শ্রীদেবী। ছবি: টুইটারের সৌজন্যে।
গড়িয়া মেট্রোয় ঢোকার মুখেই আস্তানা। পোলিও আক্রান্ত পা নিয়ে ঘষে ঘষে চলা। একটা ভাঙা ছাতা মাথায় নিত্যযাত্রীদের ডেকে চলে একটানা— ‘ও কাকাবাবু, ও ম্যাডাম, ও মাসিমা...।’ কাকাবাবু, ম্যাডাম, মাসিমারা সাধ্যমতো ১০ টাকা, ৫ টাকা দেন হাতে। আর পল্টু (নাম পরিবর্তিত) বলে ওঠে, ‘জয়গুরু’।
এটাই চেনা রুটিন। ২৭ ফেব্রুয়ারির সকালটা পল্টু ঘুরে বসে গল্প করছে পাশের ফুলওয়ালি মাসির সঙ্গে— ‘‘তিন দিন ও ঘর থেকে বেরোয়নি, জানো। আমি তো দেখলাম। টিভিতে বলছিল!’’ আজ ভিক্ষার পাত্রে মন নেই। আজ মনে ‘শ্রীদেবী’।
বোড়াল রুটে অটো নিয়ে রাতদিন টইটই। এটাই অসীমের (নাম পরিবর্তিত) রুটিরুজি। আজ গাড়িতে এফএম বন্ধ। বরং সামনের সিটে বসা চেনামুখের সঙ্গে রুটিন গল্প কানে এল। ‘‘সি-দেবীরটা পুরো ঘোটলা কেস। ও নিজেদেরই বাওয়াল। সব টাকা দিয়ে চেপে দেবে।’’
এমনিতে সিরিয়ালের সংসারে ব্যস্ত থাকেন মধ্য পঞ্চাশের রুবি (নাম পরিবর্তিত)। ২৫ ফেব্রুয়ারি, রবিবারের সকালেও রান্নাঘর থেকে বার বার টিভিতে চোখ রাখছিলেন। ‘‘কী এমন বয়স বল? হার্ট অ্যাটাক হল!’’ আলোচনা চলছিল। কিন্তু দু’দিন পর রুবি বলছেন, ‘‘এখন তো শুনছি প্রচুর মদ খেয়েছিল…। বড়লোকদের বড় বড় ব্যাপার।’’
আরও দেখুন, মৃত্যুর আগে বিয়েবাড়িতে শ্রীদেবীর শেষ ভিডিও
শ্রীদেবী। মৃত্যুর দু’দিন পরে খবরের শিরোনামে তো বটেই। আমজনতার আড্ডার আঁচেও তিনি। রান্নাঘর থেকে অফিসের ডেস্ক, মেট্রো থেকে আবির কেনার ঠেক— সবেতেই শ্রীদেবীর মৃত্যু নিয়ে আলোচনা। বেঁচে থাকতে তাঁকে নিয়ে আট থেকে আশির এই হিল্লোল কি উঠেছিল?
হ্যাঁ, এটা ঠিক যে সম্পর্কের গসিপে বার বার এসেছে শ্রীদেবীর নাম। কখনও জিতেন্দ্রর সঙ্গে হোটেলের এক ঘরে থাকার গসিপ, কখনও বা মিঠুনের সঙ্গে বিয়ের জল্পনা। সবেতেই ফোকাসে ছিলেন তিনি। আমজনতা খবরের কাগজে চুটিয়ে পড়েছেন সে সব গসিপ। তাঁর অভিনয় নিয়ে প্রশংসা হয়েও খবর বেরিয়েছে। তবে তার থেকেও বেশি আলোচনা হয়েছে পর্দার পিছনের জীবন নিয়ে। আর বরাবরই সে সব বেশি টিআরপি দেয়।
শ্রীদেবী কি প্লাস্টিক সার্জারি করিয়েছিলেন? ওজন কমানোর জন্য ওষুধ খেতেন? ‘ইংলিশ ভিংলিশ’ দিয়ে যখন কামব্যাক হল, অত সরু কোমর! কী করে ধরে রেখেছিলেন? সময়ের নিয়মে এ সব আলোচনা হারিয়েও গিয়েছে। হেডলাইনে উঠে এসেছে নতুন মুখ।
১৯৯৬। মেকআপে ব্যস্ত শ্রীদেবী।— ফাইল চিত্র।
কিন্তু রবিবারের সকালটা বদলে দিল সব হিসেব। ‘দুবাইয়ে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মাত্র ৫৪ বছর বয়সে মৃত্যু হয়েছে শ্রীদেবীর’— খবরটা দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়ে। টিভির সামনে বসে পড়েন সাধারণ মানুষ। ‘আহা রে…!’ ‘চাঁদনি’র হঠাত্ মৃত্যুতে দীর্ঘশ্বাস পড়েছিল আম-আদমির। চোখের কোণটা জ্বালা করে ওঠে অনুরাগীদের। এই বয়সে হার্ট অ্যাটাক রুখতে কী কী করা উচিত তা নিয়ে আলোচনা হয়ে যায় বার কয়েক।
আরও পড়ুন, শ্রীদেবীর মৃত্যুর খবরের দেড় ঘণ্টা আগেই অমিতাভের টুইট?
সোমবার। সপ্তাহের প্রথম কাজের দিন। কাজের ফাঁকে টিভিতে চোখ। অথবা মোবাইলের নিউজ অ্যালার্ট জানিয়ে দিল হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে নয়, বাথটবে পড়ে জলে ডুবে মৃত্যু হয়েছে নায়িকার। পেটে পাওয়া গিয়েছে অ্যালকোহল। অন্তত তেমনটাই দাবি করছে দুবাইয়ের সংবাদমাধ্যম।
না! নিউজ কনফার্মেশনের ব্যাপারে ভাবেন না পল্টু, অসীম, রুবিরা। বরং ব্রেকিং নিউজে লাইনটা পড়েই আগের রাতের মনখারাপ বদলে গেল তীব্র কৌতূহলে। কেউ বললেন, রূপোলি দুনিয়ায় এমন তো কতই হয়! কেউ বললেন, যা হয়েছে তার কিছুই হয়তো জানা যাবে না। আবার গলির মোড়ে কেউ বললেন, ‘‘খুন করেছে রে…।’
আরও পড়ুন, ‘জানি না কেন ঈশ্বর এত নিষ্ঠুর হলেন?’
ব্যস, এটাই এ বার খবর হয়ে গেল। কে বলেছে, কখন বলেছে জানার দরকার নেই। কিন্তু ‘খুন’ শব্দটাই এ বার যেন শ্রীদেবীর নিয়তির সঙ্গে জুড়ে গেল আম জনতার ডায়েরিতে। জুড়ে গেল রহস্য।
হয়তো জানা যাবে শ্রীদেবীর মৃত্যুর আসল কারণ। কিন্তু পাড়ার ঠেক, কলেজ ক্যান্টিন, বাজারের থলির গল্পেরা রহস্যকে লালন করবে ভবিষ্যতের জন্য। আর শ্রীদেবীও থেকে যাবেন সেই রহস্যের অন্দরমহলে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy