Advertisement
E-Paper

এলিটের সামনে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখেছি সত্যজিৎকে

এটা কোনও আবেগ বিধুরতার প্রশ্ন নয়। সত্যজিৎ রায়কে সত্তর দশকে এই হলের সামনে একাধিক দিন দাঁড়িয়ে থাকতে দেখেছি। বিশেষত কোজিনেৎসেভ-এর ‘হ্যামলেট’ ছবিটি দেখানোর সময় বস্তুত, সত্যজিৎ মুগ্ধ ছাত্রের মতো খেয়াল করে যাচ্ছিলেন, হ্যামলেটের ভূমিকায় স্মকতুনোভস্কি-র চরিত্রায়ণ।

সঞ্জয় মুখোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ০৭ জুন ২০১৮ ১৮:৪৬
২ অগস্ট, ১৯৯৬। এলিট সিনেমায় চলছিল ‘কৃষ্ণা’। ছবি: আনন্দবাজার আর্কাইভের সৌজন্যে।

২ অগস্ট, ১৯৯৬। এলিট সিনেমায় চলছিল ‘কৃষ্ণা’। ছবি: আনন্দবাজার আর্কাইভের সৌজন্যে।

এলিট সিনেমা হলের ঝাঁপ পড়ে গেল। এমনিতে খুব বড় সংবাদ এটা নয়। কিন্তু, হয় কি, প্রত্যেক শহরেরই কিছু দিকচিহ্ন থাকে। যেমন সিনেমা হল, যেমন হোটেল লবি, যেমন বইয়ের দোকান। সে দিক থেকে দেখলে মধ্য কলকাতার সাহেবপাড়ায় মেট্রো বা এলিট জাতীয় ছবিঘরগুলো হয়ে উঠেছিল বাঙালি সংস্কৃতির মুখশ্রী। এলিটের পতনে আমাদের সাংস্কৃতিক দুঃস্থতা বেশ কয়েক গুণ বেড়ে গেল।

এটা কোনও আবেগ বিধুরতার প্রশ্ন নয়। সত্যজিৎ রায়কে সত্তর দশকে এই হলের সামনে একাধিক দিন দাঁড়িয়ে থাকতে দেখেছি। বিশেষত কোজিনেৎসেভ-এর ‘হ্যামলেট’ ছবিটি দেখানোর সময় বস্তুত, সত্যজিৎ মুগ্ধ ছাত্রের মতো খেয়াল করে যাচ্ছিলেন, হ্যামলেটের ভূমিকায় স্মকতুনোভস্কি-র চরিত্রায়ণ। স্বয়ং মৃণাল সেনের সঙ্গে আমি এই হলে দেখতে গেছি ফার্নান্দো সোলানাস-এর অবিস্মরণীয় ছবি ‘আওয়ার অফ ফার্নেসেস’। আশেপাশে কে নেই! গৌতম ঘোষ, অপর্ণা সেন, সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়, মোহিত চট্টোপাধ্যায়, আরও কত না গুণীজন।

তখনও কলকাতার চোখ এত গরিব হয়ে যায়নি। আমরা আন্তোনিওনি-র ‘ব্লোআপ’ দেখেছিলাম মেট্রোতে, এলিট-এ ভিসকন্তির ‘আউটসাইডার’। নিউ এম্পায়ারে ছিল মজা— ৭৫ পয়সার সব থেকে কম দামি টিকিটে দৌড়ে চার তলায় ওঠা। সেখানে অলিখিত ভাবে স্মোকিং অ্যালাউড। ভিসকন্তি-র ‘ডেথ ইন ভেনিস’ দেখতে দেখতে সিগারেট আমরা ঠোঁটছাড়া করিনি। সবচেয়ে দুর্দশাগ্রস্ত ছিল টাইগার। আজ দোকান। তারাও ক্লোদ লেলুশের ‘নারী-পুরুষ’ দেখাত।

আরও পড়ুন, ঐতিহ্য আর গর্বের মিশেল এলিট-ও বন্ধ হচ্ছে!

বিভূতিভূষণের অপু মেসে আশ্রয়দাতা অখিলবাবুকে জিগ্যেস করেছিল, বায়োস্কোপ যেখানে হয়, সেটা এখান থেকে কত দূর? মনে রাখতে হবে, সবান্ধব সত্যজিৎ রায় সিনেমা দেখার জন্য ওই মধ্য কলকাতাকেই আশ্রয় করেছিলেন। তখন রবীন্দ্রনাথ নোবেল পাচ্ছেন, বাংলা ছবির আদি পর্বে যাঁদের সবচেয়ে বেশি রমরমা, সেই ম্যাডানরা তৈরি করলেন এলফিন স্টোন পিকচার প্যালেস, এখন যা সোসাইটি নামে পরিচিত। উঠে যাওয়া চ্যাপলিন যাত্রা শুরু করে তারও আগে। আমাদের বুদ্ধিজীবীরা এ পাড়াটাকেই নিজের পাড়া ভাবতেন ছবি দেখার সময়। কালিদাস নাগ পছন্দ করতেন এম্পায়ার থিয়েটার।


১৭ সেপ্টেম্বর, ১৯৫৪। এলিট সিনেমায় অল ইন্ডিয়া মিউজিক কনফারেন্স। ছবি: আনন্দবাজার আর্কাইভের সৌজন্যে।

শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায় যেতেন বিজু-তে। এম্পায়ার পরে সাজসজ্জা বদলে ‘নিউ এম্পায়ার’ হয়ে যায়। আর বিজু নাম পাল্টে হয়ে যায় গ্লোব। বুদ্ধদেব বসু ছিলেন মেট্রোর উচ্ছ্বসিত ভক্ত। ‘তি‌থিডোর’ উপন্যাসের নায়িকার সঙ্গে পলমুনি-র ছবি দেখেছিল মেট্রোতে।

তার আরও অনেক পরে আমাদেরও মুগ্ধ করেছিল সুন্দরের এই ষড়যন্ত্র। লবিতে ডগলাস ফেয়ার ব্যাঙ্কস, মেরিলিন দিয়েট্রিশ-এর ছবি— এলিট, মেট্রো, গ্লোব, নিউ এম্পায়ার বা লাইটহাউসে ছোট, কিন্তু পরিচ্ছন্ন পানশালা। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় সেখানে ইন্টারভ্যালে দাঁড়িয়ে একটু হুইস্কি খেয়ে নিলেন।

আরও পড়ুন, ‘মিঠুনদাই আমার প্রথম গুরু’, বললেন সেলিব্রিটি হয়ে ওঠা ডান্সিং আঙ্কল

আমাদের সিনেমা হলগুলি ছিল পৃথিবীর দিকে খুলে দেওয়া জানালা। সেখানে বিয়ের পরে নবীন দম্পতি, আর নাক উঁচু ভাবুক আধুনিকতার স্বাদ পেত। আজকের মাল্টিপ্লেক্স হয়তো প্রাচুর্যকে সংরক্ষিত রেখেছে, দিন-ঋতুকে আটকে রেখেছে সিন্থেটিক আবহাওয়ায়, কিন্তু, ‘দেখা’-কে? হল ছিল মনোযোগের জায়গা আর মাল্টিপ্লেক্স তো সংগঠিত অন্যমনস্কতা। আসনের নীচে বাতি, আসনের হাতলে পানীয়, আসনে জ্বলতে থাকা মোবাইল পর্দা, চাপা গুঞ্জনের দর্শককুল— এখানে ছায়াছবি গৌণ। ভ্রমণ ও দোকানবিলাসের অন্তর্বর্তী স্তর এই মাল্টিপ্লেক্স, ললা বার্তে-র কথায়, ‘পরিবাহিত অচলতা’— এক ধরনের উউন্ডোশপিং।

অপু আর অপর্ণা এই শপিং মলের সিনেমা হলে সিনেমা দেখতে আসবে তো?

Elite Cinema Cinema Hall Tollywood Celebrities
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy