Advertisement
E-Paper

প্রথম ছবি হলেও দুরন্ত উড়ন্ত মেজাজে মজিয়ে দিলেন মানসী

এত দিন টালিগঞ্জের অন্যতম চরিত্রাভিনেত্রী হিসেবেই তাঁকে চিনতেন বাংলা সিনেমার দর্শক। সেই মানসী সিংহ এ বার ক্যামেরার পিছনে। তাঁর পরিচালিত প্রথম ছবি দেখল আনন্দবাজার অনলাইন।

সংযুক্তা বসু

শেষ আপডেট: ২৭ এপ্রিল ২০২৪ ১৩:১২
Film review of bangla film eta amader golpo

‘এটা আমাদের গল্প’ ছবির একটি দৃশ্যে অপরাজিতা আঢ্য ও শাশ্বত চট্টোপাধ্যায়। ছবি: সংগৃহীত।

বেঙ্গালুরু বা বিদেশের মাটিতে ফুটিয়ে তোলা লম্বা বৃন্তের সুগন্ধি গোলাপ নয় শুধু!

খাঁটি ভালবাসা থাকলে, মাঠেঘাটে বা পাঁচিলের গায়ে,আদারেবাদারে ফুটে থাকা অতি সাধারণ নয়নতারা ফুলও যে ভালবেসে ভাবী প্রেমিকার হাতে তুলে দেওয়া যায়, ‘এটা আমাদের গল্প’ ছবিতে অক্ষরে অক্ষরে তা প্রমাণ হয়ে গেল।

শুধু তা-ই নয়, সেই নির্ভেজাল প্রেম ষাট কি সত্তর কি আশি উত্তীর্ণ নরনারীর জীবনেও চলে আসতে পারে বাঁধভাঙা ভাবে। এই অনিবার্য, দিনের আলোর মতো সত্যি কথাটিই অভিনেত্রী মানসী সিংহ কাহিনিকার ও চিত্র পরিচালক হিসেবে তাঁর প্রথম ছবিতে কোনও গৌরচন্দ্রিকা না করে সোজাসাপটা ভাবে বলে দিয়েছেন। বুঝিয়ে দিয়েছেন এটাও, সময় পাল্টাচ্ছে। প্রেম বা বিয়ে নিয়ে গতানুগতিক ধারণার শিকড় উপড়ে বদলে ফেলার দিন এসে গিয়েছে। দেবপ্রতিম দাশগুপ্তের চিত্রনাট্যও যত দূর সম্ভব এই বক্তব্যের অনুরণনেই বোনা।

ছেলে-বৌ-মেয়ে-জামাই এবং তাদের সন্তানদের নিয়ে ঘর করে ছবির অকালে স্বামীহারা প্রৌঢ়া নায়িকা শ্রীতমা দেবী (অপরাজিতা আঢ্য)। ভরপুর সংসারে থেকেও তার নিভৃত নিঃসঙ্গ জীবন। কোথাও সে গভীর ভাবে একা। নির্জন। সেই একাকিত্ব কাটাতেই সকাল বেলা লাফিং ক্লাবে যায়। হা হা-হি হি-হো হো হাসে। এই ভাবেই সে বদ্ধতা থেকে মুক্তি খোঁজে। কিন্তু মর্নিং ওয়াকের সময় সাদা খোলের রঙিন পাড় দেওয়া সাজসজ্জাহীন শ্রীতমাকে অনুসরণ করে প্রবীণ শর্মা নামে এক প্রৌঢ় (শাশ্বত চট্টোপাধ্যায়)। কাঁচাপাকা চুলে তার হাবভাব, চালচলন একেবারে নায়কের মতো। বয়স বাড়লেও সাজগোজ শৌখিন। বেশ রঙিন মানুষ। ক্রমে বোঝা যায় সে ‘ব্যাচেলর’ অর্থাৎ অবিবাহিত। এবং শ্রীতমাতে মুগ্ধ, অভিভূত। এই ভাবে দিন যেতে যেতে একদিন সে “সিরিয়াস” স্বভাবের নায়িকাকে হাসিয়ে ফেলে ও বিয়ের প্রস্তাব দিয়ে বসে। নিয়তির ফেরে নানা টালবাহানার পর নায়িকা রাজিও হয়ে যায়। প্রেম থেকে বিয়ের প্রস্তাব দেওয়া পর্যন্ত দিলখোলা কমেডি রয়েছে পরতে পরতে। শুধু তাই নয়, প্রায় সারা ছবি জুড়েই হাস্যরসের ধারাটি খরস্রোতা নদীর মতো বয়ে গিয়েছে।

বলাবাহুল্য পরিচালক মানসীর সূক্ষ্ম হাস্যরসের চেতনা যে দুর্দান্ত, তা বিভিন্ন ছবিতে তাঁর অভিনীত চরিত্রগুলি দেখলেই বোঝা যায়। সেই হাসি-রসিকতাবোধ যে নিজের পরিচালনার ছবিতে ব্যবহার করবেনই, সে বিষয়ে কোনও সন্দেহ রাখার অবকাশ নেই। ‘এটা আমাদের গল্প’তে দুই তথাকথিত ‘অতি বয়স্ক’ নায়ক-নায়িকাকে নিয়ে দুই পরিবারে যে সব টানাপড়েন,জটিলতা তৈরি হয়, তার ফাঁকে ফাঁকেও পরিচালক এনেছেন কমেডির সরসতা।

Film review of bangla film eta amader golpo

‘এটা আমাদের গল্প’ ছবির একটি দৃশ্য। ছবি: সংগৃহীত।

আর তারই মধ্যে জমে ওঠে নায়ক-নায়িকা হিসেবে শাশ্বত ও অপরাজিতার চিরসবুজ প্রেমের রসায়ন। বয়স যেখানে কেবলই একটা সংখ্যা ছাড়া কিচ্ছু নয়।

উদ্দাম হয়ে ওঠা প্রৌঢ়-প্রণয়কে ছাঁদনাতলা পর্যন্ত এগিয়ে নিয়ে যেতে দুই বাড়ির অল্পবয়সি সদস্যেরা যে উদার মনের অভিনয় করেছেন, তা দেখে মনে হয় আজকের প্রজন্মকে যতই অর্বাচীন বা উদ্ধত বা বেসামাল মনে হোক না কেন, তাদের অধিকাংশই কিন্তু খোলামনের, তাদের চিন্তা ভাবনা, সমাজচেতনা ও মুল্যবোধ সংবেদনশীল। ভালবাসতে ইচ্ছে করে তাদের। বাঙালি শ্রীতমা ও অবাঙালি প্রবীন শর্মার সম্পর্ককে আলোকিত করেছে দুই বাড়ির যে তরুণ ও তরুণী, তাদের এক জন হল জয়ী (ছবিতে অপরাজিতার নাতনি) অন্য জন বিক্রম (ছবিতে শাশ্বতের ভাইপো)। এদের ভুমিকায় খুব প্রাণবন্ত অভিনয় করেছেন যথাক্রমে পূজা কর্মকার ও আর্য দাশগুপ্ত। বলা যেতে পারে এই প্রেমের গল্পে এরাই অনুঘটক।

‘এটা আমাদের গল্প’ -র পোশাক-প্রসাধন-পরিবেশ-অলঙ্করণ উল্লেখ্য। শ্রীতমার বর্ণহীন জীবনে প্রেম নিয়ে আসে রং। প্রথমে রঙিন পাড়ের সাদা শাড়ি থেকে শুরু করে ক্রমশ সম্পূর্ণ রঙিন হয়ে ওঠে তার সাজ। বিয়ের বাজার করতে গিয়ে টকটকে রানি রঙের শাড়ি বাছাই করা বুঝিয়ে দেয়, জীবনে মনের মানুষ এলে সব কিছু কেমন বর্ণময় হয়ে ওঠে। সেটা যে বয়সই হোক না কেন! শুধু শ্রীতমা নয়, বাকি সকলেরই সাজগোজ চরিত্রের সঙ্গে মানানসই। আলাদা করে নজর কাড়ে পঞ্জাবি পরিবারের নায়ক প্রবীন শর্মার পিসির ভুমিকায় সোহাগ সেনকে। জাত অভিনেত্রী বটে!

Film review of bangla film eta amader golpo

গ্রাফিক: সনৎ সিংহ।

নায়কের ভাই ও ভাই-বৌয়ের ভুমিকায় নিষ্প্রাণ দাম্পত্যের দূরত্ব ও গ্লানি মুছে কাছাকাছি আসার আবেগ ভাল ফুটিয়েছেন কনীনিকা এবং অমিতকান্তি ঘোষ। অন্য দিকে নিঃসঙ্গ শ্রীতমাকে ঈষৎ প্রশ্রয় দেওয়া ছেলে দেবদূত ঘোষ ও তথাকথিত শাশুড়ির সঙ্গে খিটিরমিটির লাগানোর চেষ্টা করে চলা, অম্লমধুর পুত্রবধুর চরিত্রে বাংলাদেশি অভিনেত্রী তারিণ জাহান এক কথায় চমৎকার। শ্রীতমার মেয়ে ও জামাই এই কাহিনিতে মায়ের প্রতি সংবেদনশীল মনের পরিচয় রেখেছেন। তাঁদের ভুমিকায় রয়েছেন জুঁই সরকার ও যুধাজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়।

কমেডির পাশাপাশি আচমকা ট্র্যাজেডি এসে পড়ায় গল্পের মোড় কোন দিকে ঘুরবে? দর্শক কি তাঁদের ইচ্ছেপূরণ করে সিনেমা হল থেকে বেরোবেন,তা লিখলে তো মিটেই গেল। কিছু বাকি থাক প্রেক্ষাগৃহে গিয়ে কৌতূহল মেটানোর জন্য।

তবে এটা বলাই যায়, অভিনয়ের পাশাপাশি এই ছবিতে ভরপুর বিনোদন তৈরি করার চেষ্টা করেছেন সঙ্গীত পরিচালক প্রাঞ্জল দাস। শ্রীকান্ত আচার্য, লগ্নজিতা চক্রবতী, জয়তী চক্রবতী, খরাজ মুখাপাধ্যায়-সহ আরও অনেক সঙ্গীতশিল্পী গানের ডালি সাজিয়েছেন ছবিতে। মজাদার লাগে ‘শহর’ ব্যান্ডের অনিন্দ্য বোসের আচমকা আগমন। সুখদুঃখ, হাসিকান্না, নাচে-গানে জমজমাট করার সমস্ত আয়োজন করেছেন পরিচালক। তাতে অবশ্য কোনও-কোনও জায়গা খানিক চড়া মাত্রাও পেয়েছে।

শাশ্বত ও অপরাজিতার তুখোড় অভিনয়, ‘এটা আমাদের গল্প’-কে সবার দেখার মতো ছবি করে তোলার আবেদন যোগ করেছে। কত বিচিত্র চরিত্রেই না অভিনয় করছেন শাশ্বত! গানে, অভিনয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছেন খরাজ। তিনিও এই ছবির আর এক জমজমাট অনুঘটক।

প্রথম চিত্র পরিচালনার পদক্ষেপে মানসী বেশ কয়েক ধাপ এগিয়ে গেলেন। ভালমন্দ, ত্রুটিবিচ্যুতি যে কোনও ছবিরই নির্মাণের অঙ্গ। প্রদীপের নীচে অন্ধকার যেটুকু থাকার তা থাকবেই। পুরোপুরি নির্ভুল হয় না চলার পথ।

তাই আলোর দিকে তাকানোই ভাল। এগিয়ে যান মানসী সিংহ।

Film Review Bengali Film Manasi Sinha Saswata Chatterjee Aparajita Auddy
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy