Advertisement
২৬ এপ্রিল ২০২৪

থ্রিলারে নকশালজিয়া

থ্রিলারের আঙ্গিকে বাঁধতে গিয়ে এই ভারসাম্যটা যেন নড়ে গিয়েছে ছবিতে। দিনের শেষে বিশ্বাসঘাতকতা তো বিশ্বাসঘাতকতাই। ‘স্বীকারোক্তি’ দরকার বই কি!

জাগরী বন্দ্যোপাধ্যায়
শেষ আপডেট: ২৪ জুলাই ২০১৭ ১২:৪০
Share: Save:

মেঘনাদবধ রহস্য পরিচালনা

পরিচালনা: অনীক দত্ত

অভিনয়: সব্যসাচী, গার্গী, আবির, বিক্রম, সায়নী

৬.৫/১০

কানন মাঝে পশিলা সৌমিত্রি/ ঘোর সিংহনাদ বীর শুনিলা চমকি/কাঁপিল নিবিড় বন মড়মড় রবে চৌদিকে/ আইল ধাই রক্তবর্ণ আঁখি হর্য্যক্ষ, আস্ফালি পুচ্ছ, দন্ত কড়মড়ি/ জয় ‘বিপ’ নাদে রথী উলঙ্গিলা অসি...

বিপ-ময় এ পৃথিবীতে মেঘনাদবধ কাব্যের কপালে কবে কোপ পড়ে ভেবে অনেকেই চিন্তিত। ‘মেঘনাদবধ রহস্য’ দেখে বুঝলুম, চিন্তার কারণ আছে, আবার নেইও। মানে, মধুকবির ভাগ্যে কী নাচছে, তাই নিয়ে আশঙ্কার কথা ছবিতেও আছে। সেই আশঙ্কা-বাণীটিতে সেন্সরের শ্যেন-দৃষ্টি পড়েনি! শুধু যে ‘রামরাজ্যে’ এমন ঘটতে পারে বলে সংলাপ, সেটা ‘বিপ-রাজ্য’ হয়ে গিয়েছে। বাকি কথাটাকে কেউ ‘টাচ’ করেনি। মধুসূদনের সরস্বতী বন্দনার জোর দেখুন আজও!

অনীক দত্ত মশাইয়ের উপরেও দেবীকৃপা কম নয়। যাকে ভোট দিলাম, সে নোট নিয়ে গেল-র মতো সংলাপ তিনি বাঁচিয়ে-বর্তে রাখতে পেরেছেন! শিল্পসংস্কৃতির দিকপালেরা যে ভাবে সরকারের সঙ্গে দহরম-মহরম রেখে চলেন, তাই নিয়ে যে কটাক্ষ আছে ছবিতে, সেগুলোই বা কম কী? আসলে অবস্থাটা ইদানীং এমন যে, নিতান্ত স্বাভাবিক অধিকার, স্বাভাবিক বিতর্কগুলো আর স্বাভাবিক বলে দেখা যাচ্ছে না। কোপ পড়াটাই স্বাভাবিক আর বলতে পারাটাই যেন মিরাকল। রিভিউ লিখতে বসে তাই প্রথমেই কী গেল আর কী থাকল-র হিসেব মেলাতে হচ্ছে।

এ বার আসি ‘স্বীকারোক্তি’তে। অনীকের ছবির মূল চরিত্র বিলেত-প্রবাসী কল্পবিজ্ঞান লেখক অসীমাভ বসু এমনিতে ইংরেজিতে লেখেন। কিন্তু সম্প্রতি একটি বাংলা উপন্যাসে হাত দিয়েছেন। ‘স্বীকারোক্তি’ তারই নাম। এখানে সমালোচকের একটি স্বীকারোক্তিও আছে। ‘ভূতের ভবিষ্যত’ এবং ‘আশ্চর্য প্রদীপ’-এর পরে অনীক যখন থ্রিলার বানাতে এলেন, কেমন যেন মনে হয়েছিল, স্বাতন্ত্র্যের জায়গাটা ছেড়ে দিলেন কি? ‘মেঘনাদ...’ দেখে বুঝলুম, অনীক আছেন অনীকেই। বঙ্গসমাজ, বঙ্গ-সংস্কৃতি, বঙ্গ-রাজনীতির পর্যবেক্ষণ আজও তাঁর মূল বিষয়। এ কথাও ঠিক, থ্রিলারের নিজস্ব দাবি মেটাতে গিয়ে তাঁকে আরও অনেক কিছু আমদানি করতে হয়েছে। মূল প্রসঙ্গে ঢুকতে অনেকটা সময় নিতে হয়েছে। সেলেব্রিটি দম্পতির ‘ব্যস্ত’ জীবন অনেকটা জায়গা নিয়ে নিয়েছে। শেষ অবধি সব চরিত্রের সব আচরণের ব্যাখ্যা কিন্তু ছবিতে নেই। অথচ অন্যান্য ডালপালা কমিয়ে অসীমাভর অন্তর-যাত্রাকে কেন্দ্র করেই একটি আদ্যন্ত রাজনৈতিক ছবি হতে পারত, যদিও তাতে বক্স অফিস খুশি হতো কি না বলা মুশকিল। অনীক সে পথে না গিয়ে বামপন্থী ড্রয়িং রুমেই বেশ কিছু এবড়োখেবড়ো কোণ রেখে দিয়েছেন। সেখানে আশ্রিত ভাগ্নে আছে, গৃহভৃত্যের প্রতি নির্মমতা আছে, সন্তানের প্রতি উদাসীনতা আছে। রাজনৈতিক বিশ্বাস আর ব্যক্তিগত যাপনের মধ্যে স্ববিরোধ চোরকাঁটার মতো বিঁধে আছে।

একই সঙ্গে অন্য ক’টা কাঁটাও যে বিঁধছে। কাহিনিচিত্রে তথ্য-কল্পনা মিলেমিশে যেতেই পারে। সুনু গুহঠাকুরতা বেঁচে থাকতেই পারেন। কিন্তু জঙ্গলমহলে মাওবাদী বিস্ফোরণ (২০১৬-য়?) হচ্ছে আর ‘কীর্তিশ ভদ্রে’র মতো ‘ওপিডিআর’ কর্মী তার মাস্টারমাইন্ড বলে দেখানোটা ঠিক হল কি?

সংলাপে অনীকের চেনা স্টাইল এ ছবিতেও অটুট। একটা নতুন শব্দও পাওয়া গেল। নকশালজিয়া (নকশাল নিয়ে নস্টালজিয়া)!

অসীমাভর ভূমিকায় সব্যসাচী চক্রবর্তী আর ইন্দ্রাণীর চরিত্রে গার্গী রায়চৌধুরী মেঘনাদ রহস্যে অভিনয়ের প্রধান দুই স্তম্ভ। এ বাদে সায়নী, কল্যাণ, ভাস্কর, সৌরসেনী, আবির, বিক্রম, অনিন্দ্য, কমলেশ্বর এবং বঙ্গ সুধীজনেদের একাংশ এ ছবিতে হাজির। শুধু তাই নয়, অনীক যাঁকে যেখানে ‌যতটুকু কাজে লাগিয়েছেন, অভীক মুখোপাধ্যায়ের ক্যামেরায় চমৎকার মানিয়ে গিয়েছে। অসীমাভর বই প্রকাশ অনুষ্ঠানে সঞ্চালকের ভূমিকায় অধ্যাপক শিবাজী বন্দ্যোপাধ্যায়ের উপস্থিতি বা আর্ট এগজিবিশনে গণেশ হালুইকে দেখতে পাওয়া বড় চমক, সেই সঙ্গে অসীম-ইন্দ্রাণীর সামাজিক বৃত্তটিকে বোঝানোর জন্যও কার্যকরী। এ ছাড়া গৌতম হালদারের মেঘনাদবধ অভিনয়ের কিছু অংশ ব্যবহার করা হয়েছে। গল্পের সঙ্গে প্রত্যক্ষ যোগ না থাকলেও ছবির মুড-কে সেটা বাড়তি মোচড় দিয়েছে অবশ্যই।

এখন কথা হল, ছবিতে ইন্দ্রজিৎ কে, সেটা স্পষ্ট। কিন্তু বিভীষণ? ন্যায়ের পক্ষ নিতে আপনজনকে ত্যাগ করা আর নির্যাতনের মুখে ভেঙ্গে পড়ে বিশ্বাসঘাতকতা তো এক নয়। বিভীষণ রাবণকে অন্যায়কারী বলে মনে করেছিলেন, তাই রামের পক্ষ নিয়েছিলেন। অনীকের বিভীষণ কিন্তু নিজেকে বাঁচাতে বিশ্বাসঘাতকতা করে। সেটা মানুষী দুর্বলতা, মানুষী ব্যর্থতার গল্প। সেখানে অনীক একটা খুবই জরুরি প্রশ্ন উস্কে দিয়েছেন। দিনের পর দিন থার্ড ডিগ্রি সহ্য করার ক্ষমতা কি সকলের থাকে? না থাকলে সেটা কি অপরাধ পদবাচ্য? ‘গ্যালিলিও’ নাটকের কথা কোথাও মনে পড়তে পারে এখানে। যদিও সেই সুবাদে বিপরীত প্রান্তে থাকা চরিত্রটির আচরণকে স্রেফ ‘ব্ল্যাকমেল’ বলে দেগে দেওয়া যায় কিনা, সেটাও সমান বড় প্রশ্ন। থ্রিলারের আঙ্গিকে বাঁধতে গিয়ে এই ভারসাম্যটা যেন নড়ে গিয়েছে ছবিতে। দিনের শেষে বিশ্বাসঘাতকতা তো বিশ্বাসঘাতকতাই। ‘স্বীকারোক্তি’ দরকার বই কি!

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE