Advertisement
E-Paper

সরল মানুষের সঙ্গে মিশে অভ্যস্ত, কেউ মাতব্বরি করছে দেখলে ভাল লাগে না, ছোটরাই ভাল: সৌকর্য

আগামী প্রজন্ম প্রযুক্তিকে হাতিয়ার বানাবে না, প্রযুক্তির কাছে আত্মসমর্পণ করবে— তাই নিয়ে যথেষ্ট উদ্বিগ্ন পরিচালক।

উপালি মুখোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ১২ জুন ২০২৫ ০৮:৫৭
‘পক্ষীরাজের ডিম’ ছবির শুটিংয়ে সৌকর্য ঘোষাল, অনুমেঘা বন্দ্যোপাধ্যায়।

‘পক্ষীরাজের ডিম’ ছবির শুটিংয়ে সৌকর্য ঘোষাল, অনুমেঘা বন্দ্যোপাধ্যায়। ছবি: সংগৃহীত।

ওঁর প্রত্যেক ছবিতে শিশুদের গল্প। ছোটদের কল্পনার জগতে ভাসিয়ে নিয়ে যেতে ভালবাসেন। শুধুই ছবি বানানো? এখনও তাঁর সবচেয়ে ভাল বন্ধু শিশুরাই! পরিচালক সৌকর্য ঘোষাল কি কোনও দিন বড় হবেন না? কল্পবিজ্ঞানের গল্প ছেড়ে রাজনৈতিক গল্প বলবেন না? ‘পক্ষীরাজের ডিম’ মুক্তির আগে পরিচালকের মুখোমুখি আনন্দবাজার ডট কম।

প্রশ্ন: ‘পক্ষীরাজের ডিম’ মুক্তি পেতে পেতে দুই শিশুশিল্পী অনুমেঘা বন্দ্যোপাধ্যায়, মহাব্রত বসু যে বড় হয়ে গেল!

সৌকর্য: আমার ‘রেনবো জেলি’র পর এই ছবি। সাত বছরের ব্যবধান। ওরা কৈশোর পেরিয়ে বয়ঃসন্ধিতে ঢুকছে, এই সময়টাই ছবিতে দেখাতে চেয়েছি। তাই ইচ্ছা করে এই ব্যবধান। ২০২৩-এর মে মাসে শ্রীকান্ত মোহতা, মহেন্দ্র সোনিকে গল্প শুনিয়েছিলাম। ওই বছরের অগস্টে শুটিং। ২০২৫-এ ছবি মুক্তি পাচ্ছে।

প্রশ্ন: আমরা কথায় কথায় ‘ঘোড়ার ডিম’ প্রবাদ খুব ব্যবহার করি, পক্ষীরাজও তো ঘোড়া-ই?

সৌকর্য: (মৃদু হেসে) জানি তো। ‘ঘোড়ার ডিম’ মানে ছাইপাঁশ, দুচ্ছাই করেন সকলে। কিন্তু যখনই সেটা পক্ষীরাজ হয় তখনই সেটা কল্পনার জগতে পাড়ি জমায়। তার মধ্যে যেন জাদু রয়েছে। যারা সেটা দেখতে পারছে তারা বুঝতে পারছে। এটা নিয়েই গল্প।

প্রশ্ন: এখন যারা বয়ঃসন্ধিতে তারা কি কল্পনার দুনিয়ায়, রূপকথার রাজ্যে বিচরণ করে? মুঠোফোনই তো জগৎ...

সৌকর্য: তাই কি? আমার কিন্তু অন্য ধারণা। এই প্রজন্মের বয়ঃসন্ধি কল্পরাজ্যে বিচরণ না করলে ‘মার্ভেল’ এত হিট করত না। পুরোটাই ফ্যান্টাসি। আরও ছোটরা পাগলের মতো ‘পেপাপিগ’ দেখে। সেটাও দেখত না। আগেও রূপকথার চাহিদা ছিল। সমাজমাধ্যমের দৌলতে সেই চাহিদা আরও বেড়েছে। যার ফলে এখন বড়রাও ফ্যান্টাসি ছবি দেখতে ভালবাসেন। তাই বলিউডে সাম্প্রতিক বাণিজ্যসফল ছবির বেশির ভাগেই কল্পনার ছোঁয়া আছে।

বিশেষ দৃশ্যে অনুমেঘা বন্দ্যোপাধ্যায়, মহাব্রত বসু।

বিশেষ দৃশ্যে অনুমেঘা বন্দ্যোপাধ্যায়, মহাব্রত বসু। ছবি: সংগৃহীত।

প্রশ্ন: বাংলায় কি রূপকথার ছবির সংখ্যা কম?

সৌকর্য: করে না কেউ, তাই। করলেই দর্শক দেখবে। আমি ‘রেনবো জেলি’ করে ভাল সাড়া পেয়েছি। এটি বাণিজ্যসফল। এর পর জয়া আহসানকে নিয়ে ‘ভূতপরী’ করলাম। ৭৫ দিন টানা হাউসফুল হল। ভাল ব্যবসাও করল। আরও একটা কথা, বাংলার দর্শকও রূপকথা পছন্দ করেন বলেই সত্যজিৎ রায়ের ‘গুপি গাইন বাঘা বাইন’ এত হিট। আজও সব বয়সের প্ৰিয়।

প্রশ্ন: ওই জন্যই কি সৌকর্য স্রোতে গা ভাসিয়ে ভূত বা গোয়েন্দা ছবি না বানিয়ে রূপকথা বেছে নিয়েছেন?

সৌকর্য: (একটু হেসে) আমার বেড়ে ওঠা সত্যজিৎ রায়, লীলা মজুমদার শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ের লেখা পড়ে। রূপকথা আমার জিনে ঢুকে গিয়েছে। এই ঘরানার ছবি বেশি ভাল বানাতে পারি। তাই ব্যতিক্রমী কিছু করব বলে নয়। ওটাই আমার শক্তি বলে। এও মনে হয়েছে, ‘রেনবো জেলি’র মতো ফুড ফ্যান্টাসি সকলের প্রশংসা পাওয়ার পর ওই গল্পকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া দরকার।

প্রশ্ন: আরও একটি বৈশিষ্ট্য আছে, তথাকথিত তারকাখচিত ছবি বানান না...

সৌকর্য: সেটা যে সব সময়েই হয় বলব না। ‘রক্ত রহস্য’তে কোয়েল মল্লিক ছিলেন। আবার ‘ভূত পরী’তে জয়া আহসান, ঋত্বিক চক্রবর্তী। আমার ছবিতে বাচ্চারা থাকবেই, এটা বলতে পারেন। আমার মতে, ওরা জীবনের সব চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ। আসলে, আমি গল্পকে প্রাধান্য দিয়ে চরিত্র বাছি। সেই অনুযায়ী কোনও তারকা, কখনও ভাল অভিনেতাকে বেছে নিই।

প্রশ্ন: ‘পক্ষীরাজের ডিম’-এর মতো জিনিসটা কী করে বানালেন?

সৌকর্য: আমি চিত্রনাট্যের পাশাপাশি ছবির চরিত্রদের আঁকি। আমার কাছে বিষয়টি আঁকা ছিল। সেটা দেখে তৈরি করা হয়েছে।

প্রশ্ন: সত্যজিৎ রায়ের ছাঁচে নিজেকে গড়ছেন?

সৌকর্য: সেই স্পর্ধাই নেই! আসলে, আমিও পেশায় অলঙ্করণশিল্পী ছিলাম। সেখান থেকে পরিচালনায় আসা। তাই চিত্রনাট্যের পাশাপাশি ছবি আঁকার অভ্যাস রয়েছে। সত্যজিৎ রায়কে অনুসরণ বা অনুকরণ করার স্পর্ধাই আমার নেই। করা সম্ভবও নয়। উনি আমাদের থেকে অনেক আলোকবর্ষ দূরে। ওঁর পরবর্তী দু’-একজন পরিচালক ওঁর কাছাকাছি তবু যেতে পেরেছিলেন। এই পথগুলো সত্যজিৎ দেখিয়ে, শিখিয়ে গিয়েছেন। আমি সেটাই করার চেষ্টা করি মাত্র। তাতে ছবি তৈরির কাজ নিখুঁত হয়। শুধুই ‘পক্ষীরাজের ডিম’ নয়, গল্পে বা মন্দিরের আর্কিটেকচার ড্রয়িংটাও করেছিলাম। এতে যেমন চেয়েছি, মন্দির হুবহু সে রকমই বানানো সম্ভব হয়েছে।

প্রশ্ন: সত্যজিৎ রায়-মৃণাল সেন-ঋত্বিক ঘটককে ‘নমস্য ব্যক্তি’ বানিয়ে না রেখে যদি তাঁদের ছাঁচে বাকিরা নিজেদের তৈরি করতেন তা হলে বোধহয় এত বড় ফাঁক তৈরি হত না। ওঁদের পরে তপন সিংহ, তরুণ মজুমদার। তার পর আর কই?

সৌকর্য: মানছি, বিরাট ফাঁক। ওঁদের সমকক্ষ আর কেউ হতে পারেননি। বর্তমানের বিশ্বসিনেমার দুনিয়ার দিকে তাকিয়ে দেখুন। সার্বিক আলোচনা করুন সকলের সঙ্গে। দেখবেন সারা বিশ্ব জুড়ে এই ফাঁক। বিদেশে সেই মাপের এখনও পর্যন্ত সর্বশেষ পরিচালক ক্রিস্টোফার নোলান। তাঁরও বয়স ৬০ হয়ে গিয়েছে। তাঁর পরের প্রজন্ম বলতে উদাহরণ দেওয়ার মতো আর কেউ নেই। আমাদের দেশে এ রকম শেষ পরিচালক রাজামৌলি। আর কেউ উদাহরণ দেওয়ার মতোই নেই! এর কারণও আছে। এখন ছবি তৈরির পদ্ধতি এমন স্টুডিয়োভিত্তিক হয়ে গিয়েছে যে পরিচালকদের অভ্যাসও বদলে গিয়েছে। অনেক ভাল ছবি তার মধ্যেও হয়েছে। কিন্তু আগের মতো পরিচালকদের নিয়ে আলোচনাও হয় না। যেমন, চৈতন্য তামহানে। মরাঠি ছবি বানান। প্রথম ছবি ‘কোর্ট’, পরের ছবি ‘ডিসাইপল’। তামহানে ভেনিসে সেরা চিত্রনাট্যকারের সম্মান পেয়েছেন। যা আমাদের দেশে আর কেউ পাননি। চৈতন্য তামহানেকে ক’জন চেনেন?

অনুমেঘা বন্দ্যোপাধ্যায়, মহাব্রত বসু।

অনুমেঘা বন্দ্যোপাধ্যায়, মহাব্রত বসু। ছবি: সংগৃহীত।

প্রশ্ন: ছবি ব্যর্থ হলে কিন্তু পরিচালকদের ঘাড়েই দায় চাপে। জুনে আপনার সঙ্গে আরও ছবি মুক্তি পাচ্ছে। ‘পক্ষীরাজের ডিম’-এর ব্যবসায়িক সাফল্য নিয়ে ভেবেছেন?

সৌকর্য: আমি যখন ২০১৮-য় ‘রেনবো জেলি’ বানিয়েছিলাম তখন ‘হামি’ আর ‘উমা’র সঙ্গে ছবিটি মুক্তি পেয়েছিল। মোট তিনটে বাচ্চাদের ছবি। তার পরেও আমার প্রযোজনায় তৈরি ‘রেনবো জেলি’ দুর্দান্ত ফল করেছিল। ফলে, সবটাই দর্শকদের উপরে ছেড়ে দিতে চাই। দর্শকের ভাল লাগলে দেখবে, না ভাল লাগলে দেখবে না। এর থেকে বড় অঙ্ক বা সত্য আর কিচ্ছু নেই।

প্রশ্ন: ছবির ট্রেলারে আছে, স্বচ্ছ স্ফটিকের মতো দেখতে ‘পক্ষীরাজের ডিম’-এ চোখ রাখলে নাকি মানুষের অনুভূতি দেখা যায়। আপনার ছবি এখনকার মানুষের মনে ‘ইমোশন’ জাগাতে পারবে?

সৌকর্য: ‘পক্ষীরাজের ডিম’ মানুষের ভিতরের সত্যিটা দেখাবে। ধরুন, আপনার বিরুদ্ধে কেউ ছুরি শানাচ্ছে। এ দিকে সামনে এমন হেসে হেসে কথা বলছে যে আপনি ধরতেই পারছেন না। ‘পক্ষীরাজের ডিম’ সেই মানুষটির আসল চেহারা আপনাকে দেখিয়ে দেবে। অর্থাৎ, অনেকের ক্ষেত্রে এই ‘ডিম’ ব্যুমেরাং হয়ে ফিরতে পারে।

প্রশ্ন: আগামী দিনে ‘ প্রফেসর শঙ্কু’, লীলা মজুমদার বা শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ের কল্পবিজ্ঞানের গল্প নিয়ে ছবি বানাবেন?

সৌকর্য: ‘পক্ষীরাজের ডিম’ এই সব লেখকের মিলিত ফল। ছবি না দেখলে বোঝা সম্ভব নয়। এঁদের গল্প নিয়ে আলাদা করে ছবি বানানোর ইচ্ছে সকলের, আমারও। সুযোগ পেলে নিশ্চয়ই বানাব।

প্রশ্ন: সৌকর্য কি এখনও কোথাও ছেলেমানুষ, তাই ‘রেনবো জেলি’ বা ‘পক্ষীরাজের ডিম’ বানান?

সৌকর্য: এ ক্ষেত্রে আবারও সত্যজিৎ রায়ের থেকে ধার নিতে হচ্ছে। ‘আগন্তুক’ ছবিতে বিখ্যাত সংলাপ ধার করে বলছি, ‘সহজ-সরল মানুষের সঙ্গে মিশে অভ্যস্ত তো। কেউ মাতব্বরি করছে দেখলে ভাল লাগে না।’ ছোটদের সঙ্গে মিশে খুব আরাম, জানেন। ওরা সহজ-সরল, মারপ্যাঁচ নেই। অত ভেবেচিন্তে ওদের সঙ্গে কথা বলতে হয় না।

‘পক্ষীরাজের ডিম’ হাতে মহাব্রত বসু।

‘পক্ষীরাজের ডিম’ হাতে মহাব্রত বসু। ছবি: সংগৃহীত।

প্রশ্ন: নিজের স্বাচ্ছন্দ্য ছেড়ে কখনও বেরোবেন না! একটা রাজনৈতিক ছবি?

সৌকর্য: আমাদের দেশে রাজনৈতিক ছবি বানানো যায় না। যেটা হয় সেটা ‘হাফ বেকড’। সেন্সর বোর্ড আটকাবে। বিতর্কের কথা না হয় ছেড়েই দিলাম। স্বাধীনতার পর থেকে যত ছবি হয়েছে তার মধ্যে প্রকৃত রাজনৈতিক ছবি একটাও হয়নি। আর আমার ব্যক্তিগত মত, ছবিতে রাজনৈতিক বক্তব্য বলতেই হবে এই দায় সবাইকে না নিলেও চলবে। যেমন, কবিকে রাজনৈতিক কবিতা লিখতেই হবে এমন মাথার দিব্যি কেউ দেয়নি।

প্রশ্ন: প্রত্যেক প্রজন্মের একটাই আফসোস, পরের প্রজন্ম উচ্ছন্নে যাচ্ছে! ছোটদের সঙ্গে মিশে আপনারও কি এক মত?

সৌকর্য: আমরা ইন্টারনেটের সন্ধিক্ষণে বড় হয়েছিলাম। এই প্রজন্ম এআই-এর সন্ধিক্ষণে বড় হচ্ছে। হয় আগামী প্রজন্ম প্রযুক্তিকে করায়ত্ত করবে। নিজেদের উন্নততর পর্যায়ে তুলে নিয়ে যাবে। নয়তো প্রযুক্তি এদের গ্রাস করবে। তা হলে কিন্তু মেধা চলে যাবে। আমার প্রার্থনা, আগামী প্রজন্ম যেন প্রযুক্তিকে নিজের মুঠোয় পুরতে পারে।

Soukarya Ghosal Pokkhirajer Dim SVF
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy