একুশ শতক অনেকটা পেরিয়ে গেল। তবু লিঙ্গভেদ, কর্মক্ষেত্রে যৌন হয়রানি কিংবা ভাল স্পর্শ, খারাপ স্পর্শ— এ সব নিয়ে এখনও মাথা ঘামাতে হচ্ছে মানুষকে। স্কুলে যৌনতার পাঠ এখনও সুনির্দিষ্ট নয়। যদিও আশার কথা, ভাল বা মন্দ স্পর্শ শেখানোর দায়িত্ব ইদানীং বহু স্কুল কর্তৃপক্ষ নিজেদের কাঁধে তুলে নিয়েছেন।
তার পরেও প্রশ্ন থেকে যায়। আর কত দিন এ সব নিয়ে মাথা ঘামাতে হবে আধুনিক সমাজকে? একুশ শতক আর কবে নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সকলের হয়ে উঠবে? কেনই বা কর্মস্থল কর্মীদের জন্য নিরাপদ হবে না?
আরজি কর-কাণ্ডের পর বছর ঘুরে গেল। নির্যাতিতার পরিবারের অভিযোগ, এখনও তাঁরা বিচার পাননি। কর্মরত অবস্থায় অন্যায়ের শিকার হয়েছিলেন তরুণী চিকিৎসক ! অভিযোগ, এই কাণ্ডের পরেও কলকাতা-সহ গোটা রাজ্য, সারা দেশ জুড়ে প্রতি মুহূর্তে ধর্ষণের মতো ঘৃণ্য ঘটনা ঘটছে। নাগরিক সমাজ কি আদৌ সচেতন হল? এই প্রশ্নকে সামনে রেখে নাগরিক চেতনা সংগঠনের উদ্যোগে এক জরুরি আলোচনায় বসেছিলেন বিনোদন দুনিয়ার চার খ্যাতনামী— অপর্ণা সেন, সুমন মুখোপাধ্যায়, সুদেষ্ণা রায়, সুজয়প্রসাদ চট্টোপাধ্যায়। আলোচনার পরতে পরতে বার বার তাঁদের গলায় উঠে এসেছে অস্বস্তিকর সেই জিজ্ঞাসা, কেন এখনও বিষয়গুলো নিয়ে আলোচনা করতে হচ্ছে!
পরিচালক-অভিনেত্রী অপর্ণা যেমন উপলব্ধি করেছেন, “একা একা একটি মেয়ে বা ছেলে প্রতিবাদ করলে তাঁকে নানা সমস্যায় পড়তে হয়। বিপরীত প্রতিক্রিয়ার সম্মুখীন হতে হয়। সেটা কর্মক্ষেত্রে হতে পারে, সমাজজীবনেও।” পিতৃতান্ত্রিকতার বীজ এখনও সমাজের গভীরে, আফশোস তাঁর। তাই বিষয়টি থেকে মুক্ত হতে পারছেন না কেউ। এই জন্যই নাগরিক চেতনার প্রয়োজন রয়েছে বলে মনে করেন তিনি। আবার এমনও হয়, এক বা একাধিক মানুষ যে কোনও অন্যায়ের প্রতিবাদে শামিল হতে চান। অথচ কোনও এক ভয় থেকে পারেন না। চাকরি হারানোর ভয়ে, সমাজে হেনস্থার শিকার হওয়ার ভয়ে। তাঁদের জন্য কী পরামর্শ তাঁর? বর্ষীয়ান পরিচালক-অভিনেত্রীর মতে, যাঁরা তুলনায় শক্তিশালী বা প্রভাবশালী তাঁদের এসে দাঁড়াতে হবে তুলনায় পিছিয়ে পড়া বা দুর্বল ব্যক্তির পাশে। এ ভাবেই সব যুগে বিপ্লব সংঘটিত হয়েছে।
সুমনের প্রতিবাদের অন্যতম হাতিয়ার নাটক। তাঁর কথায়, ‘জাগরণে যায় বিভাবরী’র মতো নাটক মঞ্চস্থ করার অনুপ্রেরণা তিনি প্রতিবাদ জানানোর সাহস থেকেই পান। এই নাটকের মাধ্যমে তিনি কিছু প্রশ্ন রেখেছেন। জানতে চেয়েছেন, কর্মক্ষেত্রে বিশেষত নারীকে আর কত দিন ‘সমঝোতা’ করে চলতে হবে? তিনিও অনুভব করেছেন, প্রত্যেকে যতই মুখে বলুক, পৃথিবী সুন্দর— আদতে তো তা নয়। তাই সহজ বুদ্ধির মানুষকে বার বার শুনতে হয়, নিজেকে টিকিয়ে রাখতে হলে বদলে যেতে হবে। কিংবা বাড়ি কিংবা স্কুলে শিশুদের শেখাতে হয় ‘ভাল’ বা ‘মন্দ’ স্পর্শের অর্থ।
আরও পড়ুন:
জীবনকে ‘আকাশ’-এর মতো উদার করে গড়ে তোলার উপমা দিয়েছিলেন কবি সুনির্মল বসু, তাঁর ‘সবার আমি ছাত্র’ কবিতায়। আর এক পরিচালক-অভিনেত্রী সুদেষ্ণা সেই উপমাকে সুন্দর করে ব্যবহার করলেন তাঁর বক্তব্যে। অপর্ণার বক্তব্য নিজের ভাবনায় মিশিয়ে সুদেষ্ণার মত, “গোটা আকাশ না হয় এত দিন নারী এবং পুরুষ অর্ধেক করে ভাগ করে নিয়েছেন। কবে এই আকাশ নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সকলের হয়ে উঠবে?” একই সঙ্গে তিনি এবং তাঁর সংগঠন সমীক্ষা চালিয়ে জানতে পেরেছেন, স্কুলে বা বাড়িতে যৌন হেনস্থার শিকার একা নাবালিকা নয়, নাবালকও।
লিঙ্গ পরিচয় নিয়ে বরাবর সরব সুজয়প্রসাদ। তাঁর ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা স্বস্তিজনক নয়। সেই জায়গা থেকে তাঁর প্রশ্ন, কবে মানুষ পরিবারে বা বাইরে নিরাপদ হবেন? একই সঙ্গে মনে করিয়ে দিয়েছেন প্রতিবাদের শাস্তিস্বরূপ কাজ হারানোর কথাও। সুজয় দেখেছেন, আরজি কর-কাণ্ডের প্রতিবাদ জানিয়ে তাঁর বহু সহকর্মী রাজ্য সরকারের কোপে পড়ে কাজ পাচ্ছেন না। তাঁর কথায়, “আমার না হয় উপার্জনের একাধিক মাধ্যম খোলা। সকলের সেই সুবিধা না-ও থাকতে পারে। তাঁরা তা হলে কী করবেন?”