সাক্ষাৎ মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরে এসে মান্নাদা প্রথমেই হৈমন্তীদিকে বললেন, ‘‘তোমার গাড়িতে মিউজিক সিস্টেম আছে না? একটু গান চালিয়ে দাও তো!’’
হয়েছিল এক মহাবিপত্তি! একটা মারাত্মক দুর্ঘটনা ঘটেছিল মান্নাদার গাড়িতে। আর একটু হলে কী যে হয়ে যেত, ভাবতেই সবাই শিউরে উঠছে।
মান্নাদার সংগীতজীবনে শচীনদেব বর্মনের ভূমিকা কতখানি ছিল সে তো সবাই জানে। শচীনদেবের স্মরণে নদিয়াতে অনুষ্ঠান। মান্নাদা সাগ্রহে রাজি। মান্নাদার সঙ্গে যাচ্ছেন হৈমন্তী শুক্লা, বেবিদা, সুশীল দাস, আরও অনেক শিল্পী ও বাদ্যযন্ত্রী। আয়োজনের দায়িত্ব বিশু চক্রবর্তীর। মান্নাদার মদন ঘোষ লেনের বাড়ির সামনে সবাই জড়ো হয়েছে। প্রথম গাড়িতে মান্নাদা। সঙ্গে সুশীল দাস, ভ্যাকাদা (বাদ্যযন্ত্রী)। পিছনের গাড়িতে হৈমন্তীদি, বিশুদা, তপাদা (মান্নাদার ভাইপো)। পিছনে সারি দিয়ে বাকি গাড়িগুলি। বেশ হই হই ব্যাপার। শান্তিপুর আসতেই বৃষ্টি শুরু হল। ওভারব্রিজ পেরোনোর সময় সেই দুর্ঘটনাটা ঘটল। হঠাৎ কন্ট্রোল হারিয়ে মান্নাদার গাড়ি অত উঁচু ব্রিজ থেকে নীচে পুকুরের মধ্যে পড়ে গেল। সর্বনাশ! সেই দৃশ্য দেখে আতঙ্কে সবাই কাঁদতে শুরু করেছে। পুকুরে জল অবশ্য কমই ছিল। বিশুদা সেই গাড়ি থেকে প্রথমে মান্নাদাকে বের করে নিয়ে এলেন। তারপর বাকি সবাইকে। সবাই প্রচণ্ড বিচলিত। অবিচলিত শুধু মান্নাদা। বললেন, ‘‘এখন হা-হুতাশ করে লাভ নেই। আগে থানায় চলো। গাড়িটা তো তুলতে হবে।’’
সবাই তখন মানসিক প্রস্তুতি নিয়ে ফেলেছে। এক্ষুনি মান্নাদাকে নিয়ে কলকাতায় ফেরা দরকার। এই বয়সে ওই ভাবে পড়ে গেছেন। কোনও ইনটার্নাল ইনজুরি হতে পারে। তা ছাড়া প্রবল মানসিক ধকল তো আছেই। কিন্তু মান্নাদা কারও কথায় কর্ণপাত না করে বললেন, ‘‘খারাপ কিছু হতে পারত। তা তো হয়নি। তোমরা এত ভাবছ কেন? চলো, ভালভাবে অনুষ্ঠানটা করে দিয়ে আসি।’’ মান্নাদার কাছে আগে গান, পরে প্রাণ।
এমন ঘটনা বহুবার ঘটেছে। কোনও প্রোজেক্টে হয়তো মান্নাদা কোনও ভাবেই যুক্ত নন, কিন্তু প্রয়োজনে সব রকম সাহায্যের জন্য তিনি এগিয়ে যেতেন। রতু মুখোপাধ্যায়ের সুরে মান্নাদা বহু গান গেয়েছেন। অধিকাংশ গানই কালজয়ী। যেমন— ‘আবার হবে তো দেখা’, ‘দেখি ওই হাসির ঝিলিক’, ‘হৃদয়ের গান শিখে তো গায় গো সবাই’, ‘রাতজাগা দুটি চোখ’, ‘রিমঝিমঝিম বৃষ্টি’, ‘অভিমানে চলে যেও না’ ইত্যাদি। একবার রতুবাবুর সুরে গাইবেন সুমন কল্যাণপুর। চমৎকার একটি গান। পুলক বন্দ্যোপাধ্যায়ের লেখা—‘মনে করো আমি নেই, বসন্ত এসে গেছে’। সমস্যা হল, যখন বোম্বেতে রেকর্ডিং হওয়ার কথা, সেই সময় রতুবাবুর পক্ষে কিছুতেই যাওয়া সম্ভব নয়। রেকর্ডিং-এর দিন বদলাবারও উপায় নেই। হ্যাঁ, এখানেও মুশকিল আসান মান্নাদা। রতুবাবুর অনুরোধে মান্নাদা নিজেই সুপারভাইজ করে সুমন কল্যাণপুরকে দিয়ে সে-গান গাইয়ে দিলেন। মুকেশের গাওয়া রতু মুখোপাধ্যায়ের সুরে ‘ওগো আবার নতুন করে ভুলে যাওয়া নাম ধরে ডেকো না’ গানটির রেকর্ডিং-এর সময়ও একই ঘটনা ঘটেছিল। রতুবাবুর অনুপস্থিতিতে মান্নাদাই ওই গান বোম্বেতে মুকেশকে দিয়ে রেকর্ড করিয়েছিলেন। ভাবতে অবাক লাগে, মান্নাদা তখন ভারতের কিংবদন্তি গায়ক। শুধু শ্রোতারাই নন, লতা, রফি, কিশোর, তালাত, আশা—সবাই তাঁকে অত্যন্ত শ্রদ্ধার চোখে দেখেন। তিনি কিনা অন্যের সুর নিজে তত্ত্বাবধান করে রেকর্ড করাচ্ছেন অবাঙালি শিল্পীদের দিয়ে। উচ্চারণ এবং সুর—দু’দিকই মান্নাদাকে দেখতে হয়েছিল। সেই সব গান তো অমর হয়ে আছে, তা সবাই জানেন। কিন্তু অনেকেই জানেন না ওই সব গানের সৃষ্টিতে মান্নাদার ভূমিকা। নামটাম নিয়ে তিনি কোনও দিন মাথা ঘামাতেন না। ওঁর কাছে কাজটাই আসল।
সেবার হৈমন্তীদি গাইবেন নৌশাদের সুরে। পুজোর গান। একটা দারুণ ব্যাপার। বাংলাগানে সুর করছেন নৌশাদ। বোম্বের এইচএমভি-তে রেকর্ডিং। কথা লিখেছেন রবীন্দ্র জৈন—‘বিকেল হলেই তোমায় মনে পড়ে’। মিউজিক অ্যারেঞ্জমেন্ট করছেন উত্তম সিং। মান্নাদা নিজে স্টুডিওয় এসে নৌশাদকে ধন্যবাদ জানিয়ে গেলেন বাংলাগানে সুর করার জন্য। কিন্তু একটা সমস্যা হল। রেকর্ডিং-এর সময় কিছু টাকা কম পড়ে গেল। এই বিদেশ-বিভুঁয়ে টাকাটা জোগাড় হবে কী ভাবে? মুহূর্তের মধ্যে একটা নামই সবার মাথায় এসে গেল। মান্নাদা। মান্নাদার কাছে ফোন যেতে সহাস্য আমন্ত্রণ—‘চইলা আইস’।
‘চারমূর্তি’ ছবিতে মান্নাদার গাওয়া ‘ভারত আমার, ভারতবর্ষ’ গানটি তো আজও জনপ্রিয়তার শীর্ষে। ইদানীং কালের বোধয় সব থেকে জনপ্রিয় বাংলা দেশাত্মবোধক গান। প্রথমে ঠিক ছিল ছবিতে ‘বঙ্গ আমার জননী আমার’ গানটি ব্যবহার করা হবে। ছবির পরিচালক এমনটাই চেয়েছিলেন। সুরকার অজয় দাসের ভাবনাটা ছিল একটু অন্য রকম। একই ছন্দে শিবদাস বন্দ্যোপাধ্যায়কে দিয়ে লেখালেন, ‘ভারত আমার ভারতবর্ষ’, মান্নাদাকে দিয়ে একটি কালজয়ী গান সৃষ্টির তাগিদে। এটাই ঘটনা। যখনই যে-আশা নিয়ে মান্নাদার কাছে কেউ গিয়েছে, তিনি সেই আশা পূরণ করেছেন বারবার।
অনেক সময় এমনও হয়েছে যে সঙ্গীত পরিচালক নিজেই একজন সুগায়ক। কোনও একটি গান তৈরি করেছেন নিজে গাইবেন বলে। পরে মান্নাদার কথা ভেবে সেই মত পাল্টেও গেছে। ওই যে বলছিলাম মান্নাদার কাছে সবার খুব প্রত্যাশা। ‘সওদাগর’ ছবিতে সুর করেছেন রবীন্দ্র জৈন। বাংলার সঙ্গে তার খুবই যোগাযোগ। তাকে প্রায়-বাঙালিই বলা যায়। শুধু সুর নয়, বাংলায় অনেক গানও লিখেছেন। ভাটিয়ালির উপরে একটা গান তৈরি করলেন—‘দূর হ্যায় কিনারা, বহতি নদী কি ধারা’। একদম নিজের কথা ভেবে গানটি বাঁধা। গাইতে গাইতে হঠাৎ তার মনে হল, এই গান নিজে না গেয়ে যদি মান্নাদাকে দিয়ে গাওয়ান, তবে কেমন হয়? দক্ষ সুরকারেরা সুর তৈরির সময়ই বুঝতে পারেন কোন শিল্পী গাইলে গানটি সর্বোত্তম হবে। যা ভাবা তাই কাজ। রবীন্দ্র জৈন পরিচালক-প্রযোজককে জানালেন, তিনি নিজে না গেয়ে মান্নাদাকে দিয়ে গাওয়াতে চান। সবাই এক কথায় রাজি। মান্নাদা গাইলেন। রবীন্দ্র জৈনর আশা তো পূরণ হলই, মান্নাদা তাকে একজন হাইক্লাস সুরকারে উত্তীর্ণ করলেন। এ গানের সঙ্গে অমর হয়ে রইল হরিপ্রসাদ চৌরাশিয়ার বাঁশিও। এই যে আত্মবিশ্বাস পেয়ে গেলেন রবীন্দ্র জৈন, এরপর মান্নদাকে দিয়ে গাওয়ালেন আরও কিছু ভিন্নধর্মী গান। ‘আইয়ানা’ ছবিতে বাংলা ফোকের উপরে একটি অসাধারণ ডুয়েট গান গাইয়েছিলেন মান্নাদা এবং যেশুদাসকে দিয়ে। আর যখন ‘গোরা কুম্ভর’ ছবিতে দারুণ একটা ভজন তৈরি করলেন ‘লাখ রূপ তেরে’, তখন শিল্পী হিসেবে একজনের নামই মনে এসেছিল। মান্না দে, শুধুই মান্না দে।
শুধু মান্নাদার জন্যই অনেক গীতিকার-সুরকার-পরিচালক জীবনে সাফল্য পেয়েছেন। ইতিহাস-স্বীকৃত এই কথা। কেউ যখন মান্নাদাকে সেই কথা বলতে গেছেন, মান্নাদা তখন অত্যন্ত বিব্রত ভাবে বলেছেন, ‘‘না, না। আমি কিছুই না। আমি তো শুধু সামান্য একটু গাইতে পারি। এখনও কত কিছু শেখার আছে।’’
সত্যি মান্নাদা, সর্বশিক্ষায় শিক্ষিত হয়েও শুধু আপনিই এ কথা বলতে পারেন।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy