দূরত্ব মাপলাম। আধ কিলোমিটারের কম। শনিবার দুপুরে বান্দ্রা ব্যান্ডস্ট্যান্ডের তাজ ল্যান্ডস এন্ড-এ তিনি তখন নীল স্যুট পরে তাঁর নতুন শো নিয়ে কথা বলছেন। অমিতাভ বচ্চন। আর একটু দূরেই যাঁর বাড়ি, শনিবার ১০ অক্টোবর ছিল তাঁর জন্মদিন। রেখা।
ভেবেছিলাম ইন্টারভিউ শেষ করে মিস্টার বচ্চনের গাড়িটা ফলো করব। রেখার বাড়ি ক্রস করার সময় ঘাড় ঘুরিয়ে উনি দেখলেন কি না, জানার জন্য। কিন্তু তা করলে হয়তো ডেডলাইন মিস হত। তাই সেটা আর করা হয়নি। তবে তার আগে রেখার জন্মদিনে তাঁর বাড়ির পাশেই অনেক কথা বললেন শাহেনশা।
এটা কার সাক্ষাৎকার?
আমার। অমিতাভ বচ্চনের।
নাকি ‘ভাস্কর ব্যানার্জি’র? ‘পিকু’র পর তো কলকাতা এখনও ভাস্করবাবুতেই আচ্ছন্ন। তাই...
(সেই গলায়) হা হা হা হা। ওটা আপনাদের ভালবাসা। মাঝেমধ্যে এমন কিছু ছবি হয়, যা মানুষ মনে রাখে। ‘পিকু’ তেমনই একটা ছবি। দীপিকা, ইরফান, সুজিত বড্ড ভাল কাজ করেছিল। সবাই আইডেন্টিফাই করতে পেরেছিল চরিত্রগুলোর সঙ্গে। ‘পিকু’ এমন একটা ছবি যেটা করতে পেরে আমি নিজেও খুব গর্বিত।
আগামী কাল আপনার জন্মদিন। এই ইন্টারভিউটা বেরোবে জন্মদিনের পরের দিন। মিস্টার বচ্চন তিয়াত্তর নট আউট।
(উদাসীন এক হাসি) ব্যস... ওই আর কী! আজকাল আর জন্মদিন টন্মদিন নিয়ে ভাবি না। ব্যস, বেঁচে আছি। জিন্দা হু ওহি কাফি হ্যয়। সেটাই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। চোখ বন্ধ করলে তো সব শেষ। আজকাল জন্মদিন টন্মদিন এলে এ সব কথাই মনে হয়। শুধু ভাবি, যত দিন শরীর চলছে গাড়ি তত দিন চলবে।
গাড়ি তো ভালই চলছে।
(চোখ মেরে) প্লিজ নজর দেবেন না। চলছে নানা নিয়ম মেনে।
আজও তো প্রচুর কাজ করছেন।
কোথায় প্রচুর কাজ! একটা দু’টো সিনেমা। আর এই নতুন টিভি শো। বিশ্বাস করুন আমার বয়সে সত্যি কাজ পাওয়া মুশকিল হয়ে গিয়েছে। আমার হাতে সে রকম কাজ নেই। মাঝেমধ্যে সুজিত (সরকার), সুজয় (ঘোষ)-রা ভালবেসে কাজ দেয়।
প্লিজ। এটা আপনার সেই ট্রেডমার্ক বিনয়...
না না না বিনয় করছি না। দেখুন, আমি অভিনয় ছাড়া বিশেষ কিছুই জানি না। তাই যেটা জানি সেটা যত দিন করা যায়, সেই আশাতেই থাকি। সকালবেলা উঠে সেটে যাব, এটা আজও আমার কাছে বিরাট বড় অ্যাচিভমেন্ট। একই রকম এক্সাইটিং লাগে যা তিরিশ বছর আগে লাগত। এই যে আপনার সঙ্গে বসে আছি এখন বিকেল পাঁচটা। আমি কিন্তু সকাল ন’টায় বেরিয়েছি বাড়ি থেকে। কিন্তু লাস্ট শট হোক কী দিনের লাস্ট ইন্টারভিউ— সবসময় চাই আমার সেরাটা দিতে। দ্যাট কিপস মি গোয়িং।
খুব ক্লিশে পরের প্রশ্নটা।
কী?
কী বলে রোজ সকালে নিজেকে ইন্সপায়ার করেন মিস্টার বচ্চন?
যে দিন আপনার অফিস যেতে ইচ্ছে করে না, সে দিন সকালে আপনি কী করেন? নানাভাবে নিজেকে বুঝিয়ে টুঝিয়ে ঠিক যান তো অফিস! আমিও সেটাই করি। আর আমার কাছে সময়ের অত বিলাসিতা নেই। অনেক কাজ করা বাকি। তাই আজও একই এনার্জিটা রাখার চেষ্টা করি। সব সময় কি পারি? পারি না। তবে মাইন্ডটা পজেটিভ রাখি।
এই বলছেন কাজ নেই। আবার নতুন শো আসছে তো আপনার স্টার প্লাসে। ‘আজ কি রাত হ্যয় জিন্দেগি’।
এটা দারুণ একটা কনসেপ্ট। ইন্টারন্যাশনাল একটা ফরম্যাট থেকে নেওয়া।
শোটা কী নিয়ে?
আমাদের চারপাশে এমন কিছু মানুষ রয়েছেন, যাঁরা এমন কিছু কাজ করছেন, যেটা সাঙ্ঘাতিক ইন্সপিরেশনাল। পুরো ভারতে এ রকম লক্ষ লক্ষ মানুষ রয়েছেন— আমি তাঁদের এই শোতে আনছি। আমি চাই তাঁদের এই কাজ পুরো পৃথিবী জানুক, দেখুক। সেই মানুষগুলোকে নিয়ে তাঁদের জীবনটা সেলিব্রেট করতে চাই এই শোয়ের মাধ্যমে। জিজ্ঞেস করছিলেন না, জন্মদিনে কী করি বা কী ভাবি? এটাই ভাবি যে, এই জীবনে সবসময় ‘জশন’ থাকাটা উচিত। লাইফ ইজ টু বি সেলিব্রেটেড। প্রত্যেকদিন। প্রত্যেক মুহূর্ত।
এই চ্যানেলে একটা অনুষ্ঠান তো পনেরো বছর আগে আপনার জীবনটাই বদলে দিয়েছিল। ‘কৌন বনেগা ক্রোড়পতি’। রাস্তাঘাট খালি হয়ে যেত রাত ন’টায়।
ওটা আমার জীবনের অন্যতম সেরা এক্সপেরিয়েন্স। তবে রাস্তাঘাট খালিফালি— এ সব মিডিয়া বাড়িয়ে লেখে (হাসি)। আমি তো সেই সময় দেখতাম প্রচুর লোক আমার বাড়ির সামনে ঘোরাঘুরি করছে। তবে ‘কেবিসি’র থেকে এই শোটা একেবারেই আলাদা। এখানে আমরা নেগেটিভিটি সরিয়ে পজিটিভিটি সেলিব্রেট করছি।
বারবার নেগেটিভিটি নিয়ে বলছেন। এই নেগিটিভিটি আজকে চারিদিকে যা ঘটছে তাই দেখে মনে হয় আপনার?
হয়তো। বড্ড বেশি নেগেটিভিটি এক এক সময়। মিডিয়াতেও নেগেটিভিটিটা দেখছেন। খুন, রেপ— এগুলো প্রথম পাতায়। প্রত্যেকটার ফন্টসাইজ বিরাট। এ সবের মধ্যে যদি মানুষকে একটু হলেও ইন্সপায়ার করা যায়। মন্দ কী? এত কিছু খারাপের মধ্যে কোথাও তো একটা পোয়েটিক জাস্টিস থাকবে।
বুঝলাম।
আপনার সময় আছে হাতে?
কী বলছেন মিস্টার বচ্চন! আপনার ইন্টারভিউ আর হাতে সময় থাকবে না।
তা হলে আপনাকে একটা গল্প বলি। বাবা তখন খুব অসুস্থ। কিন্তু প্রত্যেক দিন সন্ধেবেলা আমার পুরনো ছবিগুলো দেখতেন। আমি শ্যুটিং করে ফিরে জিজ্ঞেস করতাম, ‘বাবুজি, কিঁউ রোজ দেখতে হো মেরে পিকচার?’ বহু দিন এটা বলার পর একদিন বাবুজি ধীরে ধীরে আমাকে একটা দারুণ কথা বলেছিলেন।
কী?
বলেছিলেন আমাদের জীবনে বেশির ভাগ সময়ই পোয়েটিক জাস্টিস হয় না। কিন্তু সিনেমাতে তিন ঘণ্টাতেই পোয়েটিক জাস্টিস দেখা যায়। আমার কাছে সেটা খুব ইন্সপিরেশনাল। বাবুজির এই কথাটার মাহাত্ম্য উনি চলে যাওয়ার পর বুঝেছিলাম। এত নেগেটিভিটির মধ্যে যদি একটু আলোর রোশনাই দেখতে পাই, সেটাও তো তা হলে পোয়েটিক জাস্টিস।
‘আজ কী রাত জিন্দেগি’র প্রোমোতে দেখলাম খুব নাচছেন। একটা সবুজ ট্রেডমার্ক ঘড়িও পরছেন আজকাল!
(হাসি) একদম সস্তা ঘড়ি। প্লাস্টিকের ব্যান্ড। বৃষ্টি পড়লে নষ্ট না হয়ে যায়।
হা হা হা হা। এটা কোনও কথা হল? অমিতাভ বচ্চন প্লাস্টিক ব্যান্ডের ঘড়ি পরবে?
হা হা হা হা।
মাঝে একবার ইন্টারভিউ করেছিলাম। মনে হয়েছিল মিডিয়ার ওপর খুব রাগ আপনার। আজ কি মিডিয়ার ওপর রাগ কমেছে?
কোনও দিন রাগ ছিল না। আমি মিডিয়াকে খুব শ্রদ্ধা করি। প্রচুর ভাল জিনিস মিডিয়া আমাদের সামনে রাখে। আর আমি এটাও মনে করি মিডিয়ার একটা সিক্সথ্ সেন্স আছে। সব সময় তারা যে ঠিক আমি বলছি না। কিন্তু বেশির ভাগ সময় তাদের বিশ্লেষণ আমি খুব মন দিয়ে পড়ি বা শুনি। যে জিনিসটা সাধারণ মানুষ দেখতে পায় না, সেটা মিডিয়া দেখতে পায়...

মিস্টার বচ্চন, এটা কি আপনার শ্লেষ?
(একটু রেগেই) আপনার মনে হল আমার গলাতে কোনও সারকাজম আছে? একেবারেই না। আমি বিশ্বাস করি এটা।
নিজে তো সারা দিন প্রচুর ট্যুইটও করেন?
হ্যাঁ, স্মার্টফোন এসে যাওয়াতে পুরো দুনিয়াটাই বদলে গিয়েছে। আজকের দিনে আগামী কাল সকালের খবরের কাগজের পেজ ওয়ান ছাপতে চলে যাওয়ার পরও রাত দু’টোয় আমরা আরও লেটেস্ট খবর পেয়ে যাই। নিউজের এই দিকটা আমার ফ্যাসিনেটিং লাগে। আর ট্যুইটার কী ফেসবুক করতেও আমার দারুণ লাগে।
আমাকে অনেকে বলেছিল আমার একজন মডারেটর রাখা উচিত যে হয়তো আমার ট্যুইটার বা ফেসবুক করে দেবে। কিন্তু আমি শুনিনি তাদের কথা। ওটা করলে ব্যাপারটা ইমপার্সোনাল হয়ে যাবে। তাই আমার ট্যুইটার কী ফেসবুক আমি নিজেই হ্যান্ডেল করি।
ইন্টারভিউ শেষের আগে দু’টো প্রশ্নের প্লিজ জবাব দিন! কলকাতায় কবে ফিরছেন আবার শ্যুটিং করতে?
সুজয় ঘোষ একটা ছবি প্রোডিউস করছে। সেই ছবিটা করতে নভেম্বর মাসেই আবার কলকাতায় আসছি।
আর ‘বেলাশেষে’ হিন্দিতে কবে করবেন আপনি?
হা হা হা হা। ‘বেলাশেষে’ ইজ আ ফ্যান্টাস্টিক ফিল্ম। কবে করব তো আমি জানি না। কাউকে তো একটা ভাবতে হবে। আমি কী করে বলব?
আপনি তো সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের রোলটায়? স্বাতীলেখা সেনগুপ্তর রোলটা কি জয়া বচ্চন করবেন?
(হাসি) পুরোটাই ডিরেক্টরের ভাবনার ওপর। বাট, আবার বলছি, ‘বেলাশেষে’ দারুণ একটা ছবি।
আমার পরের ছবিতেও ‘ভাস্কর ব্যানার্জি’
বললেন সুজিত সরকার
পয়লা অক্টোবর তারিখটা এলেই একটা অদ্ভুত ফিলিং হয় আমার। মনে হয় আর তো দশ দিন... তার পর এগারো তারিখ সেই মানুষটার জন্মদিন।
অমিতাভ বচ্চন।
আমার ‘পিকু’র ‘ভাস্কর ব্যানার্জি’।

প্রত্যেক বছর জন্মদিনে একটা কেক আমি দিই ওঁকে। কিন্তু এ বছর বোধহয় ওঁকে আমার বার্থডে গিফ্ট দেওয়া হয়ে গিয়েছে।
‘পিকু’র ‘ভাস্কর ব্যানার্জি’ চরিত্রটাই এই বছরে আমার বার্থডে গিফ্ট অমিতজিকে। ‘পিকু’ রিলিজের পর থেকে এমন একটাও আড্ডা হয় না, যেখানে আমরা ছবিটা নিয়ে কথা বলি না। প্রত্যেক আড্ডাতে ‘পিকু’ প্রসঙ্গ আসবেই। ইনফ্যাক্ট আমাকে অনেকে বলেছে, আমার ‘পিকু’র সিক্যুয়েল করা উচিত। ‘পিকু টু’, ‘পিকু থ্রি’...।
এই নিয়ে একদিন অনেকের সঙ্গে আড্ডা হচ্ছিল ওঁর বাড়িতে। দূর থেকে দেখছিলাম উনি আমাদের কথা শুনে হাসছেন। সব আলোচনা শেষ হওয়ার পর আমার দিকে তাকিয়ে শুধু বললেন, ‘‘আর ‘পিকু’র সিক্যুয়েল নিয়ে কথা বলে কী হবে! আমাকে তো সুজিত মেরেই ফেলল!’’
ওঁর কথা শুনে আমি লুকোনোর পথ খুঁজছি। কিন্তু সাহস সঞ্চয় করে বলেছিলাম, ‘‘অমিতজি, ‘পিকু’র সিক্যুয়েল আপনাকে ছাড়া কোনও দিন হবে না। কী করে করব, সেটা আমার উপর ছেড়ে দিন।’’ আমার কথা শুনে খুব হেসেছিলেন অমিতজি।
আজকে আনন্দplus-কেই জানাচ্ছি, হয়তো এ সপ্তাহেই আমি ওঁকে নিয়ে একটা প্রোজেক্ট ঘোষণা করব। হ্যাঁ, আমার পরের ছবিতেও উনি থাকবেন।
এমনিতে জন্মদিনের দিন বিশেষ বাড়াবাড়ি পছন্দ করেন না অমিতজি। তবে যারা ওঁর ঘনিষ্ঠ, তাদের জন্য উনি সময় ঠিক বের করবেনই।
আমি কতটা ঘনিষ্ঠ, তা নিজে মুখে বলতে পারব না। কিন্তু এটুকু বুঝি পৃথিবীতে কিছু মানুষের সঙ্গে ওঁর চোখে চোখে কথা হয়। উনি যে সেই জায়গাটা আমাকে দিয়েছেন, তার জন্য আমি ধন্য।
চাইব খুব ভাল থাকুন অমিতজি। আরও ভাল ভাল ছবি করুন। আর আমাদের দু’জনের পরের ছবিটাও যেন ‘পিকু’র মতোই সবার খুব ভাল লাগে।