Advertisement
১৬ এপ্রিল ২০২৪

টলিউডের ‘বচপন’

স্বপ্ন দেখেন ইডেনে হ্যাটট্রিক করার। রাতে দেখেন ‘লা লিগা’। ‘চতুষ্কোণ’য়ে তাঁর অভিনয় ভাল লেগেছে দর্শকের। ইন্দ্রাশিস রায়। টালিগঞ্জের অ্যাংগ্রি ইয়ং ম্যান-এর মুখোমুখি ইন্দ্রনীল রায়।নভেম্বর মাসের ১৩, ১৪, ১৫, ১৬। সাল ২০১৩। পর পর চার দিন টালিগঞ্জের এক অভিনেতা বাড়িতে সকালে উঠে শুধু কাঁদতেন। কখনও বাথরুমে। কখনও এমনি বসে বসে। এমনকী বিবেকানন্দ পার্কের কফি শপে বসে যখন প্রায় এক বছর পরে এই কথাগুলো বলছিলেন তখনও দেখলাম চোখভরা জল।

ছবি: কৌশিক সরকার।

ছবি: কৌশিক সরকার।

শেষ আপডেট: ০৭ নভেম্বর ২০১৪ ০০:০০
Share: Save:

নভেম্বর মাসের ১৩, ১৪, ১৫, ১৬। সাল ২০১৩।

পর পর চার দিন টালিগঞ্জের এক অভিনেতা বাড়িতে সকালে উঠে শুধু কাঁদতেন। কখনও বাথরুমে। কখনও এমনি বসে বসে।

এমনকী বিবেকানন্দ পার্কের কফি শপে বসে যখন প্রায় এক বছর পরে এই কথাগুলো বলছিলেন তখনও দেখলাম চোখভরা জল।

কান্নার কারণ? ওই চার দিন সচিন তেন্ডুলকর বলে এক ক্রিকেটারের শেষ টেস্ট ম্যাচ ছিল।

“যখন টিভিতে দেখলাম সচিন গিয়ে পিচটা প্রণাম করছে আমি থাকতে পারিনি। এই লোকটাকে আর ব্যাট করতে দেখতে পাব না, এটা ভাবছি আর কাঁদছি। আমার কাছে সচিনের রিটায়ারমেন্ট পিতৃবিয়োগের থেকে কোনও অংশে কম নয়,” সিগারেট খেতে খেতে বলছিলেন তিনি।

বক্তার নাম ইন্দ্রাশিস রায়।

বয়স- ২৭, উচ্চতা- ৫ ফুট ১১, ওজন- ৭৬ কেজি, গায়ের রং- শ্যামবর্ণ, শরীরে মেদ নেই। ২০১১-য় ওয়াংখেড়েতে ধোনি বিশ্বকাপ জেতার পর তাঁর কম্পিউটার থেকে ফোনের পাসওয়ার্ড ছিল india2011। হতে চেয়েছিলেন ক্রিকেটার। আজ অভিনেতা।

এবং ‘চতুষ্কোণ’য়ে অল্প বয়সের চিরঞ্জিতের চরিত্রে অভিনয়ের পর টালিগঞ্জে তাঁকে নিয়ে আগ্রহী বড় পরিচালক থেকে প্রযোজক সব্বাই।

পরমব্রত চট্টোপাধ্যায় মনে করেন তাঁর পরের ছবি ‘লড়াই’য়ের সারপ্রাইজ প্যাকেজ তিনি। সৃজিত মুখোপাধ্যায় মনে করেন ‘চতুষ্কোণ’য়ে তিনি অনবদ্য। আর ‘রংমিলান্তি’তে তাঁকে যিনি প্রথম সুযোগ দিয়েছিলেন, সেই কৌশিক গঙ্গোপাধ্যায়ের মতে, “ও লম্বা রেসের ঘোড়া।”

ওহ্‌, বলা হয়নি। এক সময় মিমি চক্রবর্তী ছিলেন তাঁর ‘বিশেষ বন্ধু’। আজকে তাঁরা খুব ভাল বন্ধু।

আজও মিমি আমার খুব ভাল বন্ধু

সাউথ এন্ড স্কুলের এই ছাত্র সারাজীবন তাঁর বাবাকে দেখেছেন ন’টা বাজার তিন কী চার মিনিট আগে অফিসের জন্য বাড়ি থেকে বেরোচ্ছেন।

“কোনও দিন ন’টা বাজেনি বাবার বাড়ি থেকে বেরোতে। মনে হয় প্রায় ২০ বছর অফিস কামাইও করেনি বাবা। আমি আর আমার ভাই চন্দ্রাশিসের বড় হওয়াটা এ রকম ডিসিপ্লিনের মধ্যেই। আজকে কাজ করতে গিয়ে বুঝি এই ডিসিপ্লিনটা কতটা দরকার জীবনে,” ক্যাফে কফি ডে-তে স্মোকড্ চিকেন খেতে খেতে বলছিলেন খেলা-পাগল এই অভিনেতা।

“এবং মনে করবেন না শুধু ক্রিকেট। রাতে স্প্যানিশ লা লিগা দেখা আমার চাই-ই চাই,” বলেন ইন্দ্রাশিস।

প্রসঙ্গত, ২০০৭ সালে ‘চ্যাম্পিয়ন’ বলে একটা টিভি সিরিয়াল দিয়ে তাঁর যাত্রা শুরু। সেই সিরিয়ালে কাজ করেছিলেন মিমি চক্রবর্তীও। সেই সময় থেকেই কি প্রেম? “আমি জানি না প্রেম কি না। তবে হ্যাঁ, মিমির সঙ্গে আমার দারুণ বন্ধুত্ব ছিল। আজও মিমি আমার ভাল বন্ধু। কিন্তু রোজ কথাবার্তা আর হয় না,” বলছেন তিনি।

কিন্তু আজকে যখন তাঁকে নিয়ে পরিচালকরা আগ্রহী, কখনও মনে হয় না মিমির সঙ্গে এক সময়ের এই বন্ধুত্বের কারণে হয়তো রাজ চক্রবর্তীর ছবিতে তাঁর কাজ করা হবে না?

প্রশ্ন শুনে হেসেই ফেলেন ইন্দ্রাশিস। “রাজদা আমাকে খুব স্নেহ করেন। কোনও সমস্যা হলে আমি ওঁর সঙ্গে কথা বলি। আর আমাকে তো সে দিন রাজদা এসএমএস করে লিখলও, ‘উই উইল ওয়ার্ক সুন’। তাই আমার মনে হয় না কোনও অসুবিধা হবে,” বলেন আশুতোষ কলেজে সাহেব ভট্টাচার্যের সঙ্গে বেঞ্চ শেয়ার করা এই অভিনেতা।

তা ক্রিকেট, ফুটবল এত ভালবাসেন, কোনও দিন বন্ধু সাহেব ভট্টাচার্যর বাবা সুব্রত ভট্টাচার্য-র সঙ্গে খেলা নিয়ে আড্ডা মারেননি? “না না। আসলে কাকুর এমন একটা রাগী ইমেজ আছে না, আমার সাহসই হয়নি কোনও দিন কাকুর সামনে বসে আড্ডা মারার,” বলেন তিনি।

‘বচপন’ নামটা ‘রংমিলান্তি’র সেটে অপুদা দিয়েছিল

আজও খেলাকে প্রফেশন হিসেবে না নিতে পারার জন্য একটু হলেও খেদ রয়েছে তাঁর গলায়। “আমার তখন বয়স ২০। চুটিয়ে খেলতাম, কিন্তু ভাগ্যের এমন রকমফের যে অভিনেতা হয়ে গেলাম। আজও কিন্তু প্রায়ই একটা স্বপ্ন দেখি ইডেনে নতুন বল নিয়ে অ্যাটাক শুরু করছি। এবং সোজা হ্যাটট্রিক। তার পর রোনাল্ডোর মতো দর্শকদের কাছে গিয়ে হ্যান্ডশেক করছি। এটা আমার রেকারিং ড্রিম,” গলায় উত্তেজনাটা স্পষ্ট ধরা পড়ে।

প্রসঙ্গত টলিউডে অনেকেই ইন্দ্রাশিসকে ‘অ্যাংগ্রি ইয়ংম্যান’ বলে ডাকেন। “ওর মধ্যে একটা ঝাঁঝ আছে, যেটা বাংলা সিনেমায় খুব বিরল। তাই অ্যাংগ্রি ইয়ংম্যান,” তাঁর প্রসঙ্গে বলছিলেন কৌশিক গঙ্গোপাধ্যায়।

অনেকেই জানেন না এই ‘অ্যাংগ্রি ইয়ংম্যান’য়ের ইমেজের জন্য টালিগঞ্জে ওঁর একটা ডাকনাম রয়েছে। ‘বচপন।’


‘চতুষ্কোণ’ ছবিতে ইন্দ্রাশিস।

‘‘বচ্চন থেকে ‘বচপন’। আমাকে এই নামটা দিয়েছিল অপুদা (শ্বাশ্বত চট্টোপাধ্যায়)। ‘রং মিলান্তি’র সেট থেকেই এটা শুরু। কী আর বলব!” বলতে বলতে হাসেন তিনি।

‘চতুষ্কোণ’য়ের পরে ‘বচপন’ ইন্দ্রাশিস নিজের জায়গাটা আরও শক্তিশালী করে তুলেছেন ইন্ডাস্ট্রিতে।

“আমি প্রত্যেক দিন ভাল অভিনয় করতে চাই। আর সেটার জন্য আমার খিদেটাও প্রচণ্ড। আমার ভাই চন্দ্রাশিস অ্যাসিস্ট্যান্ট ডিরেক্টর। ওর সঙ্গে সিনেমা নিয়ে নানা আলোচনা হয়। আর ক্রিকেট থেকে আমি এটুকু শিখেছি কনসেনট্রেশনটা না-থাকলে কিছু হবে না। সোজা স্লিপে ক্যাচ দেবে তুমি,” বলেন সিসিএল খেলা এই ক্রিকেটার।

সিসিএল বলাতে অবশ্য প্রায় তেলেবেগুনে জ্বলে উঠলেন শাহরুখ-ভক্ত এই অভিনেতা। “প্লিজ সিসিএল-এর কথা আর বলবেন না। আমি বুক বাজিয়ে বলতে পারি দু’-তিনজন যারা সিসিএল নিয়ে সিরিয়াস ছিল আমি তাদের মধ্যে পড়ি। বাকি যারা ছিল তারা টুর্নামেন্টটাকে সিরিয়াসলি নেয়নি। অত হারা আমি কোনও দিন হারিনি। আই ফেল্ট প্যাথেটিক। ভাই তুমি পয়সা পাচ্ছ, খেলাটা তো রেসপেক্ট করো। যিশুদাও একই কথা বলত, কিন্তু বাকিরা সিরিয়াস না-হলে যিশুদা কী করবে?” বেশ রাগের ভঙ্গিতে বলেন ইন্দ্রাশিস।

গৌরবের সঙ্গে কোনও কম্পিটিশন নেই

তবে আজকে আর সিসিএল-এর ব্যর্থতা নিয়ে ভাবতে চান না তিনি। “এখন শুধুই কাজ। ‘চতুষ্কোণ’ সুপারহিট। তার পর ‘লড়াই’। চেষ্টা করছি প্রত্যেকটা ছবিতে নতুন কিছু দেওয়ার। এ ছাড়াও জাতীয় পুরস্কারপ্রাপ্ত ‘আমি আদু’র পরিচালক সোমনাথ গুপ্তর পরের ছবিতে কাজ করছি। জয়দীপ মুখোপাধ্যায়ের ‘আগুন’ ছবিটাও রয়েছে। সব মিলিয়ে মাই হ্যান্ডস আর ফুল,” বলেন তিনি।

শোনা যায় অনেক নতুন অভিনেতার মতোই তাঁরও ফিলোজফার আর গাইড প্রসেনজিত্‌ চট্টোপাধ্যায়। “বুম্বাদা আমাকে সর্বক্ষণ গাইড করেন। সে দিন প্রায় চল্লিশ মিনিট কথা বললাম ওঁর সঙ্গে। এ ছাড়া কৌশিকদা তো আমার মেন্টরই বলতে পারেন। আর সৃজিতদা বন্ধু। পরমদাকে চিনতাম না আগে কিন্তু ‘লড়াই’য়ের পরে হি ইজ ফ্যামিলি। এই মানুষগুলো আমার কাছে খুব স্পেশাল,” বলেন ইন্দ্রাশিস।

পারস্পরিক মুগ্ধতা তো অনেক হল কিন্তু অনেকেই যে বলেন তাঁর এবং গৌরব চক্রবর্তীর মধ্যে নাকি সর্বক্ষণই কম্পিটিশন। “দেখুন, এ রকম কথা যে ইন্ডাস্ট্রিতে হয় সেটা আমি জানি। কিন্তু গৌরব আমার বন্ধু নয়, ও আমার ভাই। প্রত্যেক দিন রাতে ওর সঙ্গে আমার কথা বলা চাই-ই-চাই। আর এই কম্পিটিশনের কথা শুনলে আমরা দু’জনেই খুব হাসি,” ব্ল্যাক কফিতে চুমুক দিতে দিতে বলেন ইন্দ্রাশিস।

আড্ডা প্রায় শেষের মুখে। কফি শপে সিগারেট খাওয়া যায় না বলে বাইরে গিয়ে সিগারেট ধরান ইন্দ্রাশিস।

কথায় কথায় বলেন এই মুহূর্তে তিনি সিঙ্গল, যেমন অভিনেতারা বলেই থাকেন। “বিশ্বাস করুন। আই অ্যাম অ্যাবসোলিউটলি সিঙ্গল,” হেসে বলেন তিনি। তার পর হাসতে হাসতে বলেন বহু বান্ধবীর সঙ্গেই তাঁর একটি বিশেষ কারণে ছাড়াছাড়ি হয়ে গিয়েছে ।

“জানেন, একটা স্টেজের পর আমি আমার বান্ধবীদের বলেই ফেলি ক্রিকেট আমার ফার্স্ট লাভ। এই নিয়ে অশান্তিতে বহু ব্রেক আপ হয়েছে। এ ছাড়া আর একটা সিক্রেট আছে আমার দাড়ি নিয়ে আমি পোজেসিভ। দাড়িতে কাউকে হাত দিতে দিই না,” দাড়িতে হাত বোলাতে বোলাতে বলেন ইন্দ্রাশিস।

জিজ্ঞেস করি, দাড়িতে হাত না দেওয়ার শর্তটা নিশ্চয়ই বান্ধবীদের ক্ষেত্রে খাটে না? প্রশ্ন শুনে লাজুক অভিনেতা আরও লাজুক হয়ে পড়েন।

“দাড়িতে হাত দেওয়ার মানুষ এসে গেলে আনন্দplus-কেই প্রথম জানাব,” বলে গাড়িতে উঠে পড়েন ‘অ্যাংগ্রি ইয়াং ম্যান’।

টালিগঞ্জের ‘বচপন’।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

ananda plus indrashis roy indranil roy
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE