখানে ফলের দোকানি ফিরদৌস আলমের আবার ভবিষ্যদ্বাণী, এখানে তৃণমূলই জিতবে। মোড় ঘুরতেই দীপককুমার সিংহ বলছেন, এ বারে পরিবর্তন চাই। তৃণমূল প্রার্থী গৌতম পাল রোড শো করছিলেন জাতীয় সড়কে।
ভিড় ঠেলে এলেন এক বৃদ্ধ। গাড়িতে বসে থাকা গৌতমবাবুর মাথায়
হাত রেখে আশীর্বাদ করে গেলেন। একটু দূরে তৃণমূলের জেলা
আদিবাসী সেলের সহ-সভাপতি তরুণ স্যামুয়েল মার্ডি তখন বোঝাচ্ছেন, ‘‘সংখ্যালঘু তো বটেই, আদিবাসী ভোটের একটা বড় অংশও তৃণমূলে আসবে এ বার। তবে রাজবংশী ভোট পাওয়া নিয়ে সংশয় আছে।’’

একদা প্রিয়রঞ্জন দাশমুন্সির ঘনিষ্ঠ, বর্তমানে রাজ্যের মন্ত্রী গোলাম রব্বানির কাছে কিন্তু লড়াইটা কঠিন। এবং সেটা অনেকখানি প্রিয়জায়া দীপার জন্যও। গোয়ালপোখরের তৃণমূল প্রার্থীর প্রথম চ্যালেঞ্জ ঘরে। তাঁর ভাই গোলাম সারওয়ারকে প্রার্থী করেছে বিজেপি। দ্বিতীয় চ্যালেঞ্জ তাঁর প্রাক্তন দল থেকে। কালিয়াগঞ্জের বাড়ি থেকে কংগ্রেসি প্রচার নিয়ন্ত্রণ করছেন দীপা। শেষ ল্যাপে রাহুল গাঁধীকে এনে লড়াই জমিয়ে দিয়েছেন। কংগ্রেসের লোকজন বলছেন, দীপা আসার বাড়তি অক্সিজেন পেয়েছে দল। যে বিধানসভায় তাঁর বাড়ি, সেই কালিয়াগঞ্জেও লড়াইটা আর তৃণমূল বনাম বিজেপি থাকবে কিনা সন্দেহ। এই হাওয়া ছুঁয়ে যেতে পারে পাশের কেন্দ্র হেমতাবাদকেও।

বাম থেকে দক্ষিণে এসেছিলেন হেমতাবাদের তৎকালীন বিধায়ক দেবেন্দ্রনাথ রায়। তার পর একদিন বালিয়া মোড়ে একটি দোকানের সামনে পাওয়া যায় তাঁর ঝুলন্ত দেহ। বিজেপি এই ভোটে সেটাকেই ‘বিজেপি নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে সন্ত্রাস’ তকমা দিয়ে দেবেনের স্ত্রী চাঁদিমাকে প্রার্থী করেছে। একসময় গমগমে বালিয়া মোড় বেলা গড়াতে এখন নিঝুম। দেবেনের পড়শি লক্ষ্মীরাম বর্মণ বলেন, ‘‘দেবেন নিজের চেষ্টায় জায়গাটাকে দাঁড় করিয়েছিলেন।’’ সেই কৃতজ্ঞতা, সহানুভূতির হাওয়া ইভিএমে ঢুকবে?

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

North Dinajpur West Bengal Assembly Election 2021
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE