Advertisement
২৪ এপ্রিল ২০২৪
Entertainment News

‘বিশেষ ভাবে কথা বলার ধরনকে যদি অপমান করেন, তা হলে সেটা রেসিজ়ম’

স্নাতক পড়তে মেদিনীপুর ছেড়ে কলকাতায় এসেছিলেন। তখনও ভাবেননি, অভিনেতা হবেন। থিয়েটার নিয়ে স্বপ্ন দেখতে দেখতে সেই ছেলে এখন বড় পর্দাতেও অভিনয় করছেন দাপটের সঙ্গে। কেমন ছিল তাঁর এই সফর? কতটা লড়াই করতে হয়েছিল তরুণ অভিনেতাকে? অনির্বাণ ভট্টাচার্যের সঙ্গে কথা বললেন অন্তরা মজুমদারস্নাতক পড়তে মেদিনীপুর ছেড়ে কলকাতায় এসেছিলেন। তখনও ভাবেননি, অভিনেতা হবেন। থিয়েটার নিয়ে স্বপ্ন দেখতে দেখতে সেই ছেলে এখন বড় পর্দাতেও অভিনয় করছেন দাপটের সঙ্গে। কেমন ছিল তাঁর এই সফর? কতটা লড়াই করতে হয়েছিল তরুণ অভিনেতাকে?

অনির্বাণ ভট্টাচার্য।

অনির্বাণ ভট্টাচার্য।

শেষ আপডেট: ১১ মার্চ ২০১৯ ১৪:২৭
Share: Save:

প্রশ্ন: আপনার জন্ম কোথায়?

উত্তর: বিধাননগরে। বিধাননগর, শরৎপল্লি, অরবিন্দ নগর এগুলো অপেক্ষাকৃত নতুন জায়গা মেদিনীপুরের। বিধাননগরে জেঠুর বানানো বাড়িতে আমার জন্ম ও বেড়ে ওঠা। পরে অবশ্য বাবা-মা, আমি আর বোন এ সব জায়গায় বাড়ি ভাড়া করেও থেকেছি। এখন আমাদের বাড়ি শরৎপল্লিতে। আমার দাদু-ঠাকুমা কিন্তু এসেছিলেন বাংলাদেশ থেকে।

প্রশ্ন: কোথায় পড়াশোনা?

উত্তর: আমি যে স্কুলটায় মাধ্যমিক পর্যন্ত পড়েছি, তার আগে নাম ছিল নির্মল হৃদয় আশ্রম। আবার ইলেভন-টুয়েলভ পড়েছি বিদ্যাসাগর বিদ্যাপীঠে। তার পরে কলকাতায় চলে আসি। রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর। নির্মল হৃদয় আশ্রম ছিল চার্চ স্কুল। আমাদের ছোটবেলায় স্কুলের মাঠে পঁচিশে ডিসেম্বর যাত্রাপালা হত। এখন অবশ্য হয় না।

প্রশ্ন: ছোটবেলায় যাত্রা দেখতেন?

উত্তর: হ্যাঁ! চার্চ স্কুলের মাঠে এক বার যাত্রা এসেছিল ‘জুরাসিক পার্ক’। মানুষের বিরাট উত্তেজনা! টিকিটের কাড়াকাড়ি। স্কুলে যেতে আমরা দেখতাম, তিন-চার জন করে হেলিকপ্টার কাঁধে করে বয়ে আনছেন। ডাইনোসর নিয়ে আসছেন, তার চোখে লাল টুনি বাল্ব জ্বলছে! খুব ফ্লপ করেছিল যাত্রাটা। অন্যান্য জায়গা মানে, শরৎপল্লিতে বেলতলার মাঠ, রেললাইনের ওপারে রাঙামাটির মাঠেও যাত্রা হত। ছোটবেলায় ইন্দ্রাণী হালদারের যাত্রা দেখেছি ওখানে। মাধ্যমিকের পর থেকে যাত্রা আস্তে আস্তে অপসৃত হতে দেখেছি। এখন আর একদমই হয় না।

আরও পড়ুন, ‘আমি ভাগ্যবান #মিটু ফেস করিনি, কিন্তু কেন ভাগ্যবান বলব বলুন তো?’

প্রশ্ন: যাত্রা ভাল লাগত?

উত্তর: ওখানে একদম লোকাল যে যাত্রাগুলো হত, যেখানে কোনও সেলেব্রিটি নেই, স্টেজ নেই...ছাঁদনা বেঁধে, কার্পেট পেতে অভিনয় হতো... সেই যাত্রা আমাকে খুব প্রভাবিত করেছিল ওই সময়ে। ওখানে একটা পৌরাণিক যাত্রা দেখেছিলাম সম্ভবত শ্যামা বা কালীকে নিয়ে। তখন ক্লাস সিক্স-সেভনে পড়ি। যাত্রার ফর্মটাই প্রভাবিত করেছিল আমাকে। কিন্তু তখনও অভিনয় করব বলে ভাবিনি।

প্রশ্ন: ছোটবেলাটা কেমন ছিল?

উত্তর: আমার ছোটবেলা বললেই মনে হয়, বিধাননগর মাঠটার কথা। স্কুলে পড়তে ওই মাঠেই কত ফুটবল, ক্রিকেট, ব্যাডমিন্টন খেলেছি! আমি কিন্তু অনেক দিন পর্যন্ত খেলোয়াড় হতে চেয়েছিলাম। যে দিন ফুটবলে ভাল গোল করতাম বা পাস দিতাম, সে দিন মনে হতো আমি ফুটবলারই হব! আবার যে দিন বল পায়ে রাখতে পারছি না, পড়ে যাচ্ছি, শট মারতে পারছি না...তখন আবার মনে হত ফুটবলটা আমার দ্বারা হবে না! যে দিন ক্রিকেটে পাঁচটা উইকেট নিতাম, সে দিন মনে করতাম আমি সোজা ভারতীয় ক্রিকেট টিমে খেলব! সচিন তেন্ডুলকর ক্যাপ্টেন, আমার হাতে বল দিয়ে বলছেন, ‘যাও, দু’টো উইকেট নিয়ে এসো’!

প্রশ্ন: ওই মাঠে এখন আর যান?

উত্তর: সম্প্রতি বিধাননগরে গিয়ে দেখেছিলাম, ওই মাঠটার চার পাশে রেলিং দিয়ে ঘিরে দেওয়া হয়েছে। কয়েক জনের সঙ্গে কথা বলে বুঝলাম, ছেলেপুলেরা রাতে ওখানে অপরাধমূলক কাজকর্ম, নেশা-ভাং ইত্যাদি করছে বলেই মূলত রেলিং দেওয়া হয়েছে। নেশার ব্যাপারটা মেদিনীপুর শহরে কিন্তু আমার মাধ্যমিকের পর থেকেই ভীষণ ভাবে ছড়িয়ে পড়ে। সে অন্য কথা। আমাদের ছোটবেলার মাঠটা এখন আর নেই।

আরও পড়ুন, মেয়েমানুষ নয়, মেয়েদের মানুষ ভাবা হোক

প্রশ্ন: নেশার ব্যাপারটা কী ভাবে ছড়িয়ে পড়ে ওখানে?

উত্তর: আমাদের মাধ্যমিকের পরবর্তী সময়টা থেকে একটা নার্কোটিক ওয়েভ ছড়িয়ে পড়ে। মূলত খড়গপুর থেকে। হয়তো এতে খড়গপুরের মানুষ দুঃখ পাবেন, তবুও তাঁরা স্বীকার করে নিতে বাধ্য হবেন। পুলিশ-প্রশাসন কিছু করতে পারেনি। আমার নব্বই শতাংশ বন্ধুর জীবন ওলোটপালট হয়ে গিয়েছে এই নেশায়। ভাগ্যবশত, বেশির ভাগই এখন স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসতে পেরেছে। কয়েক জন এখন মেদিনীপুরে কিছু রিহ্যাবিলিটেশন সেন্টারও চালায়।

প্রশ্ন: আপনি কি এর থেকে দূরে থাকতে পেরেছিলেন?

উত্তর: হ্যাঁ, কারণ যে সময়ে আমি এই নেশাটার মধ্যে পড়ে যেতে পারতাম, তার আগেই কলকাতায় চলে আসি। উচ্চমাধ্যমিকে খুব একটা ভাল ফল করতে পারিনি বলে মা-বাবা বেশ চিন্তিত ছিলেন। তখন কী করব তা নিয়ে নিজেও চিন্তাভাবনা করছিলাম। পড়াশোনা করার খুব যে ইচ্ছে ছিল, সেটা বলব না। অভিনয় করার ইচ্ছে থেকেই রবীন্দ্রভারতীর ড্রামা ডিপার্টমেন্টে ভর্তি হই।

প্রশ্ন: স্কুলে কোনও মাস্টারমশাই ছিলেন, যিনি আপনাকে অনুপ্রাণিত করেছিলেন?

উত্তর: নির্মল হৃদয় আশ্রমে অনুপ স্যার আমাদের বাংলা পড়াতেন। ওঁর বাড়ি ছিল শেখপুরাতে। সেখানেও পড়তে যেতাম। উনি খুব ভালবাসতেন আমাকে। ক্লাস এইটে যখন উঠেছি, তখন আবার নীতীশ স্যার বাংলা পড়াতেন আমাদের। আমি বাংলাটা ভাল লিখতে পারতাম বলে আমাকে বলতেন, ‘লেখালিখিটা কিন্তু ছাড়িস না, ভট্‌চাজ!’


‘অদ্যই শেষ রজনী’র অভিনয়ে। নিজস্ব চিত্র।

প্রশ্ন: নাটকে আগ্রহ কী ভাবে হল?

উত্তর: সে রকম কোনও স্ট্রং মোটিভেশন ছিল না। আসলে আমার মধ্যে কোনও অ্যাম্বিশন ছিল না কোনও দিনই। রবীন্দ্রভারতীতে ভর্তি হওয়ার পর থেকে থিয়েটার ভীষণ ভাবে ভাল লাগতে শুরু করে। তখন কলকাতা শহরে বিভিন্ন থিয়েটার দেখাও শুরু করেছিলাম। সেকেন্ড ইয়ার নাগাদ নিশ্চিত হয়ে গিয়েছিলাম, থিয়েটারটাই করব। তখনও অভিনয়টাই যে কেরিয়ার হবে, ভাবিনি।

প্রশ্ন: কাদের অনুপ্রেরণায় থিয়েটারে রয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন?

উত্তর: প্রথমেই বলব, অদ্রিজা দাশগুপ্তের কথা। উনি দুর্গাপুরের মানুষ। এনএসডি-তে (ন্যাশনাল স্কুল অব ড্রামা) পড়াশোনা করেছিলেন। ওখান থেকে এসে নিজে সংগঠন করে নাটক করা শুরু করেন কলকাতায়। ২০১০ সালে মিনার্ভা রেপার্টরিতে যোগ দিই আমি। তার আগে পর্যন্ত অদ্রিজাদির সঙ্গেই থিয়েটার করেছি। পরবর্তীকালে সুমন মুখোপাধ্যায়, অবন্তী চক্রবর্তীরাও আমাকে নানা ভাবে প্রেরণা জুগিয়েছেন।

প্রশ্ন: কলকাতায় এসে একটা স্ট্রাগলের পর্ব চলেছিল আপনার। সেটা কী রকম?

উত্তর: আমি যে পরিবার থেকে এসেছি, তাতে ওই কষ্টটা আমাকে করতেই হত। বাবার কাছে সেই পরিমাণ অর্থ ছিল না যে, কলকাতায় আমাকে একটা ফ্ল্যাট ভাড়া করে দিতে পারতেন। প্রথম দিকে দু’আড়াই হাজার টাকায় চালাতে হত। কিন্তু তখন আমার পেট সে ভাবে না ভরলেও বা পছন্দের পোশাকআশাক না পরলেও, থিয়েটার দিয়ে আমার মনটা ভরে থাকছিল। মস্তিষ্কের ক্ষুধা ভাল ভাবেই মিটে যাচ্ছিল আসলে।

আরও পড়ুন, শরীর নিয়ে প্রশ্ন, সোশ্যাল মিডিয়ায় সপাট জবাব স্বস্তিকার

প্রশ্ন: মিনার্ভা রেপার্টরি সে বার ভেঙে যাওয়ার পরেই কি মেদিনীপুর ফিরে গিয়েছিলেন?

উত্তর: না। প্রথম কথা, আমাদের ব্যাচ ডিজ়ল্‌ভ হওয়ার দেড়-দু’মাস আগেই আমি মিনার্ভা ছেড়ে বেরিয়ে যাই। তখন একটা ছবিতে কাজের প্রস্তাব পেয়েছিলাম বলে। যদিও সেই ছবিটা শেষ পর্যন্ত রিলিজ় করেনি। আমার সম্পর্কে বলা হয় যে, আমি নাকি বিদ্রোহ-বিপ্লব করে বেরিয়ে এসেছি! কিন্তু এগুলো ভুল। তবে আমি বা আমরা যে রেপার্টরির স্বপ্ন দেখেছিলাম, সেটা গড়ে তোলার চেষ্টা কোনও দিন হয়নি। তাই কিছু খারাপ লাগা ছিলই। মিনার্ভা ছেড়ে আমি ফ্রিল্যান্সে থিয়েটার করা শুরু করি। অবন্তীদির সঙ্গে ‘থ্রি সিস্টার্স’ করি, ‘পূর্ব পশ্চিম’ নাট্যদল থেকে ‘অ্যান্টনি ও সৌদামিনী’ করি। ‘তিন পয়সার পালা’, ‘নাগামণ্ডালা’ এগুলোও তখনই হয়েছিল। তারও পরে মেদিনীপুরে চলে যাই। কারণ কলকাতায় থাকার মতো টাকাপয়সা কিছু ছিল না আমার কাছে।

প্রশ্ন: ফিরে এলেন কী ভাবে?

উত্তর: আমাকে সুমনদা আর অবন্তীদি ডেকে পাঠিয়েছিলেন। ওঁদের কিছু কাজের পরিকল্পনাও ছিল। ফিরে আসার পরেই সুমনদার সঙ্গে ‘যারা আগুন লাগায়’ করি। অবন্তীদির সঙ্গে ‘ট্রয়’ ও বিভিন্ন ওয়ার্কশপ। এ সব করতে করতেই ২০১৫ সালে অপর্ণা সেন ডেকেছিলেন ‘আরশিনগর’-এর জন্য। তার পরে নিজের একটা নাটক করি ‘চৌমাথা’ বলে। তখন আবার আস্তে আস্তে অল্পস্বল্প টাকাপয়সা জুটে যাচ্ছিল। তার পর ২০১৬-তে ‘অথৈ’ আর ব্রাত্য বসুর ‘অদ্য শেষ রজনী’র রিহার্সাল চলছে, এমন সময়ে অরিন্দম শীল ডেকে পাঠান ‘ঈগলের চোখ’-এর জন্য। তার পর টুক-টুক করে চলছে...।

আরও পড়ুন, রহস্যের উত্তর খুঁজছে ‘ভিঞ্চিদা’র ট্রেলার

প্রশ্ন: কলকাতার এক বিশেষ শ্রেণির মানুষ মেদিনীপুর থেকে আসা ছেলে মেয়েদের ‘টুম্পা’ সম্বোধন করেন। এ রকম কিছুর মুখোমুখি হতে হয়েছিল?

উত্তর: আমাকেও শুনতে হয়েছে। ‘টুম্পা’ তো একটা টিটকিরি মাত্র! কলকাতার সংস্কৃতির পরিবেশে মেদিনীপুরের ছেলে মেয়েদের সবচেয়ে বেশি যেটা নিয়ে শুনতে হয়, সেটা তাদের ভাষা। আমাকে থিয়েটারে অভিনয় করতে হয় বলে সাবেকি বাংলা ভাষা শিখতে হয়েছে। কিন্তু অন্য বিভাগে পড়াশোনার জন্য যাঁরা কলকাতায় আসেন, তাঁদের এই ভাষা রপ্ত করতে হবে, এটা আমি মনেই করি না। এটা আঞ্চলিকতাকে অপমান করা। একটা বিশেষ ভাবে কথা বলার ধরনকে যদি কেউ অপমান করেন, তা হলে সেটা রেসিজ়ম।

প্রশ্ন: মেদিনীপুর শহরে একটি মাত্র সিনেমা হল। মানুষ বঞ্চিত হচ্ছেন?

উত্তর: মেদিনীপুরে দর্শক রয়েছেন কিন্তু। ওখানে যে সিনেমা হলটি এখন রয়েছে, তার নাম হরি। আগে আরও দু’টো ছিল, ভেঙে দেওয়া হয়েছে। মহুয়া সিনেমা ছিল নামকরা। হরি-র অবস্থাও খুবই খারাপ। নোনাধরা দেওয়াল, পর্দার অবস্থা খারাপ, সাউন্ডও তথৈবচ। কলকাতায় যে পরিচালকরা এত যত্ন করে ছবিগুলো বানান, তাঁদের হরিতে নিয়ে গিয়ে শো দেখালে অক্কা পাবেন!

(সেলেব্রিটি ইন্টারভিউ, সেলেব্রিটিদের লাভস্টোরি, তারকাদের বিয়ে, তারকাদের জন্মদিন থেকে স্টার কিডসদের খবর - সমস্ত সেলেব্রিটি গসিপ পড়তে চোখ রাখুন আমাদের বিনোদন বিভাগে।)

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE