প্রশ্ন: কপালে লাল টিপ। ফুলহাতা ব্লাউজ়, আর সাদামাঠা শাড়ি। জননেত্রী হওয়ার ‘লুক’ কি এটাই?
সায়ন্তিকা: একেবারেই না। নেত্রী হতে হয় কাজের মাধ্যমে। জননেত্রী হওয়ার কোনও ‘লুক’ হয় না। কখনও যদি পর্দায় নেত্রীর চরিত্রে অভিনয় করি তখন ‘লুক’ নিয়ে ভাবব। মানুষ নেতা বা নেত্রী তৈরি করেন। কাজটা যদি সে ভাবে করি তা হলে ‘লুক’টা ভাল হবে।
প্রশ্ন: জননেত্রী হওয়ার আগে তো আপনার পরিচয় অভিনেত্রী হিসাবে। কিন্তু সেই বড় পর্দা থেকে দূরে কেন?
সায়ন্তিকা: ২০২৬ সালের নির্বাচনের পর আমায় দেখতে পাবেন। ২০২৪ সালের উপনির্বাচনে বরাহনগরের টিকিটের জন্য আমি প্রস্তুত ছিলাম না। যখন সেই সুযোগ পেয়েছি সেটা মন দিয়ে করতে চাই। হাতে এক বছরও সময় নেই। বিধায়ক বা সাংসদ পদ পাওয়ার পর সবার হাতে পাঁচ বছর সময় থাকে। সেখানে পাঁচ বছরের পড়াশোনা এক-দু’বছরে করতে হচ্ছে আমায়। সেই সময়টা তো লাগবে আমার। আমি মানুষকে ঠকাতে চাই না।
প্রশ্ন: তা হলে আপনি...
সায়ন্তিকা: (প্রশ্ন শেষ হওয়ার আগে) নির্বাচনের আগে শুধু প্রচারে যাব, হাত নাড়ব, ওই রাজনীতি করব বলে এই ময়দানে আসিনি। অনেকেই সেই ধরনের রাজনীতিও করেন। শুধু নির্বাচনের আগে হাত নাড়ে। আমার পার্টি, তোমার পার্টি বলে বলছি না। সাধারণ রাজনীতিক হিসাবে বলছি। মানুষের থেকে এটা শুনতে চাই না, নায়িকাকে ভোট দিয়ে ভুল করেছেন। গাড়ি থেকে সানগ্লাস পরে নেমে হাত নাড়িয়ে চলে গেল। ২০২৬ সালের ভোটের পর পর্দায় আমার ‘প্রত্যাবর্তন’ হবে।
প্রশ্ন: আদৌ কি আপনি রাজনীতি নিয়ে প্রথম থেকে ভেবেছিলেন, না কি সবটাই ঝোঁকের বশে বা শখে...
সায়ন্তিকা: আমার কোনও দিনই রাজনীতির ময়দানে আসার কোনও শখই ছিল না।
প্রশ্ন: তা হলে যে অনেকেই বলেন ২০২১ সালে নির্বাচনে হেরে যাওয়ার পরে আপনি নাকি ভেঙে পড়েছিলেন?
সায়ন্তিকা: রাজনীতিতে আসার ইচ্ছা কোনও দিন আমার ছিল না। আর এত স্পষ্টবাদী মানুষ আমি। নেতা বা নেত্রী হতে গেলে বুঝেশুনে কথা বলতে হয়। এ দিকে আমি মুখের উপর সব উত্তর দিয়ে দিই। মনে হয়েছিল, এখানে দু’মিনিটও টিকতে পারব না। খুব অল্প সময়ের মধ্যে সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম। সে সময় ইন্ডাস্ট্রির অনেকেই বিজেপিতে যোগ দিচ্ছিল।
কেন গেরুয়া শিবিরে যোগ দিলেন না তৃণমূল বিধায়ক? ছবি: সংগৃহীত।
প্রশ্ন: আপনাকেও নিশ্চয়ই বিজেপি থেকে ডেকেছিল?
সায়ন্তিকা: ২০২১ সালে তো অনেকেই ধরেই নিয়েছিলেন বিজেপি সরকার এসে গিয়েছে। হ্যাঁ, সে সময় বিজেপি থেকেও আমায় বলা হয়েছিল। সেই সঙ্গে...
প্রশ্ন: বিজেপির তরফে অনেক টাকাও কি অফার করা হয়েছিল?
সায়ন্তিকা: (ইঙ্গিতপূর্ণ হাসি) আমি কিছু বলছি না।
প্রশ্ন: কেন যোগ দিলেন না বিজেপিতে?
সায়ন্তিকা: তৃণমূল কংগ্রেস বা বিজেপি কোনও নামই আমার কাছে গুরুত্বপূর্ণ নয়। আমার কাছে এক এবং অদ্বিতীয় হলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। শিল্পী হিসাবেও নেত্রীর সঙ্গে বিভিন্ন প্রচারে গিয়েছি আগে। উনি শিল্পীদের খুব ভালবাসেন। উনি এত স্নেহ করেন, তাই মনে হয়েছিল রাজনীতিতে যোগ দিলে আমি মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গেই কাজ করব। যেমন বুম্বাদা (প্রসেনজিৎ চট্টোপাধ্যায়), ঋতুদি (ঋতুপর্ণা সেনগুপ্ত), রচনা বন্দ্যোপাধ্যায়কে গ্রাম থেকে শহর নির্বিশেষে মানুষ ভালবাসেন। তেমনই দিদিকেও (মুখ্যমন্ত্রী) মানুষ ভালবাসেন। আর মহিলা হিসাবে তো মহিলার একটা আবেগ তো কাজ করবেই।
২০২১ সালে হেরে যাওয়ার পর কী অনুভূতি হয়েছিল? ছবি: সংগৃহীত।
প্রশ্ন: তার মানে ২০২১ সালে হেরে যাওয়ার পর আপনার মনখারাপ হয়নি?
সায়ন্তিকা: বাঁকুড়া সদর থেকে মাত্র ৭৩৫ ভোটের জন্য হেরে গিয়েছিলাম। আমার মন ভেঙে গিয়েছিল। মনে হয়েছিল আমি কী এমন করলাম যে হেরে গেলাম? তখনই জেদ চাপল যে ভাল কাজ করব। মানুষকে বোঝাতে হবে যে আমি কাজ করতে এসেছি। আর এটা অনেকটা নেশার মতো। সেই শুরু। মানুষের সঙ্গে মিশে যাওয়ার নেশা। সপ্তাহে দু’তিন বার বাঁকুড়া যেতাম। তাই হেরে যাওয়ার পরেও আমায় রাজ্য সম্পাদকের পদ দেওয়া হয়।
প্রশ্ন: অভিনয় থেকে রাজনীতিতে এসেছেন আপনি। ইদানীং টলিপাড়ায় কান পাতলেই শোনা যায়, তৃণমূল না করলে, প্রচারে না বেরোলে ইন্ডাস্ট্রিতে কাজ পাওয়া যাবে না, এটা কতটা সত্যি?
সায়ন্তিকা: যাঁরা এই কথাগুলো বলেন তাঁদের থেকে জানতে চাই, সিপিএমের সরকার যখন ছিল তখন টেকনিশিয়ান স্টুডিয়ো কেমন ছিল? আমি যখন কাজ শুরু করেছিলাম আমি ছারপোকার কামড় খেয়েছিলাম। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকার আসার পর ভোল বদলে দিয়েছেন। আমাদের কোনও দায়বদ্ধতা নেই সরকারের প্রতি! টেকনিশিয়ানদের জন্য বিমাও চালু হয়েছে এই সরকারের আমলে। যাঁরা এ ধরনের কথা বলেন তাঁরাও তো নিজেরা দেখছেন।
প্রশ্ন: রাজনীতি নিয়ে পড়াশোনা আছে তো? বলা হয় গ্ল্যামার আছে, কিন্তু রাজনৈতিক বুদ্ধি খাটো। এই ধরনের মন্তব্য গায়ে লাগে, না কি ঝেড়ে ফেলে দেন?
সায়ন্তিকা: গ্ল্যামার আছে বলে অভিনয় করা যায়। কিন্তু রাজনীতি কী ভাবে হবে? বরং রোদে পুড়ে, জলে ভিজে রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে গ্ল্যামার কমে যায়। যাঁরা এ সব প্রশ্ন তোলেন তাঁরা কি সব কিছু পড়ে কাজ করতে আসেন? কাজ করতে করতেও শেখা যায়। আমি রাষ্ট্রবিজ্ঞানের ছাত্রী। কিন্তু তার সঙ্গে রাজনীতির কোনও সম্পর্ক নেই। বিভিন্ন ক্ষেত্রে থেকেই মানুষের রাজনীতিতে আসা দরকার। আর হ্যাঁ, অভিনয় জগৎ থেকে এসেছি বলে গ্ল্যামার আছে। তাতে এত গায়ের জ্বালা কিসের? আর আমি খেটে নিজের জায়গা তৈরি করেছি।
প্রশ্ন: যে কোনও সিনেমার সেটে নায়ক-নায়িকাই রাজা। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে তাঁদের কথা মতোই চলে সেটের সবাই। কিন্তু রাজনীতিতে তা হয় না। অনেক সিনিয়ররা আছেন যাঁরা বহু বছর ধরে এটাই করছেন। বড়দের শাসন কী ভাবে নেন?
সায়ন্তিকা: এটা ঠিক। অভিনয়ের ক্ষেত্রে নিজের ইচ্ছা অনুযায়ী সিদ্ধান্ত নেওয়া যায়। ভুল করলে তা যদিও কেউ শুধরে দেন তা আমি মাথা পেতে নেব। কারণ, ইগো বস্তুটা আমার মধ্যে নেই। টিকে থাকতে গেলে নিজের ভুল শুধরে নেওয়াই বুদ্ধিমানের কাজ। শুটিং সেটেও নিজের ইচ্ছামতো কিছু করা যায় না। কারণ, প্রযোজকের টাকা দেওয়া আছে। যারা আমার ভাল চাইবে তারা ভুল ধরিয়ে দেবে। আর যারা চাইবে না তারা বলবে, আমি যা করছি ঠিক করছি।
প্রশ্ন: কিছু দিন আগে অভিনেতা সৌরভ দাস বলেছেন, রাজনীতিতে টিকে থাকতে হলে চামড়া মোটা করতে হয়। আপনারও কি সেই মত?
সায়ন্তিকা: আমরা আগামী দিনে গন্ডারে পরিণত হব! আমরা অভিনেতারা না খুব আহ্লাদি। কিন্তু রাজনীতির ময়দানে নামলে গাল খেতে হবে। সেই ভেবেই এ কথা বলেছেন সৌরভ। মোটা চামড়া হলে টিকে থাকা যাবে। আর তা না পারলে চলে যেতে হবে। এখানে আমার না করার জায়গা নেই। নির্বাচিত হওয়া মানে আমরা মানুষের কাছে দায়বদ্ধ।
প্রশ্ন: আপনি এখন মাচা শো করতে যান?
সায়ন্তিকা: আমি শিল্পী। অবশ্যই যাই। ওটাই তো আসল পরিচয়। ওটা করেই আমার সংসার চলে। সিনেমায় অনেক সময় দিতে হবে বলে করছি না।
ওজন বেড়ে যাওয়া নিয়ে একাধিক মন্তব্য ভাবায় সায়ন্তিকাকে? ছবি: সংগৃহীত।
প্রশ্ন: অভিনয় করছেন না বলে কি চেহারার প্রতিও সে ভাবে যত্ন নেওয়া হচ্ছে না?
সায়ন্তিকা: এটা আমার ইচ্ছা। এখনই আমি ক্যামেরার সামনে ফিরছি না। আমিও তো মানুষ। একটু যদি ওজন বাড়ে, একটু আরাম করি তাতে কী সমস্যা? অভিনয়ে ফিরলে যদি দেখি ক্যামেরায় আমায় ভাল দেখাচ্ছে না তখন মানুষের মন্তব্য মেনে নেব। এত বছর তো আমি বিধায়কও ছিলাম না। ২০২৬-এর পর আমি আর এই বিরতি পাব না। এখন আমি বিশ্রাম নিচ্ছি। ওজন বাড়লেও আমার যোগাভ্যাস বন্ধ হয়নি। যখন অভিনেত্রী সায়ন্তিকাকে পর্দায় দেখবে তখন আর এই অভিযোগ থাকবে না।
প্রশ্ন: অভিনয়, রাজনীতি করতে গিয়ে কি প্রেম উবে গেল সায়ন্তিকার জীবন থেকে? জয় মুখোপাধ্যায়ের পর আর কেউ এল না জীবনে?
সায়ন্তিকা: মা,বাবারা পাগল হয়ে যাচ্ছে। আমার জীবন খোলা খাতা। প্রেম করলেও সবাই জানতে পারবে। ভাল কাউকে পেলে অবশ্যই করব।
আরও পড়ুন:
প্রশ্ন: বিধায়কের প্রেমিক হতে গেলে কি তাঁকে সাংসদ হতে হবে?
সায়ন্তিকা: না না। কর্মক্ষেত্রে কখনও প্রেম বা বিয়ে করা উচিত নয়। এটা আমি মনে করি। যদিও প্রেম তো আর ও সব দেখে হয় না। আসলে প্রেম করার সময় পাচ্ছি না আমি।
প্রশ্ন: আপনার প্রিয় রাজনীতিক কে?
সায়ন্তিকা: মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় আমাদের নেত্রী। আর অবশ্যই অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়।
প্রশ্ন: অরূপ বিশ্বাস না কি অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়?
সায়ন্তিকা: এক জন যুব নেতা। আর অন্য জন অনেক সিনিয়র নেতা। কোনও ভাবেই তুলনা করতে পারব না।
প্রশ্ন: সমসাময়িক কোনও নায়িকার সঙ্গে বন্ধুত্ব আছে?
সায়ন্তিকা: শ্রাবন্তীর সঙ্গে , শুভশ্রীর সঙ্গে মাঝেমাঝে মেসেজে কথা হয়। একসঙ্গে ব্যাডমিন্টন খেলার পরিকল্পনাও আছে শুভশ্রীর সঙ্গে। কথা হয় সুযোগ পেলেই...।