Advertisement
E-Paper

কবির লড়াই

এত দিন ছিল সোশ্যাল মিডিয়ায়। এ বার এল প্রকাশ্যে। কবীর সুমন-শ্রীজাত মুখ খুললেন তাঁদের ফেসবুক পোস্ট নিয়ে। শুনলেন স্রবন্তী বন্দ্যোপাধ্যায়এত দিন ছিল সোশ্যাল মিডিয়ায়। এ বার এল প্রকাশ্যে। কবীর সুমন-শ্রীজাত মুখ খুললেন তাঁদের ফেসবুক পোস্ট নিয়ে। শুনলেন স্রবন্তী বন্দ্যোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ১৫ এপ্রিল ২০১৫ ০১:৩৬

আইপিএল-এর মাঠ নয়, পুরভোটের যুদ্ধও নয়, বাংলার পাঠকের বড় অংশ আজ দুই শিবিরে বিভক্ত। টক্কর চলছে জোরদার। বাংলাদেশের অভিজিৎ রায়ের খুনের পর থেকে প্রতিদিনই শ্রীজাত ফেসবুকে পোস্ট করছেন তাঁর ‘অন্ধকার লেখাগুচ্ছ’-সিরিজের একটি করে কবিতা। এই কবিতার মধ্যে থাকছে সন্ত্রাস, মৌলবাদ-বিরোধী প্রতিবাদী স্বর। কবিতা বলছে মৌলবাদের কোনও ধর্ম হয় না। এই কবিতার হাত ধরেই পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তের বাঙালিরা পরস্পরের হাত ধরেছেন। সেই পোস্টের হাজার হাজার লাইক, শয়ে শয়ে শেয়ার।

অন্য শিবির বলছে, শ্রীজাত-র শিরদাঁড়া বিক্রি হয়ে গিয়েছে। শুধু তাই নয়, কুৎসিত ছড়াও লেখা হচ্ছে। অপর একদল তাঁর লেখা ‘অন্ধকার লেখাগুচ্ছ’র মধ্যে খুঁজছেন হিন্দু মৌলবাদের সমর্থন।

রীতিমতো বিধ্বস্ত লাগছিল শ্রীজাতকে। বললেন, ‘‘কবিতার জন্য এমন কুৎসা ছড়াবে, কখনও ভাবিনি। ফেসবুকে পোস্টগুলো যদি খেয়াল করেন, দেখবেন সেখানে ধরেই নেওয়া হচ্ছে আমার ২৬টি কবিতার ‘অন্ধকার লেখাগুচ্ছ’ সিরিজটি নাকি প্ল্যান করে আমি লিখতে বসেছি। আমার অ্যাকাউন্ট হ্যাকড হওয়াটাও নাকি একটা ডিজাইন। তাই প্ল্যানমাফিক সেটা নিয়ে স্টোরি হয়েছে।’’

কিন্তু হঠাৎ কবীর সুমন এই ষড়যন্ত্রের মধ্যে চলে এলেন কী করে? ‘‘সুমনদার সঙ্গে কিছু তো হয়নি,’’ শ্রীজাতর কণ্ঠে বিস্ময়। অথচ ফেসবুকে অভিজিৎ রায়কে নিয়ে শ্রীজাতর লেখা কবিতায় যে সমস্ত কমেন্টস রয়েছে, সেখানে সুমন বলছেন, ‘‘কই, বাবরি মসজিদ নিয়ে তো কবিতা হয় না?’’

তেলঙ্গানায় পাঁচ অপরাধীর এনকাউন্টারে মৃত্যু হয়েছে। কই, তখন তো ফেসবুকে এত কবিতার ঝড় ওঠে না

কবীর সুমন

কবিতার জন্য এমন কুৎসা ছড়াবে, কখনও ভাবিনি। আমার অ্যাকাউন্ট হ্যাকড হওয়াটাও নাকি একটা ডিজাইন

শ্রীজাত

কবীর সুমন কি তবে শ্রীজাতকে হিন্দু মৌলবাদী ভেবে বসে আছেন? ‘‘একেবারেই না! ক্রমাগত আমরা যদি নির্দিষ্ট কোনও ধর্মের কট্টরপন্থীদের বিরুদ্ধে বলতে থাকি, তা হলে কট্টরপন্থীরা আরও কঠোর হবেন। সম্প্রতি দক্ষিণ ভারতে ২০ জন কাঠুরেকে হত্যা করা হয়েছে। তেলঙ্গানায় পাঁচ জন অপরাধীর (ঘটনাচক্রে যারা মুসলিম) এনকাউন্টারে মৃত্যু হয়েছে। কই, তখন তো ফেসবুকে এত কবিতার ঝড় ওঠে না। অভিজিৎ রায়ের মৃত্যু নিয়ে প্রতিবাদ নিশ্চয়ই হবে। তার সঙ্গে এই ঘটনাগুলো নিয়েও যেন লেখা হয়।’’

পুরস্কার প্রত্যাখ্যান করার ঘটনা থেকেই বাংলার পাঠক দুই শিবিরে ভাগ হয়ে গিয়েছে, মনে করছেন কবীর সুমন। শ্রীজাত ‘হোক কলরব’-এর জন্য ‘তফাৎ’ কবিতাটা লেখার পর সংবাদমাধ্যমে বলা হয়েছিল শ্রীজাতর শিরদাঁড়া আছে। তাই তিনি মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের দেওয়া পুরস্কার প্রত্যাখ্যান করেছেন। আর কবীর সুমনের শিরদাঁড়া নেই, তাই তিনি পুরস্কার গ্রহণ করেছেন। কথায় কথায় সুমন বললেন, ‘‘কারা যেন ফেসবুকেও এই মতটা ছড়িয়ে দিতে শুরু করেছিল।’’ শ্রীজাত যদিও সাফ জানিয়েছেন তিনি কবীর সুমনের পুরস্কার গ্রহণ নিয়ে কোথাও কিছুই মন্তব্য করেননি। আর এর সঙ্গে ‘অন্ধকার লেখাগুচ্ছ’-এর কী সম্পর্ক, তা আজও তাঁর কাছে স্পষ্ট নয়। শ্রীজাত বা কবীর সুমন কেউই নিজেরা পরস্পর কথা বলে ঝামেলা মিটিয়ে নিতে চাইছেন না। সুমন প্রশ্ন তুলেছেন, ‘‘সংবাদমাধ্যমে আমার শিরদাঁড়া নেই বলে যখন পরিহাস করা হল এবং এমনও বলা হল যে বেচারা পুরস্কারের টাকায় পিয়ানো কিনবে, তখন শ্রীজাত চুপ করে ছিলেন কেন? আমার আর শ্রীজাতর যা সম্পর্ক, ওকে নিয়ে আমার সামনে কেউ মজা করলে আমি কিন্তু সেটার প্রতিবাদ করতাম।’’

সম্পর্কটা যদিও আগে অন্য রকম ছিল। শ্রীজাতর কবিতায়, সাক্ষাৎকারে বারবার উঠে এসেছে কবীর সুমনের নাম। আজও বললেন, ‘‘আমরা যারা লিখি, গান গাই, তারা প্রত্যেকেই কবীর সুমনের কাছে ঋণী। কারণ তিনি এক নতুন ভাষা আমাদের দিয়েছেন।’’

তা হলে তো সরাসরি কথা বলে নিলেই হত?

বেশ খানিকক্ষণ চুপ করে থেকে তিনি বললেন, ফোন তিনি করতে চান না।

শুধুই শ্রীজাতর নামে কুৎসা নয়, ফেসবুকে সম্প্রতি ‘স্থবির কুমন’ নামের এক ফেক প্রোফাইল তৈরি করে কবীর সুমনের নামে যা নয় তাই লেখা হচ্ছে। কবীর সুমন বললেন, ‘‘সারা জীবনে ইট-পাটকেল-কুৎসা আমার সঙ্গী। আমিই নাকি আমার স্ত্রীকে খুন করেছি। খেয়াল করবেন এই স্ত্রী হত্যার অপরাধ যাঁরা আমার ওপর চাপিয়ে দিচ্ছেন, তাঁরা অধিকাংশই পুরুষ। আসলে এখন পুরুষকারের অভাব। মেয়েরা অনেক বেশি শক্তিশালী। মেয়েরাই আমাকে বেশি পছন্দ করেন, কারণ আমি গান গাই। পুরুষরা সেটা সহ্য করতে পারেন না। তাই তাঁরা আমার নামে কুৎসা ছড়ান।’’

তিনি নিজে থেকেই বলে উঠলেন, ‘‘আমার সঙ্গে শ্রীজাতর লড়াই কেমন করে হবে! শ্রীজাত বড়জোর আমার সহকর্মী হতে পারে। তবে আমাকে এ বার রেহাই দিন। বুড়ো হয়েছি। নিজের মতো করে সুরের মধ্যে থাকতে চাই।’’

সমালোচনা শিরোধার্য। কিন্তু চার-পাঁচ জনের কুৎসা নিয়ে কিছু ভাবতে চাইছেন না শ্রীজাত। তবে আঘাত এসেছে বন্ধুদের থেকে। যাঁকে এক সময় সত্যিকারের বাঘ ভাবতেন, তাঁকে ঝুলনে সাজানো, দরদাম করে কেনা বাঘ দেখে মনখারাপ হয়েছে তাঁর। এত সবের পরেও হাজার হাজার অচেনা মানুষকে এই লড়াইয়ে সঙ্গে পেয়েছেন। ফেসবুকে ২৬টি কবিতা হারিয়ে যাওয়ার পরেও তাঁরাই নিজেদের সংগ্রহ থেকে ফিরিয়ে দিয়েছেন সেই সব কবিতা। পেয়েছেন সৃজিত মুখোপাধ্যায়ের মতো বন্ধুকেও। যিনি বললেন, ‘‘মৌলবাদ, হিংসা আর জীবনবোধ নিয়ে লেখা শ্রীজাতর এই কবিতাগুলো আজকের দিনের জন্য খুব গুরুত্বপূর্ণ।’’

কবীর সুমন স্পষ্ট জানিয়েছেন এই বিভাজন ফেসবুকের চৌহদ্দি থেকে রাস্তায় নামবে। লড়াই চলবে।

আর শ্রীজাতর উত্তর?

‘কর্ণের হত্যায় রুচি সে আমার নয়/ মানুষকে তো উপেক্ষারও যোগ্য হতে হয়।’

Kabir Suman Srijato facebook Srovonti Bandopadhyay srijit mukhopadhyay babri masjid
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy