Advertisement
E-Paper

গান আছে, কাজ নেই! নিজের ‘নাটকে’ এই মুহূর্তে কোন চরিত্রের অভিনয়ে অনির্বাণ? চর্চা ঘরে-বাইরে

২০২৫। সারা বছরে মাত্র দু’টি ছবি! তার মধ্যে তথাকথিত ‘বাণিজ্যসফল’ একটিই, তাও আবার সাংসদ-অভিনেতার উপস্থিতি-গুণে!

আনন্দবাজার ডট কম সংবাদদাতা

শেষ আপডেট: ২৯ অক্টোবর ২০২৫ ০৯:২৫
কেমন আছেন অনির্বাণ ভট্টাচার্য?

কেমন আছেন অনির্বাণ ভট্টাচার্য? ছবি: সনৎ সিংহ।

সৃজিত মুখোপাধ্যায়ের তিনটি, পাশাপাশি অপর্ণা সেন, অঞ্জন দত্ত ও বিরসা দাশগুপ্তের একটি করে ছবি। এর মধ্যে পাঁচটিই বাণিজ্যসফল। সেটা ২০১৯। খ্যাতির মধ্যগগনে তিনি। সেই সাফল্যের মুকুট মাথায় নিয়েই ২০২১-এ পরিচালনায় আত্মপ্রকাশ, ওয়েব সিরিজ় ‘মন্দার’ দিয়ে। পরের বছরেই বড়পর্দায় ‘বল্লভপুরের রূপকথা’র পরিচালনা। ক্যামেরার পিছনে দু’টিতেই আবার সফল। ২০২৩-এ বলিউডে আত্মপ্রকাশ। একেবারে রানি মুখোপাধ্যায়ের বিপরীতে!

২০২৫। সারা বছরে মাত্র দু’টি ছবি! তার মধ্যে তথাকথিত ‘বাণিজ্যসফল’ একটিই, তাও আবার সাংসদ-অভিনেতার উপস্থিতি-গুণে!

আর পর্দার বাইরে? এই বছরেই ফেডারেশনের সঙ্গে বিরোধে জুড়ল তাঁর নাম। কাজ কমে যাওয়াও শুরু। অক্টোবর, ২০২৫। ফেডারেশনের সঙ্গে ১৩ জন পরিচালকের আইনি লড়াইয়ে ইতি। তবু এখনও কাজে ফিরতে পারছেন না তিনি।

যাঁকে নিয়ে উপরের এই খতিয়ান, তিনি অনির্বাণ ভট্টাচার্য। এক মনীষী সেই কবে বলে গিয়েছেন, ‘বহুরূপে সম্মুখে তোমার, ছাড়ি কোথা খুঁজিছ ঈশ্বর?’ অনির্বাণ ঈশ্বর খোঁজেন কি খোঁজেন না, জানা নেই। তবে ‘বহুরূপ’ প্রতিভার এই অভিনেতার এখন কী অবস্থা, তা নিয়ে চর্চা সর্বত্র। মানে সব শিবিরেই!

অনির্বাণ ভট্টাচার্যের এটাই কি ‘পাখির চোখ’?

অনির্বাণ ভট্টাচার্যের এটাই কি ‘পাখির চোখ’? গ্রাফিক: আনন্দবাজার ডট কম।

একাধারে অভিনেতা, পরিচালক, গায়ক, সুরকার— জেলা শহরের সেই ছেলেই মঞ্চশিল্পী থেকে ছবি-সিরিজ়ের ব্যস্ত নায়ক। একাধারে এবং সমানতালে। অভিনেতারা এখন আর তারকা নন, চরিত্র। অনির্বাণ ইন্ডাস্ট্রিতে এসে যেন সেই পথটা দেখিয়েছিলেন।

শোনা যাচ্ছে, তাঁর কাজ নেই। বিষয়টা নিয়ে কী ভেবেছিলেন তিনি? ‘আমার হাতে দুটো অপশন। হয় রাজনীতির দল খোলা, নইলে গানের দল খোলা।’ গান বাঁধলেন তিনি। লিখলেন, ‘এসব গান-বাজনা ছাড়, চল প্রোমোটারি করি, বড় গাড়ি চড়ি/ইলেকশানের মেজাজ বুঝে দলটা বদল করি...’। কাজ হারালেও গান থেকে যায়। এই আপ্তবাক্যেই কি আশ্রয় নিতে বাধ্য হলেন অভিনেতা?

রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ে নাটক নিয়ে স্নাতকোত্তর অনির্বাণ অচিরেই অপর্ণা সেন থেকে সৃজিত মুখোপাধ্যায়— সকলের ‘প্রিয় অভিনেতা’ হয়ে উঠেছিলেন। ২০১৫-তে জ়ি বাংলার টেলিফিল্ম ‘কাদের কুলের বৌ’-এর মাধ্যমে (ছোট)পর্দায় প্রবেশ তাঁর। এর পর অরিন্দম শীলের ‘ঈগলের চোখ’, ‘ধনঞ্জয়’ বড়পর্দায় তাঁর মাটি শক্ত করতে শুরু করেছিল। তার পর একে একে অপর্ণা সেন, অঞ্জন দত্ত, সৃজিত মুখোপাধ্যায়। আস্তে আস্তে কাজের পরিসর বাড়তে লাগল। সৃজিতের ছবি ‘শাহজাহান রিজেন্সি’-তে গান গাইলেন অনির্বাণ— ‘কিচ্ছু চাইনি আমি আজীবন ভালবাসা ছাড়া’।

গলা শুনে ধরাশায়ী হতে শুরু করল বঙ্গের নারীকুল। তিনি তখন রোম্যান্সের শেষ কথা! অনির্বাণ নিরুত্তাপ। সাংবাদিকেরা সাক্ষাৎকার নিতে চাইলে খানিকটা বিরক্ত হন। বলেন, ‘‘লোকে কেবল আমার সাক্ষাৎকারটাই শোনে। ছবি দেখে না। ছবির প্রসঙ্গ উঠলে বলেন, আপনি যে কী ভাল সাক্ষাৎকার দেন!’’

অনির্বাণের মত এবং পথ।

অনির্বাণের মত এবং পথ। গ্রাফিক: সনৎ সিংহ।

অনির্বাণ প্রকাশ্য স্বভাবে বিনয়ী। ছবিতে তাঁকে দেখার জন্য অনুরাগীরা ভিড় জমাতেন। তাঁকে দেখার জন্য যত ভিড় বাড়ল, তিনি যেন ততই আমজনতা, সাংবাদিকদের কাছ থেকে সরতে শুরু করলেন। আমজনতার দরবারে আপাতগাম্ভীর্যের সঙ্গে যেন মিশে গেল অহঙ্কার। তবে ইন্ডাস্ট্রির নির্দিষ্ট কিছু বন্ধুর সামনে তিনি নাকি ভীষণ হইচই করা একজন ভিন্ন মানুষ।

২০১৯-এর শেষে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর সংশোধিত নাগরিকত্ব বিল পাশ হয়ে গিয়েছে। পরের বছর থেকেই তা নিয়ে উত্তাল গোটা দেশ। ২০২১-এর ২৪ মার্চ অনির্বাণ প্রতিবাদ জানিয়ে লিখলেন, ‘‘আমি অন্য কোথাও যাব না, আমি এই দেশেতেই থাকব।’’ ওই প্রথম অভিনেতার রাজনৈতিক সচেতনতার একটা দিক দেখলেন দর্শক তথা সাধারণ মানুষ। কিন্তু তিন বছর পরে, ২০২৪-এ আরজি কর কাণ্ডের ক্ষেত্রে তিনি চুপ থাকলেন কেন? এই প্রশ্নে তিনি জেরবার হতে শুরু করলেন। বহু পরে তাঁর পাল্টা প্রশ্ন, ‘‘সব বিষয়েই কি বক্তব্য রাখতে হবে?’’ অথচ, অভিনেতার স্ত্রী মধুরিমাকে দেখা গিয়েছিল আরজি কর আন্দোলনে সক্রিয় ভূমিকা নিতে।

বক্তব্য রাখলেন অনির্বাণ। সব বিষয় না হলেও বিশেষ বিষয়ে। ফেডারেশন-পরিচালক কাজিয়ায় তিনি প্রচণ্ড প্রতিবাদী। ফলাফল, অনির্বাণ আর অভিনয়ের ডাক পান না। পরিচালনা করতে চাইলে টেকনিশিয়ানরা শুটিংয়ে যান না। টেকনিশিয়ানরা বিমুখ হলেও তাঁর সহ-অভিনেত্রী অনির্বাণের কাজ না পাওয়া নিয়ে মুখ খুলেছেন। শুভশ্রী গঙ্গোপাধ্যায় বলেছেন, “আমি মনে করি, একজন শিল্পীকে বেঁধে রাখা যায় না। অনির্বাণদার মতো প্রতিভাবান একজন অভিনেতা যদি বাংলায় কাজ না করেন, তা হলে অন্য ভাষায় কাজ করবেন.. সেটা নিয়ে তো কোনও দ্বিমত নেই। তাঁকে যে পাত্রেই রাখবে.. সে তো অনির্বাণ। দুর্দান্ত একজন অভিনেতা। উনি যেখানেই যান, শ্রেষ্ঠ হয়ে থাকবেন। যে ঘটনাগুলো ঘটছে, আমার মনে হয় না আমরা কেউই এই বিষয়টাকে সমর্থন করছি... আমরা সবাই চাই উনি আরও ভাল ভাল কাজ আমাদের উপহার দিন আর খুব তাড়াতাড়ি কাজে ফিরুন।’’

অভিনেতাকে কি ‘বেঁধে’ রাখা উচিত?

অভিনেতাকে কি ‘বেঁধে’ রাখা উচিত? গ্রাফিক: সনৎ সিংহ।

চুপ নেই প্রিয় বান্ধবী সোহিনী সরকার। “অনির্বাণের মতো অভিনেতার কাজ না পাওয়া খুব দুঃখজনক। আমি আশা করি আলোচনার মাধ্যমে এই সমস্যার সমাধান হবে।’’ কী ইঙ্গিত করছেন সোহিনী? অনির্বাণকে আলোচনায় বসতে? ফেডারেশনের সঙ্গে বিবাদ মেটাতে একে একে পরিচালক থেকে অভিনেতারা একটা সময়ের পর শাসকদলের দ্বারস্থ হয়েছেন। কী করবেন অনির্বাণ?

জানা যাচ্ছে না। যা জানা গিয়েছিল তা হল, তিনি নাকি ‘সাংবাদিকদের মাংস’ (পাপারাৎজ়ি মিট) খেয়েছেন! আনন্দবাজার ডট কম-এর এক সাংবাদিককে এমনটাই জানিয়েছিলেন তিনি। আসলে সাংবাদিকদের একটানা ফোন, সারা ক্ষণের অযৌক্তিক (তাঁর মতে) প্রশ্নে জেরবার তিনি। ‘উচিত শিক্ষা’ দিতে তাই ‘ময়দানে’ নামলেন। বার বার সতর্ক করার পরেও সাংবাদিক তাঁর কাজে অবিচল থাকলে তিনি বাঁকা পথ ধরলেন। আফ্রিকায় শুটিংয়ের কথা বলতে গিয়ে ‘গল্প’ ফাঁদলেন। সেই গল্পে জুড়ল অবিশ্বাস্য সেই খাবারের নাম। কিন্তু সাংবাদিক সেটাই (ফাঁদা গল্প বা গল্পের ফাঁদ!) বিশ্বাস করে লিখে দিলেন। চারদিকে তখন হাসির ফোয়ারা, সাংবাদিকেরা নাকি ‘নির্বোধ’! আশ মিটল অনির্বাণের।

কাজ নেই। তাই গান বাঁধলেন অনির্বাণ। গানের দল ছিল তাঁর অন্যতম শেষ সম্বল। কিন্তু সেখানেও বিতর্ক। গানের দল নিয়ে মঞ্চে অনুষ্ঠান করতে চাইলে আয়োজকরা তাঁকে বাদ দিয়ে দেন। জানানো হয়, মঞ্চে তাঁকে সুযোগ দিলে অনুষ্ঠানটাই বাতিল হয়ে যাবে! অনির্বাণ নিশ্চয়ই কোনও না কোনও পথ খুঁজে পাবেন। মেধাই তো তাঁর সম্বল। তিনি থেমে নেই। তাঁর পরিচিত বড় প্রযোজনা সংস্থায় ‘দিওয়ালি’ পার্টিতে তিনি গান গাইলেন। এই প্রযোজনা সংস্থার সহযোগিতায় দীপাবলিতে তাঁর গানের দলের দ্বিতীয় গান বেরিয়েছে। এই গানের শুটিং বাংলায় করতে পারেননি তিনি। অন্য রাজ্যে গিয়ে শুট করতে হয়েছে। এই সঙ্কটকালে কেউ কিছু করে উঠতে পারছেন না অনির্বাণের জন্য। অনির্বাণ কাজ করার অনুমতি এখনও পাননি। শেষে ‘বিশ্বাস ব্রাদার্স’–এর কাছেই কি ভাগ্যের চাবিকাঠি রাখা আছে তাঁর? দুই ভাইয়ের একজনকে অনির্বাণের কাজে ফেরা নিয়ে প্রশ্ন করা হলে তিনি কোনও উত্তর দেননি।

অনির্বাণ ভট্টাচার্যের ভবিষ্যৎ কী?

অনির্বাণ ভট্টাচার্যের ভবিষ্যৎ কী? গ্রাফিক: সনৎ সিংহ।

পুনশ্চ:

এ সবেরই মাঝে এক দিন শোনা গেল ভিন্ন ‘কলি’— ‘‘বোন, বোন, বোন! বোন রে...’’

মানে? অবাক হয়ে প্রশ্ন আনন্দবাজার ডট কম-এর। জবাবে ইন্ডাস্ট্রির এক অভিনেত্রী (নাম প্রকাশ না করার শর্তে) বললেন, ‘‘ভাবছি আমিও একটা গানের দল খুলব! উনি যদি পারেন, তবে তো আমিও পারি! যদিও ওঁর মতো আমি গায়ক নই!’’ কিন্তু ‘বোন, বোন, বোন’...? অভিনেত্রীর জবাব, ‘‘ওঁর গানে তো ‘ভাই, ভাই, ভাই রে’, শুধুই পুরুষ আর পুরুষ! আমি উল্টো দিকটা দেখাব। তাই বোন বোন বোন...।’’ হাসির মোড়কে এ সব বলতে বলতেই গম্ভীর হয়ে গেলেন সেই অভিনেত্রী। বললেন, ‘‘আসলে কী জানেন তো, বাঙালি এমনিতেই ভিতু। তার উপর বাঙালি শিল্পী! বরাবর এক ক্ষমতার কোলে বসে অন্য ক্ষমতার প্রতিবাদ করে এসেছে।”

শেষ-অঙ্ক

‘দেখুন, সমস্যাহীন পৃথিবী হয় না। সমস্যা, অভাব, নেগিটিভিটি, অবসাদ— এগুলো থাকবেই।...নাটক শেষ হওয়ার আগে স্টেজ ছাড়বেন না।... কমেডি হোক বা ট্র্যাজেডি— এই জীবন নাটকের নায়ক আপনি, নায়িকা আপনি।’ নিশ্চয়ই মনে আছে অনির্বাণের। তিনি কি এখনও ‘স্টেজে’?

Federation Srijit Mukherji Anirban Bhattacharya
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy