Advertisement
১৯ এপ্রিল ২০২৪

‘মিঠুনদাই আমার প্রথম গুরু’, বললেন সেলিব্রিটি হয়ে ওঠা ডান্সিং আঙ্কল

গোবিন্দার 'খুদগর্জ' ছবিটার 'আপ কে আ জানে সে' গানটায় স্টেজে নাচছেন ডাব্বু। পাশে তাঁর স্ত্রী কখনও নাচছেন, কখনও আবার শুধুই হাততালি দিয়ে যাচ্ছেন। আর মোবাইলে ডাব্বুর এই নাচের ভিডিয়োটা তুলছেন তাঁরই শ্যালকের স্ত্রী।

মিঠুনকেই নিজের প্রথম গুরু বললেন ডাব্বু।

মিঠুনকেই নিজের প্রথম গুরু বললেন ডাব্বু।

সায়ন্তন মুখোপাধ্যায়
শেষ আপডেট: ০৬ জুন ২০১৮ ১৭:০০
Share: Save:

মধ্যপ্রদেশে তিনি 'ডান্সিং ফুফা'। দেশবাসী আদর করে তাঁকে ডাকছেন 'ডাব্বু আঙ্কল' বলে। গোটা বিশ্ব আবার তাঁকে চেনে 'ডান্সিং আঙ্কল' নামে। আর কলকাতা না হয় তাঁকে 'ডান্সিং কাকু' বলেই ডাকল।

এ যেন সেই সন্তান জন্মানোর পর নামকরণের পালা।

জন্ম হয়েছে। তবে তা একটা ভিডিয়োর। আর সেই ভিডিয়োর সুবাদেই রাতারাতি সেলিব্রিটি হয়ে গিয়েছেন মধ্যপ্রদেশের বিদিশা শহরের সঞ্জীব শ্রীবাস্তব থুড়ি ডাব্বু। ৪৭ বছরের সঞ্জীব পেশায় ইলেকট্রনিক্সের প্রফেসর আর তাঁর নেশা শুধুই নাচ।

বিদিশা থেকে গ্বালিয়রে শ্বশুরবাড়ি এসেছিলেন একটা বিয়ের অনুষ্ঠানে যোগ দিতে। আর সেখানেই তাঁকে সক্কলে ছেঁকে ধরেন গোবিন্দার একটা গানে নাচার বায়না নিয়ে। বলিউডে এত হিরো থাকতে গোবিন্দা কেন? আসলে আমাদের ডাব্বু কাকু যে গোবিন্দার ডান্স স্টেপগুলো হুবহু নকল করেন।

আরও পড়ুন: ‘আমায় এত ভাল নকল কোনও নায়কও করতে পারেনি’

তা যাই হোক। গোবিন্দার 'খুদগর্জ' ছবিটার 'আপ কে আ জানে সে' গানটায় স্টেজে নাচছেন ডাব্বু। পাশে তাঁর স্ত্রী কখনও নাচছেন, কখনও আবার শুধুই হাততালি দিয়ে যাচ্ছেন। আর মোবাইলে ডাব্বুর এই নাচের ভিডিয়োটা তুলছেন তাঁরই শ্যালকের স্ত্রী। নাচ শেষ হতে না হতেই ভিডিয়োটা ফেসবুকে পোস্ট করে দিলেন তিনি। ব্যাস তারপর আর দেখে কে!

১২ মে ছিল সেই বিয়ের অনুষ্ঠান। আর মে মাসের ২৬ তারিখ নাগাদ ভাইরাল হয়ে যায় সেই ভিডিয়ো। তার পর থেকে রীতিমতো নাওয়া-খাওয়া বন্ধ হয়ে গিয়েছে প্রফেসর শ্রীবাস্তবের। সঙ্গে দিনবদলের গানটাও শুরু হয়ে যায় ডাব্বু আঙ্কলের জীবনে।

সুনীল শেট্টির সঙ্গেও দেখা করে এসেছেন ডাব্বু।

রাতারাতি সেলিব্রিটি তকমা। তিনি যে ধরাছোঁয়ার বাইরে থাকবেন সেটা খুব স্বাভাবিক। তাই তাঁর ফোন নম্বর জোগাড় করতে একটু বেগ পেতে হল। ক্লু ছিল একটাই। আর সেটা ভাবা ইঞ্জিনিয়ারিং রিসার্চ ইনস্টিটিউট। এই কলেজেরই প্রফেসর সঞ্জীব শ্রীবাস্তব। কলেজের ফোন নম্বর জোগাড় করা গেল। কলেজে ফোন করতেই একজন বলে উঠলেন, “সঞ্জীব স্যার তো সেই কবে থেকেই কলেজ আসছেন না। আর ওঁর কোনও নম্বর তো আমার কাছে নেই।” সঞ্জীব নামটা শুনেই আরেকজন কেড়ে নিলেন ফোনটা। বললেন, “মেরে পাস হ্যয় না উনকা নম্বর।” এর পরেই তারিক আহমেদ নামের সঞ্জীব বাবুর সেই সহকর্মী তাঁর ফোন নম্বরটি দিলেন।

আনন্দবাজার ডিজিটালের তরফ থেকে মোবাইলে ধরা হল সঞ্জীব শ্রীবাস্তবকে। ফোন ধরেই বললেন, “জানেন, গত পাঁচ দিনে মোট দশ ঘন্টাও ঘুমিয়েছি কি না, সন্দেহ আছে। বাচ্চাগুলোর সঙ্গেও ঠিক করে দেখা হচ্ছে না। তবে যাই হচ্ছে আমি উপভোগ করছি। এ সব না হলে আপনি কি আর কলকাতা থেকে আমাকে ফোন করতেন?”

যেই প্রশ্ন শুরু করব, থামিয়ে দিলেন। “আমি জীবনে কখনও কলকাতা যাইনি। কিন্তু কলকাতার সঙ্গে আমার একটা পুরনো যোগ রয়েছে”— বলে উঠলেন সঞ্জীব।

কী সেই যোগ?

সঞ্জীব বললেন, “আমার প্রথম নাচ মিঠুনদার গানে। আমার প্রথম গুরু মিঠুনদা। দশ বছর বয়সে স্টেজে আমার প্রথম নাচ মিঠুনদার ছবির গান 'তকদির কা বাদশা'তেই। ওই নাচের জন্য আমি ফার্স্ট প্রাইজও পেয়েছিলাম। মিঠুনদাও তো কলকাতারই লোক।"

তা হঠাত্ মিঠুন থেকে গোবিন্দায় চলে গেলেন কেন?

“১৯৮২ সালের ছবি 'তকদির কা বাদশা'। তার পর আর মিঠুনদার নাচের গান সে ভাবে আসছিল না। ১৯৮৬ সালে দুর্দান্ত নাচের স্টাইল নিয়ে চলে আসেন গোবিন্দা। ব্যাস! আমি ওঁর ফ্যান হয়ে যাই। ১৯৮৬, ’৮৭, ’৮৮ এই তিনটে বছরই গোবিন্দার গানে নেচে আমি মধ্যপ্রদেশ ডান্স কম্পিটিশনে পর পর তিনবার ফার্স্ট হই। গোবিন্দার নাচের জন্যই আমি জনপ্রিয়। যেখানেই যাই সবাই আমাকে গোবিন্দার নাচই নাচতে বলে”— বোঝালেন সঞ্জীব।

ছোটবেলা থেকেই স্টেজে নাচছেন ডাব্বু।

কিন্তু আপনার এই ভিডিয়ো ভাইরাল কে করল?

বললেন, "আমিও তাঁকে খুঁজছি জানেন। একবার তাঁকে পেলে দুই পা ছুঁয়ে নমস্কার করব।"

সঞ্জীববাবু ছোটবেলা থেকেই মা মোহিনীদেবীকে দেখে আসছেন ক্লাসিকাল ডান্স করতে। আর নাচে তাঁর তালিম বলতে ওইটুকুই। বলছেন, “ভিডিয়োতে দেখেছেন তো আমার ঘাড় নাড়ানোর কায়দা। সেটা আমার মায়ের কাছ থেকেই শেখা।”

তবে হুট করে এমন জনপ্রিয় হয়ে যাওয়ার বিষয়টা এখনও কেমন যেন দিবাস্বপ্নের মতো ঠেকছে সঞ্জীববাবুর কাছে। বলছেন, “আমি বাকরুদ্ধ। কোথা থেকে কী যে হয়। ৩৬ বছর ধরে এক নাগাড়ে নেচে যাচ্ছি। আর দেখুন, এতদিন পর একটা বিয়ের অনুষ্ঠানে নাচতে গিয়েই এত কাণ্ড। এ সবই ঈশ্বরের জাদু। এত মানুষের ভালবাসা পেয়ে সত্যিই আমি ভাষা হারিয়ে ফেলেছি।”

আর বাড়ির লোকজন কী বলছেন?

সঞ্জীব জানালেন, “পরিবারের কাছে নাচের জন্য আমি সব সময়ই সাপোর্ট পেয়েছি। সকলেই অবাক। আমাদের জয়েন্ট ফ্যামিলি। আমার মা, বাবা, দাদার পরিবার আর আমার পরিবার— আমরা সকলেই এক সঙ্গে থাকি। হঠাৎই যেন বাড়ির পুরো পরিবেশটা বদলে গিয়েছে। কেউই কিছু ঠাওর করে উঠতে পারছিলেন না। আমার মায়ের তো চোখে জল চলে এসেছিল।”

তবে এই মুহূর্তে সঞ্জীবের শিডিউল একককথায় ঘাঁটা। ফোনের পর ফোন এসে যাচ্ছে। সব যে সংবাদমাধ্যমের তা নয়। টুইটের পাশাপাশি সেলিব্রিটিদের ফোনও আসছে লাগাতার। গোবিন্দা তো ফোন করেই ছিলেন। ফোন করেছিলেন 'খুদগর্জ' ছবির হিরোইন নীলমও। সুনীল শেট্টি ডেকেছিলেন মুম্বইতে। সঞ্জীব দেখাও করে এসেছেন তাঁর সঙ্গে। কী বললেন সুনীল? “উনি তো আমাকে নিয়ে ছবির কথা ভাবছেন। আর সব কিছু ঠিক থাকলে খুব শীঘ্রই আপনারা আমাকে সলমন খানের সঙ্গে 'দশ কা দম'-এ দেখতে পাবেন।”

তবে শুধু নাচ নয়। তাঁর মনের গহীন কোণে অভিনেতা হওয়ার সুপ্ত বাসনাটাও লুকিয়ে ছিল। বলিউডেও কি খুব জলদি দেখা মিলবে তাঁর? বললেন, "হয়ত!" ছোটবেলায় বেশ কিছু নাটকও করেছেন। ৩৬ বছর ধরে মধ্যপ্রদেশের এমন কোনও জায়গা নেই যে তিনি নাচতে যাননি। রাজস্থান, মহারাষ্ট্র, নাগপুরেও নেচে এসেছেন।আর যেখানেই নাচতে যেতেন প্রথম পুরস্কারটা বাড়ি নিয়েই আসতেন।

কিন্তু অভিনয়, নাচ এ সব নিয়েই তো থাকতে পারতেন। মাঝে ইঞ্জিনিয়ারিং এল কোথা থেকে? দু’নৌকায় পা রেখে কি চলা যায়? ডান্সিং আঙ্কেলের স্পষ্ট উত্তর, “আমি ইঞ্জিনিয়ারিং করেছি। পরে এমটেক করেছি। আমার কখনও মনে হয়নি যে আমি ভাল নাচতে পারি। মনে হত, প্রথম পুরস্কার তো এমনই এমনই পেয়ে যাই। তবে আমাদের সময়ে তো আর ২০০টা টিভি চ্যানেল, সোশ্যাল মিডিয়া এ সবের ঢল ছিল না। আর মা-বাবাকে ছেড়ে মুম্বই যাওয়াটাও দুষ্কর ছিল। তাই ইচ্ছেটাকে মনের মধ্যেই পুষে রাখতাম। আর শুধু নাচতাম। আবার কলেজে গিয়ে ক্লাসও নিতাম। দুটোই তো করতাম।”

গোবিন্দা, মিঠুন চক্রবর্তী, এদের তো মুম্বইতে প্রতিষ্ঠিত হতে কঠিন কসরত করতে হয়েছে। এ দিকে আপনার যে একটা ভিডিয়ো দেখেই সুনীল শেট্টি ডাক পাঠালেন। একটু অনুযোগের সুরেই সঞ্জীব বললেন, "আমাকেও যে স্ট্রাগল করতে হয়নি সেটা আপনাকে কে বলল? আমিও তো ৩৬ বছর ধরে অপেক্ষা করছি প্রচারের আলোর। সোশ্যাল মিডিয়ার দৌলতে সেই আলো আমার কাছে পৌঁছল শেষে।”

তাঁকে ব্র্যান্ড অ্যাম্বাসাডর করার কথা ঘোষণা করেছেন মুখ্যমন্ত্রী শিবরাজ সিংহ চৌহানও।

১৯৮২ সাল থেকে ১৯৯৮ সাল পর্যন্ত স্টেজে নিয়মিত পারফর্ম করতেন ডাব্বু। তারপর থেকে আজ অবধি কোনও অনুষ্ঠান বা পার্টিতেই শুধুমাত্র নাচেন তিনি। তবে প্রত্যেক রবিবার ছেলেদের সঙ্গে নাচটা বাঁধাধরা থাকে সঞ্জীবের রুটিনে।

শুধু যে দেশের মানুষ তাঁর নাচের কপি করছেন তাই নয়। সুদূর আমেরিকার মানুষজনও ডান্সিং আঙ্কেলের নাচের কপি করে ছেড়ে দিচ্ছেন সোশ্যাল মিডিয়ায়। নতুন প্রজন্মকে ধন্যবাদ জানিয়েছেন তাঁদের প্রিয় ডাব্বু আঙ্কল। তাঁর নাচের ধরন কপি করে যে নতুন প্রজন্মও ভিডিয়ো তৈরি করছে, তাতে বেজায় খুশি ডাব্বু।

বলিউডে নতুন প্রজন্মের হিরোদের মধ্যে হৃত্বিক রোশন আর টাইগার শ্রফের নাচ তাঁর খুব পছন্দের। কিন্তু এই তারকাদের ডান্স স্টেপই তো নকল করেন ডান্সিং আঙ্কল, তা হলে নিজস্বতা আর কী রইল? বললেন, “তার জন্য নতুন গান দরকার। আমাকে একটা নতুন গান দিয়ে দেখুন না।”

কাল আবার পাড়ি দেবেন মুম্বইয়ে। তার আগে কলেজ গিয়েছিলেন লিভ সার্টিফিকেট জমা দিতে। ছাত্র-ছাত্রীরা তো স্যারকে দেখা মাত্রই ঘিরে ধরেছিলেন। প্রিয় স্যার যে এমন ধারা নাচতে জানেন, ধারণাও করতে পারেননি তাঁরা। সহকর্মীরা অবশ্য আগেই তাঁর নাচের ঝলক দেখেছেন। সঞ্জীব বললেন, "কলেজ থেকে আমাকে খুব সাপোর্ট করছে। প্রিন্সিপালকে বললাম কাল আমি মুম্বই যাচ্ছি, কবে যে ফিরব তার কোনও ঠিক নেই। প্রিন্সিপাল বললেন কোনও চিন্তা না করে আপনি আগে মুম্বই যান।"

সঞ্জীব শ্রীবাস্তবের ভাইরাল সেই ভিডিয়ো:

চার দিন আগে তাঁর টুইটার প্রোফাইল খুলে দিয়েছেন সঞ্জীবের দাদা দীপক শ্রীবাস্তব। আর এরই মধ্যে তিন হাজার ফলোয়ার ছাড়িয়ে গিয়েছে। বিদিশা মিউনিসিপাল কর্পোরেশনের ব্র্যান্ড অ্যাম্বাসাডরও করা হয়েছে তাঁকে। ঘণ্টায় ১০০টা ফোন কল, বলিউডি অভিনেতার অভিনন্দন, সুনীল শেট্টির ফিল্ম অফার, সলমন খানের দশ কা দম, মুখ্যমন্ত্রী শিবরাজ সিংহ চৌহানের টুইট বার্তা— এ সবের পর বোধ হয় যে কারও মনটা উড়ু উড়ু হওয়ারই কথা। ডাব্বু বললেন, "আমি সেলিব্রিটি নই, আর হতেও চাই না। আমি সাধারণ ছাপোষা আর পাঁচটা মানুষের মতোই থাকতে চাই। যে কোনও অনুষ্ঠানে গিয়ে যেন নাচতে পারি।"

সঞ্জীবের কাছে সেরা মুহূর্তটা, “যখন চি চি ভাইয়ার (গোবিন্দা) ফোনটা এল। ফ্যানবয় মোমেন্ট ছিল আমার কাছে সেটা। স্বপ্নের দিকে যে ধীর পায়ে এগিয়ে চলেছি সেটা মনে হল মুহূর্তের জন্য। কবে যে এক বার মিঠুনদার সঙ্গে দেখা হবে!”

"বিশ্বাস করুন আর নাই করুন মধ্যপ্রদেশের জলে বিশেষ কিছু একটা আছে" প্রফেসর সঞ্জীবের নাচে মুগ্ধ হয়ে টুইটে লিখেছিলেন মধ্যপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী শিবরাজ সিংহ চৌহান।

সত্যিই কি স্পেশাল কিছু আছে?

"তা বলতে পারব না। তবে সোশ্যাল মিডিয়ায় একটা জাদু আছে।" বললেন ডাব্বু আঙ্কল।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Sanjeev Shrivastava Govinda Viral Video
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE