Advertisement
E-Paper

‘ভালবাসাকে কি কোনও লিঙ্গে বাঁধা সম্ভব?’ বাঙালির যৌন রক্ষণশীলতা নিয়ে স্পষ্টবাদী ইন্দ্রদীপ

“ইন্ডাস্ট্রির সুদিন আসতে দেরি নেই। আমরা কালো পেরিয়ে আলোর দিকে এগিয়ে চলেছি।”

স্রবন্তী বন্দ্যোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ১৫ জুলাই ২০২৫ ০৯:২০
বাংলা বিনোদন দুনিয়া নিয়ে অকপট ইন্দ্রদীপ দাশগুপ্ত।

বাংলা বিনোদন দুনিয়া নিয়ে অকপট ইন্দ্রদীপ দাশগুপ্ত। ছবি: ফেসবুক।

‘কেদারা’, ‘বিসমিল্লাহ’কে ছাপিয়ে কোটির কক্ষপথে তাঁর ‘গৃহপ্রবেশ’। দর্শক-সমালোচকদের তাই দাবি। ইন্দ্রদীপ দাশগুপ্ত কি সুরকার থেকে ক্রমশ পরিচালক হিসাবে নিজেকে সফল দেখতে চাইছেন? তিনটি ছবির পরিচালনার পর তাঁর কী অনুভূতি, জানালেন আনন্দবাজার ডট কমকে।

প্রশ্ন: পরিচালক ইন্দ্রদীপ বাংলা ছবি দেখেন?

ইন্দ্রদীপ: অবশ্যই দেখি। না দেখলে ভাল ছবি বানাব কী করে? হয়তো প্রিমিয়ারে গিয়ে ছবি দেখি না। কিন্তু এটা জানি, ভাল কাজ হচ্ছে। আরও হবে। সময় বদলাচ্ছে। তাই তাল মিলিয়ে ছবি তৈরির ধারাও বদলাচ্ছে। গল্প বলার ধরন... সব কিছুই।

প্রশ্ন: কোন কোন পরিচালকের ছবি দেখেন?

ইন্দ্রদীপ: কৌশিক গঙ্গোপাধ্যায়, সৃজিত মুখোপাধ্যায়, রাজ চক্রবর্তী, পরমব্রত চট্টোপাধ্যায়— আমি এঁদের ছবির ভক্ত (হাসি)। বড়দের মধ্যে অপর্ণা সেন, অঞ্জন দত্ত, গৌতম ঘোষ আছেন।

প্রশ্ন: অভিনেতা কৌশিক গঙ্গোপাধ্যায় আপনার ছবিতে ফিরে ফিরে আসেন। কেন?

ইন্দ্রদীপ: আগে যে নামগুলো বললাম তাঁদের সবার সঙ্গে আমার কোনও না কোনও ভাবে কাজ করার ইচ্ছে। কিন্তু কৌশিকদার সঙ্গে সঙ্গীত পরিচালক ইন্দ্রদীপ দাশগুপ্তের কাজের পরিমাণ বেশি। যোগাযোগটাও বেশি। তাই হয়তো কোথাও গিয়ে কৌশিকদাকেই বার বার ভেবে ফেলি। এ বার রিনাদি, অঞ্জনদা, গৌতমদা, সৃজিত, পরমব্রত— এঁরাও যদি আমার সঙ্গে কাজ করার ইচ্ছা প্রকাশ করেন তা হলে এঁদেরও সান্নিধ্য পাব। মাঝেমাঝে এও মনে হয়, এঁদের সবার সান্নিধ্য পেতে গেলে যত ছবি বানানো দরকার তত ছবি আমি কি বানিয়ে উঠতে পারব? সেটাই তো জানি না!

‘কেদারা’ ছবিতে কৌশিক গঙ্গোপাধ্যায়।

‘কেদারা’ ছবিতে কৌশিক গঙ্গোপাধ্যায়। ফাইল চিত্র।

প্রশ্ন: তিনটে সফল ছবি বানানোর পরেও কি ইন্দ্রদীপ দাশগুপ্ত ছবির পরিচালক কম, সঙ্গীত পরিচালক হিসাবে বেশি জনপ্রিয়?

ইন্দ্রদীপ: আমি সিনেমাকর্মী। আমার কিছু গল্প বলার আছে। আমার কাছে সিনেমা সেই মাধ্যম। তাই বাকিরা কী ভাবেন বা ভাবছেন জানি না, আমি নিজেকে পরিচালক ভেবে উঠতে পারিনি। পারবও না হয়তো। কারণ, ভালর তো শেষ নেই! নিজেকে সংশোধন, পরিবর্তনেরও শেষ নেই। অনেক কিছু মনে হয়েছে। যা হয়তো পরবর্তী কাজে ব্যবহার করব। (একটু থেমে) যদি কাজ করার সুযোগ পাই। কারণ, ছবি পরিচালনাকে আমি একটি যাত্রাপথ মনে করি।

প্রশ্ন: একটু অন্য প্রসঙ্গে আসি। এত দিনে বাঙালি দর্শক যৌনতা নিয়ে কতটা স্বচ্ছন্দ? সমপ্রেম বা সমকাম কি আগের তুলনায় সহজ ভাবে গ্রাহ্য?

ইন্দ্রদীপ: সমাজে এখনও বিষয়টি নিয়ে কিছু রক্ষণশীলতা তো আছেই। কিন্তু যাহা সত্যি এবং যাহা শাশ্বত তাহা তো সত্যিই! আমার তা-ই মনে হয়। আমি ভুলও বলতে পারি। কিন্তু এক এক সময় আমরা যেন বড্ড বেশি জাজমেন্টাল! সব ক্ষেত্রে বোধহয় সেটা নিষ্প্রয়োজন। আর, ভালবাসাকে কি আদৌ কোনও লিঙ্গে বাঁধা সম্ভব?

প্রশ্ন: তাই কি ‘গৃহপ্রবেশ’ ছবিতে ঋতুপর্ণ ঘোষের অনুষঙ্গ এল? এখনও কি সমকামের সমার্থক তিনিই?

ইন্দ্রদীপ: একদমই না। ঋতুপর্ণ ঘোষ সমকামের ঊর্ধ্বে গিয়ে একজন উঁচু দরের পরিচালক, লেখক, শিল্পী। এই ছবি দিয়ে পরিপূর্ণ এক শিল্পীসত্তাকে আমার শ্রদ্ধা জানানোর চেষ্টা বলতে পারেন।

প্রশ্ন: আপনার আর অরিজিৎ সিংহের সম্পর্ক সকলে জানেন। তিনি সাংবাদিকদের কাছে অধরা। তাই তাঁর জন্মদিনে সকলে আপনাকে খোঁজেন। শুনেছি, আপনি তাতে রেগে যান....

ইন্দ্রদীপ: অরিজিৎ যে মাপের শিল্পী আর মানুষ, তাতে তাঁকে নির্মাণে তাঁর গুরু, মা-বাবা আর তাঁর নিজের অবদান ছাড়া আর কারও অবদান নেই। আমি ভাগ্যবান, ওঁর মতো শিল্পীর সঙ্গে কাজ করতে পেরেছি। তার পরেও অরিজিতের সঙ্গে আমার সম্পর্ক কোথাও গিয়ে তথাকথিত শিল্পী আর সঙ্গীত পরিচালকের ঊর্ধ্বে। সেটা একান্তই ব্যক্তিগত। আমার খারাপ লাগা কোথায় জানেন? ওঁকে নিয়ে আমায় যত খুশি প্রশ্ন করুন, সমস্যা নেই। কেবল অরিজিতের জন্মদিনে কেউ আমার সাক্ষাৎকার নেবেন, সেখানেই আপত্তি।

প্রশ্ন: বাংলা ছবিতে গান গাওয়ার ক্ষেত্রে আমাদের যেন হাতেগোনা শিল্পী। যেমন, অরিজিৎ, শ্রেয়া, ইমন, লগ্নজিতা। ঝুঁকি নিয়ে, সাহস করে নতুন শিল্পীদের দিয়ে গাওয়ানো হবে না?

ইন্দ্রদীপ: তা কেন? অরিজিৎ যখন প্রথম গেয়েছিলেন তখন কি তিনি নামী ছিলেন? এখন দেবায়ন গাইছেন। রাশিদ খানের ছেলে আরমান গাইছেন। অন্তরা মিত্র গাইছেন। আবার গান বুঝে রূপঙ্কর বাগচী বা ঈশান গাইছেন।

প্রশ্ন: অভিনয়ের ক্ষেত্রেও একই অবস্থা। একই নায়ক, এক নায়িকা, এক প্রযোজক, এক সুরকার— টাটকা মুখ কোথাও নেই? বৃত্ত যে ক্রমশ ছোট হচ্ছে!

ইন্দ্রদীপ: প্রথম সারিতে কিন্তু ৫-৬ জনই থাকেন (হাসি)। প্রত্যেক ১০ বা ২০ বছর অন্তর সেই মুখ বদলায়। সেটা সব ক্ষেত্রেই। এটা ইন্ডাস্ট্রি আর দর্শক বেছে নিয়েছেন। সেটাও ভাবতে হবে। আমি সুরকার হিসাবে কাজ পাচ্ছি কেন জানেন? শ্রোতা চাইছেন বলে। না চাইলে আমাকেও সরে যেতে হবে।

‘গৃহপ্রবেশ’ ছবিতে শুভশ্রী গঙ্গোপাধ্যায়, জীতু কমল।

‘গৃহপ্রবেশ’ ছবিতে শুভশ্রী গঙ্গোপাধ্যায়, জীতু কমল। ফাইল চিত্র।

প্রশ্ন: প্রবুদ্ধ বন্দ্যোপাধ্যায়, দেবজ্যোতি মিশ্র, জয় সরকার— এঁদের কাজ নিয়ে কী বলবেন?

ইন্দ্রদীপ: তিন জনেই অসাধারণ। দেবুদা যাঁদের সঙ্গে কাজ করেছেন বা যা যা করেছেন, সেটা আমার কাছে শিক্ষণীয়। প্রবুদ্ধদার ছবি বা গানের সুর নিয়ে যা জ্ঞান, তা সঙ্গীত পরিচালকদের মধ্যে খুব কম থাকে। আর জয় আমার সমসাময়িক। আমাদের মধ্যে সেরা।

প্রশ্ন: দীর্ঘ দিন এখানে থাকার সুবাদে অনেক কিছু দেখেছেন, দেখছেন। ফেডারেশন বনাম পরিচালকদের দ্বন্দ্ব কতটা কাম্য?

ইন্দ্রদীপ: একটা ইন্ডাস্ট্রি একটা পরিবার। একটা পরিবারে মতবিরোধ থাকবেই। ঝগড়াও হবে। কিন্তু কোনওটাই দীর্ঘমেয়াদি নয়। আমার বিশ্বাস, সব কালো সরিয়ে আমরা আলোর পথের দিকেই এগিয়ে চলেছি। ইন্ডাস্ট্রির দিন ফিরতে আর দেরি নেই। তখন এই ঝগড়া-বিবাদ কিছুই থাকবে না।

প্রশ্ন: এই উন্নতির জন্য এই মুহূর্তে ইন্ডাস্ট্রির কী প্রয়োজন?

ইন্দ্রদীপ: আরও মন দিয়ে কাজ। বড়রা ছোটদের পাশে আরও দাঁড়াক। অনেক বেশি কমার্শিয়াল ছবি তৈরি হোক। তবেই ইন্ডাস্ট্রির উন্নতি। একটা কথা বলি, সকলেই ঐক্যবদ্ধ থাকবেন, এ রকম ‘ইউটোপিয়ান আইডিয়া’ কখনও বাস্তবে ঘটে না। তার পরেও আমার ভরসা এসভিএফ বা উইন্ডোজ়, সুরিন্দর ফিল্মসের মতো প্রযোজনা সংস্থা, প্রসেনজিৎ, দেব, জিৎ, আবীর, অঙ্কুশ, কৌশিকদা, সৃজিত, শিবু, রাজের উপর আছে। এঁরাই টলিউডকে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারবেন।

প্রশ্ন: এক দিকে, বাংলা ছবির বাজেট নিয়ে সকলে চিন্তিত, অন্য দিকে ছবির সাফল্য ঘিরে ‘সাকসেস পার্টি’! কী বলবেন?

ইন্দ্রদীপ: দেখুন, বাংলা সিনেমা কয়েক জনকে নিয়েই। এঁদের ছবিই ভাল ব্যবসা দেয়। অন্তত গত সাত-আট বছর ধরে তেমনই দেখছি। তাই নানা ধরনের ‘সার্ভাইভাল মডেল’ তৈরি হচ্ছে। আগে ইন্ডাস্ট্রি বাঁচুক। তা হলে প্রযোজক নিজেই ছবির বাজেট বাড়িয়ে দেবেন। রইল বাকি ‘সাকসেস পার্টি’। যাঁরা সফল হচ্ছেন তাঁরাই উদ্‌যাপন করছেন। সকলে তো করছেন না! অন্তত আমি তো এটুকুই জানি।

প্রশ্ন: কাজ নিয়ে তো বটেই, আপনার ব্যক্তিগত জীবন নিয়েও কিন্তু অনেকের কৌতূহল...

ইন্দ্রদীপ: (হেসে ফেলে) যেমন?

প্রশ্ন: যেমন, আপনি কেমন? শান্ত না ছটফটে?

ইন্দ্রদীপ: (আবার হাসি) আমি খুবই শান্ত। নইলে এত খ্যাতনামীদের সঙ্গে কাজ করতে পারি? খুব চেষ্টা করি সবার সঙ্গে, আমার দলের সঙ্গে মিলেমিশে কাজ করার। সব সময় যে সেটা হয়, তাও নয়। তবে আমার চেষ্টা থাকেই। আর শরীরে মায়া আছে বলেই না ঈশ্বর সুর দিয়েছেন!

প্রশ্ন: আপনার বেঁচে থাকার উৎসমুখ কী? একা বাঁচতে গিয়ে হতাশা বা একাকিত্বে ভোগেন?

ইন্দ্রদীপ: হতাশা আর বাতাসা অনেকটা এক। মাঝেমধ্যে জল দিয়ে খেলে ভালই লাগে (হাসি)। যে কোনও পেশাদার মানুষের জীবনেই এই দিকটা থাকে, অন্ধকার দিক। আর আমার বেঁচে থাকার উৎস আমার চারপাশের ভাল থাকা, ভাল রাখা। ভাল গান শোনা। আর ভাল সিনেমার সঙ্গে যুক্ত থাকা।

প্রশ্ন: আপনি কি স্বার্থপর, পরশ্রীকাতর?

ইন্দ্রদীপ: ভাল কাজ দেখলে ঈর্ষা হয়। জন্মেছিলাম স্বার্থপর হয়েই। জীবন আমাকে উদার হতে শিখিয়েছে। আরও হয়ে উঠতে হবে।

পরিচালক-সুরকার ইন্দ্রদীপ দাশগুপ্ত।

পরিচালক-সুরকার ইন্দ্রদীপ দাশগুপ্ত। ছবি: ফেসবুক।

প্রশ্ন: মানুষের মনে কী ভাবে থেকে যেতে চান?

ইন্দ্রদীপ: ভাল মানুষ হয়ে। (একটু ভেবে) সেটা মানুষের উপরেই থাক। আমায় মনে রাখলেই হবে। জীবনের শেষ দিনে গিয়ে একজন ভাল মানুষ হিসাবে পরিচয় পেলে আমার জন্ম সার্থক।

প্রশ্ন: শিল্পী মাত্রেই রোম্যান্টিক। আপনি কেমন প্রেমিক? এখনও বিয়ে করেননি। কবে বিয়ে করবেন?

ইন্দ্রদীপ: (জোরে হাসি), আমার প্রেম এখনও ভাষা খুঁজছে! যার বেশির ভাগটাই নীরব। আর বিয়ে? এটা একান্ত ব্যক্তিগত।

Indraadip Dasgupta Grihapravesh
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy