বাইরে দু’ধারে কোমর অবধি বরফ। নাক ছাড়া সব ঢাকা। স্পাইক দেওয়া জুতো ছাড়া হাঁটলেই পড়ে যাওয়ার আশঙ্কা। দিনের বেলার তাপমাত্রাই মাইনাস চার। রাতে মাইনাস ১০ ডিগ্রি সেলসিয়াস। ইউনিটের টেকনিশিয়ান থেকে আর্টিস্ট সবাই কমবেশি অসুস্থ। সঙ্গে রয়েছে স্নো লেপার্ড আর ভালুকের উৎপাত। শ্যুটিং যেখানে হবে তার আশেপাশের বরফে ছড়িয়ে ছটিয়ে রয়েছে স্নো লেপার্ডের ফেলে যাওয়া মাংসের টুকরো। বরফের উপর চাপ চাপ রক্তের দাগ।
যেখানে শ্যুটিং হচ্ছে সেই রাস্তায় ব্রেক কষলেই গাড়ি খাদের ধারে চলে যাচ্ছে। যে রাস্তা দিয়ে শ্যুটিংয়ে যেতে হচ্ছে সেটা আর একটু সরু হলেই আর রাস্তা বলা যাবে না। রাস্তার স্লোপ কলকাতার বিভিন্ন পার্কের স্লিপের থেকেও বেশি ঢালু। সেটা দিয়ে সোজাসুজি নয়, রিভার্স গিয়ারে ফোর হুইল ড্রাইভের গাড়িটা নামছে প্রায় তিরিশ ফুট।
খোলা আকাশের নীচে দাঁড়ালেই বরফের ঝড় উড়িয়ে নিয়ে যাচ্ছে মাথার টুপি। রাত সাতটার পর কেউ নেই পুরো শহরে। ছত্রে ছত্রে শুধু গভীর বিপন্নতা।
ওয়েলকাম টু নারকান্ডা।
শিমলা থেকে কুফরি ক্রস করে আরও তিন ঘণ্টা ওপরে গেলে ছোট্ট এই পাহাড়ি শহর। এমনিতে স্কিয়িংয়ের জন্য বিখ্যাত। সমতলভূমি থেকে ২৭০৮ ফুট উপরে।
এখানেই কৌশিক গঙ্গোপাধ্যায় পরিচালিত ‘ধূমকেতু’র শেষ শিডিউলের শ্যুটিং চলছে। বিপন্নতা ছাড়াও আর একজন হিরো রয়েছে এই শ্যুটিংয়ে। তিনি নায়ক দেব।
এই শ্যুটিংয়ে তিনি একই সঙ্গে ক্যাপ্টেন এবং কোচ। পরিস্থিতি তাঁর মুকুটে এই দুই পালক গুঁজেছে।
কিন্তু কী পরিস্থিতি? কেনই বা তিনি ক্যাপ্টেন কাম কোচ?
আমার হাত-পা কেটে নিলেও বুঝতে পারব না
কাট টু নারকান্ডা।
সেখানে তখন যুদ্ধকালীন তৎপরতায় চলেছে শ্যুটিং। পুরো ইউনিটের কেউ ছুটতে পারছে না, ছুটলেই দম বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। বরফের মধ্যেই একটা ছোট্ট মাটির ঘরে চলেছে নানা প্রপ বানানোর কাজ। অন্য দিকে ছবির যুগ্ম প্রোডিউসর হিসেবে দেবের মুখে প্রচণ্ড টেনশন।
‘‘এই ঠান্ডায় সবার বিশাল শ্বাসকষ্ট হচ্ছে। তার ওপর টিমের ক্যাপ্টেন নেই। আমি ‘চাঁদের পাহাড়’ ছাড়া এত টাফ শিডিউলে কোনও দিন কাজ করিনি। কিন্তু কষ্ট হলেও আমি সেটা দেখাতে পারছি না। যদি দেখাই তো টিমের মনোবলটাই নষ্ট হয়ে যাবে,’’ বরফের ওপর চেয়ারে বসে বলছেন দেব।
কিন্তু টিমের ক্যাপ্টেন কে? তিনি কেনই বা নেই?
এখানে জানিয়ে রাখা প্রয়োজন, নারকান্ডায় এই ঠান্ডায় অসম্ভব মাউন্টেন সিকনেসে আক্রান্ত হয়ে ছবির ক্যাপ্টেন কাম পরিচালক কৌশিক গঙ্গোপাধ্যায় ফিরে গিয়েছেন কলকাতায়।
কৌশিক না থাকাতে পুরো টিমের দায়িত্ব একা নিজের কাঁধে নিয়ে নিয়েছেন ছবির অন্যতম প্রযোজক দেব নিজেই। কে কখন খাবে? কাকে গাড়ি পাঠানো হবে? কলকাতায় কৌশিকের সঙ্গে আলোচনা — সবেতেই তিনি।
সব অর্থেই এ যেন হিমালয়ে দেব দর্শন।
শ্যুটিংয়ে পৌঁছে দেখলাম ক্যামেরাম্যান সৌমিক এবং কৌশিকের অ্যাসিস্ট্যান্ট চন্দ্রাশিসের সঙ্গে সিনটা কী ভাবে হবে তাই নিয়ে আলোচনা করছেন দেব।
তা হলে কি একটা ছবিতেই আপনি প্রযোজকের পাশাপাশি পরিচালকও হয়ে গেলেন? কোচ কাম ক্যাপ্টেন?
প্রশ্ন শুনে হেসে ফেলেন দেব, ‘‘না না আমি একা কই? সবাই ইনপুটস দিচ্ছে।’’
কারও সঙ্গী বরফ... কারও সঙ্গী শুভশ্রী ----ছবি: ইন্দ্রনীল রায়
সবাই মিলে আমরা কাজ না করলে এই শিডিউল তুলতেই পারব না”, বলছিলেন দেব।
তিনি যখন কথা বলছিলেন তখন তিন জন মিলে গরম সর্ষের তেল ঘষছে তার পায়ে। কারণ? কারণ তার আগেই শুধু গেঞ্জি পরে ওই ঠান্ডায় শট দিয়েছেন তিনি।
‘‘আমার হাত-পায়ের আর কিছু নেই। মনে হচ্ছে কেউ কেটে দিলেও আমার কোনও ব্যথা লাগবে না। একটু আগে হাতের ওপর ভর দিয়ে উঠতেই পারছিলাম না। জোরই নেই হাতে আমার। পুরো হাত-পা অবশ হয়ে গেছে। কিন্তু আমি পরে আপশোস করতে চাই না। আমি হান্ড্রেড পার্সেন্ট দিতে চাই,’’ বলেন দেব।
আমার আর দেবের কেমিস্ট্রিটাই ন্যাচারাল
নারকান্ডার এই ঠান্ডার মধ্যে দু’টো জিনিসই যা একটু উষ্ণ। প্রথমটা অবশ্যই খাবার। কৌশিক গঙ্গোপাধ্যায়ের ইউনিট বলে ওই ঠান্ডার মধ্যেও খাবার নিয়ে কোনও কমপ্রোমাইজ নেই। বরফের মধ্যেও লা়ঞ্চ মেনুতে গরম খিচুড়ি, আলু ভাজা আর ওমলেট। তা ছাড়া চাইনিজও। ‘‘চিন তো কাছেই, তাই চিলি চিকেন-ফ্রায়েড রাইসও রেখেছিলাম,’’ রসিকতা করে পরে বলছিলেন কৌশিক।
খাবার ছাড়াও আর একটা উষ্ণতা কারও নজর এড়ায়নি। সেটা দেব আর শুভশ্রীর রসায়ন। বরফে ছবি তোলার সময় খুনসুটি থেকে রাতে একসঙ্গে ডিনার — এই ছবির শ্যুটিং শেষ হওয়ার আগেই সব অর্থে ‘প্রত্যাবর্তন’ ঘটেছে দেব-শুভশ্রী জুটির।
প্রথম দিনের আড়ষ্টতা কাটিয়ে আপাতত তাঁরা পুরনো দিনের মতোই স্বতঃস্ফূর্ত ও সাবলীল। তাঁদের নিয়ে টালিগঞ্জে গসিপের গ্রাফ কিন্তু শিমলা শ্যুটিংয়ের পর থেকেই ঊর্ধ্বগামী।
‘‘গসিপ কে করছে জানি না, তবে আমার আর দেবের কেমিস্ট্রিটা অসম্ভব ন্যাচারাল। ওটা আমরা সিনেমা করলেও থাকবে, না করলেও থাকবে। চার বছর পর আমরা ছবি করছি, কিন্তু আজকেও কেমিস্ট্রির কোনও বদল হয়নি। হবেও না। আমরা হয়তো ‘ধূমকেতু’ দিয়ে ফিরে এলাম, কিন্তু আমাদের জুটির কামব্যাকটা ছিল শুধু সময়ের অপেক্ষা। আমরা ফিরতামই। উই ওয়ার ডেসটিন্ড টু মেক আ কামব্যাক,’’ বেশ জোরের সঙ্গেই বলছেন শুভশ্রী।
আসলে এই বছরটাই বোধহয় পুরনো জুটির কামব্যাকের বছর। প্রথমে ঋতুপর্ণা-প্রসেনজিতের ‘প্রাক্তন’, তারপর ‘ধূমকেতু’তে দেব-শুভশ্রী। সে পরের কথা। এখন ব্যাক টু নারকান্ডা।
মনে হচ্ছিল বাড়ির লোককে দেখতে পাব না আর
উচ্চতার জন্য নারকান্ডায় অক্সিজেনের মাত্রা যথেষ্ট কম। সূর্য ডোবার পর থেকেই ইউনিটের সকলের মনে হচ্ছে কেউ গলা টিপে ধরছে। চার লেয়ারের সোয়েটার পড়লেও ঠান্ডা এক বিন্দু কমছে না। ঘরে হিটারের অবস্থা মদন মিত্রের মতো। থেকেও নেই। বেশির ভাগ ইউনিটের লোক হোটেলের দরজা খুলে ঘুমোচ্ছে এক্সট্রা অক্সিজেনের জন্য। সিগারেটে দু মিনিট টান না দিলেই নিভে যাচ্ছে। গরম চা বাইরে রাখলে সেটা এক মুহূর্তে ফ্রিজের জলের মতো ঠান্ডা।
চূড়ান্ত ‘মাউন্টেন সিকনেস’য়ে আক্রান্ত হয়ে যে কলকাতায় ফিরে গিয়েছেন পরিচালক কৌশিক গঙ্গোপাধ্যায় — আগেই বলেছি। ‘‘প্রথম দিন আড়াই ঘণ্টা বরফে ভিজেছিলাম। একটা ধকল তো ছিলই। সারাদিন কোনও অসুবিধে হচ্ছিল না, কিন্তু সন্ধ্যা হলেই মনে হচ্ছিল নিঃশ্বাস নিতে পারব না। দু’রাত্তির ছিলাম। কিন্তু তৃতীয় রাতে ‘মাউন্টেন সিকনেস’টা বেড়ে যায়। তখন মনে হচ্ছিল বাড়ির লোককে আর দেখতে পাব না। ডাক্তার ইমিডিয়েটলি দু’হাজার ফুট নীচে নেমে আসতে বলেছিল,’’ ফিরে এসেও বেশ আতঙ্কের সঙ্গেই বলছিলেন কৌশিক।
সেট ছেড়ে কৌশিকের এ ভাবে ফিরে যাওয়াটা পুরো ‘ধূমকেতু’ টিমকেই বিভ্রান্ত করে দিয়েছিল।
‘‘এই প্রথম আমি আমার সেট ছেড়ে বেরিয়ে এলাম শ্যুটিং শেষ না করে। তবে আমার অনুপস্থিতিতে যে ভাবে দেব, ছবির ক্যামেরাম্যান সৌমিক হালদার, আমার অ্যাসিস্ট্যান্ট চন্দ্রাশিস রায়, আর কলকাতায় রানা সরকার কাজ করেছে তাতে আমি ওদের কাছে বিরাট থ্যাঙ্কফুল। হ্যাঁ পাহাড় এ বার আমায় হয়তো গলা ধাক্কা দিয়ে নামিয়ে দিয়েছে, কিন্তু আমি আবার পাহাড়ে ফিরবই।’’ আত্মবিশ্বাসের সঙ্গেই বলছেন কৌশিক।
সঙ্গে তখন ওল্ড মঙ্ক আর লাল মাংসের ঝোল
ছবির গল্পটা এখানে বলা ঠিক হবে না। কিন্তু নারকান্ডার এই শ্যুটিংয়ের বিষয়বস্তু একটি বড় ‘মিশন’য়ে যাওয়ার আগে দেবের প্রস্তুতি। যেখানে দেবকে তৈরি করছেন তাঁর ‘গুরু’ চির়ঞ্জিত চক্রবর্তী। চিরঞ্জিতও ঠান্ডায় যথেষ্ট কাবু, কিন্তু ওই ঠান্ডার মধ্যেও প্রত্যেক সন্ধেবেলা তাঁর ঘরে চলছে আড্ডা। কখনও উত্তমকুমার, কখনও সমিত ভঞ্জ, কখনও সত্যজিৎ রায়— চিরঞ্জিতের গল্পের শেষ নেই। মন্ত্রমুগ্ধের মতো সেই গল্পের শ্রোতা তখন দেব, শুভশ্রী, রুদ্রনীল। সঙ্গে ওল্ড মঙ্ক, ডিম ভুর্জি আর লাল মাংসের ঝোল।
‘‘আমি ভীষণ এনজয় করছি এই শিডিউলটা। পুরো টিমটা দারুণ ছিল। আর এটা সত্যি, এই শিডিউল আমার জীবনের অন্যতম সেরা অভিজ্ঞতা,’’ কলকাতায় ফিরে বলছিলেন চিরঞ্জিত।
অন্য দিকে রুদ্রনীলের শ্যুটিং ছিল না নারকান্ডায়। তাঁর শ্যুটিং একদিন শিমলায়, যা এই ছবিতে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ একটা সিন।
‘‘এই ছবিতে আমি আমার বডি ল্যাঙ্গোয়েজটা বদলেছি। পুরো ছবিতে পায়ের চেটোটা বেঁকিয়ে বেঁকিয়ে হেঁটেছি। সেটা অসম্ভব কষ্টের, যে কোনও সময় ডিসলোকেশনের চান্স ছিল। তব আমি এখনই কনফিডেন্ট যে এ বছরের অন্যতম সেরা ছবি হবে ‘ধূমকেতু’,’’ নারকান্ডায় বরফের সামনে সেলফি তুলতে তুলতে বলছিলেন রুদ্রনীল।
অন্য দিকে কলকাতায় বসে রানা সরকার যুদ্ধকালীন পরিস্থিতিতে ব্যাকরুম সামলেছেন। ‘‘এত টেনশনের শ্যুটিং আমি আগে করিনি। টেনশনের মাত্রাগুলো আলাদা। কখনও ফোন আসছে ব্রেক কষলে গাড়ি খাদে চলে যাচ্ছে। কখনও ফোন আসছে পুরো ইউনিট চার ঘণ্টা বরফে দাঁড়িয়ে ভিজছে। ‘ধূমকেতু’ সত্যি আমাদের কাছে একটা এক্সপেরিয়েন্স হয়ে থাকবে,’’ বলছিলেন রানা সরকার।
এ রকম দুর্গম শ্যুটিংয়ের শেষে কলকাতায় ফিরে আসার পর পুরীতে জগন্নাথ মন্দিরে পুজোও দিয়েছেন প্রযোজক।
পুরো শিডিউল নিয়ে শেষ কথা অবশ্য বলছেন পরিচালক কৌশিক গঙ্গোপাধ্যায় নিজে।
‘‘যে টিম ক্যাপ্টেন আউট হওয়ার পরেও ম্যাচ বার করে নেয়, সেই টিমকে শ্রদ্ধা জানানোই উচিত। আর বরফ ভেঙে যে অসাধ্য সাধন করল সবাই, এর পর ‘ধূমকেতু’র ভবিষ্যৎ নিয়ে অন্তত আমরা আর ভাবিত নয়,’’ বলেন পরিচালক।
আর কি কোনও দিন ‘নারকান্ডা’ ফিরবেন শ্যুটিংয়ের জন্য?
‘‘পাগল নাকি?’’ হেসে ওঠেন কৌশিক।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy