Advertisement
E-Paper

কোনটা আসল জীবন তা বুঝে ওঠার সুযোগই দেয় না কলকাতা

পিঠের ভারী ব্যাগটা নিয়ে একগাদা ঘেমো শরীরের সঙ্গে সংঘাত করে, প্ল্যাটফর্মের বাইরে স্বপ্নের শহর কলকাতাকে আবিষ্কার করেছিলাম। আকাশ ঢাকা বড় বড় এসি’র খোপযুক্ত দেওয়াল আর তার ফাঁক দিয়ে কষ্ট করে দেখতে পাওয়া মাকড়সার জালের মতো বৈদ্যুতিক তার, আর মৃত্যুপ্রহরী কাকেদের কালো ডানার ফাঁকে এক চিলতে স্যালাইন চলা বিবর্ণ সাদাটে-নীল আকাশটাকে।

কৌশিক কর (নাট্য পরিচালক ও অভিনেতা)

শেষ আপডেট: ২৩ মে ২০১৬ ০০:০৩

পিঠের ভারী ব্যাগটা নিয়ে একগাদা ঘেমো শরীরের সঙ্গে সংঘাত করে, প্ল্যাটফর্মের বাইরে স্বপ্নের শহর কলকাতাকে আবিষ্কার করেছিলাম। আকাশ ঢাকা বড় বড় এসি’র খোপযুক্ত দেওয়াল আর তার ফাঁক দিয়ে কষ্ট করে দেখতে পাওয়া মাকড়সার জালের মতো বৈদ্যুতিক তার, আর মৃত্যুপ্রহরী কাকেদের কালো ডানার ফাঁকে এক চিলতে স্যালাইন চলা বিবর্ণ সাদাটে-নীল আকাশটাকে। তখনই রেসের লাইনে ‘on your mark’ পজিশনে বুকে বড় করে কার্বনের বাতাস ভরে নিয়ে, বাঁশির শব্দ (হয়তো ছেড়ে যাওয়া ট্রেনের হুইসল) কানে নিয়ে স্বপ্নের দৌড় শুরু করেছিলাম। বুঝেছিলাম ওই তারজালি ভেদ করেই পালকটা গুঁজে নিতে হবে সংগ্রহে।

মিনার্ভা থিয়েটারের বিজ্ঞাপনে পেশাদারি অভিনেতা নির্বাচনের লড়াইটা যত না কঠিন ছিল তার চেয়ে ঢের কঠিন ছিল বাংলার মানুষজন ও আত্মীয়পরিজনদের বোঝানো যে এই চাকরিটা খাওয়ার নাকি গায়ে মাখবার। বিডন স্ট্রিটের প্রতিটি হাতে-টানা রিকশা,পান-তেরঙ্গার পিক, দড়ির আগুন, পায়রার গম, খদ্দের ধরার বেশ্যা, ভোজপুরী ফিল্মের পোস্টার, পুরানো কাপড়ের বান্ডিল আর নিমতলা অভিমুখী শেষ যাত্রার শকট যানে নিজেকে আর কলকাতাকে দ্রুত চিনে ফেলার অভিযোজনের লড়াই।

লড়াই এর মধ্যেই কলকাতা ও মানুষগুলোকে চিনে ফেলার, জেনে ফেলার অভিজ্ঞতা লুকিয়ে আছে। শহর কলকাতা মানুষকে গড়েছে ওই দেওয়াল, তার আর ট্রামলাইন-এর পাঁজরের মধ্যেই। বাঙালি শিল্পের বাজার বলতে এই শহর। শুধু দক্ষতা ও ভালবাসা একমাত্র চাবিকাঠি নয়। সেটা বুঝতে বুঝতেই এগনো। এই খাঁচায় সবুজের আশ্বাস চাওয়া কবি কখনও কাটা পড়েছেন ট্রাম লাইনে আবার কখনও পালিয়ে গেছেন শিলাইদহে। কিন্তু আমি জেনেছিলাম কারখানার ৯’টার ভোঁ পড়ার পরেই দৌড় শুরু হয় এখানের মানুষদের। তার আগের মুহূর্তটা শুধু বাদড়ের মতো হেঁটমুন্ড হয়ে কাটিয়ে নেওয়া। খাদ্যগ্রহণ আর বিষ্ঠাত্যাগের দ্বার যেখানে একই, সেখানে নিজের মস্তিস্ক আর শরীরকে দু’ভাগে ভাগ করে নিয়ে শুধু সিঁড়িগুলোকে টপকে ওই খোলা ছাদের দিকে এগনোর চলাটা শুরু। চলছি আজও। সিঁড়ি এখনও পায়ের নীচে যেটা দিয়ে নেমে যাবার আর ওপরে ওঠার দুটো পথই আছে।

রাজা লীয়রের হেলমেটে মুখ ঢেকে প্রত্যেক দিন সৈনিকের পার্ট বলতে বলতে জেদটা চেপে বসে। সেই সৈন্যই অস্ত্রচালনা করতে করতে খুব সামান্য সময়ের কিন্তু কঠিন লড়াই লড়ে রাজা চন্দ্রগুপ্তের শিরোপা পাওয়ার যাত্রাটাও কিন্তু চমৎকার। যখন হল ভর্তি মানুষ হাততালি দেয় ওই পর্বের কাটা সৈনিকের জন্যই। এমনই একটা দিনে কলকাতা আমাকে আমার প্রিয় মানুষটার চলে যাবার খবর দেয়। মায়ের মৃতদেহ ২০০ কিলোমিটার দূরে রেখে হাহাকার করতে করতে চন্দ্রগুপ্তের মা মুরাকে বলে যাওয়া সেই সংলাপ ‘মা তুমিই আমার ধর্ম, তুমিই আমার সব’-এর সময়টা, আজও রবীন্দ্রসদনের প্রতিটি শো-এ অন্ধকার মঞ্চে আমার বুক কাঁপিয়ে দেয় অজান্তেই। কলকাতাকে অন্তত এই একটি কারণেই ভোলা অসম্ভব।

এর পরই দ্রুত বদল। কলকাতার অপর প্রান্তটি ভারী আলোকিত। এখানে রাত হয় না। দক্ষিণ কলকাতায় এসেই বুঝলাম একটা ওপর পালিশ করা গ্লোসাইনের আলো আর মেকআপ করা মুখগুলো একটা মায়ানগর তৈরি করে ওত পেতে বসে আছে। যেন ইচ্ছা পূরণের কারখানা। ভাবখানা এমন যেন কোনও অতৃপ্তি নেই। আর সব পাওয়ার মাঝেই একটা গভীর কালো অসুখ দানা বেঁধে বসছে। নাইটক্লাব, দুরন্ত গতির চারচাকা, মাখনের মতো অনাবৃত নারীচরণযুগল, তারকাখচিত ফ্ল্যাশলাইট সব, সব আছে এখানে। ইউনিভার্সিটির বইপড়া-বিপ্লব, ঠান্ডাঘরে শুয়ে সর্বহারার জন্য কুম্ভীরাশ্রু, মহানায়কের পায়ের তলায় স্বপ্নের বাজার, ওপার বাংলা থেকে আসা অগুন্তি দালালচক্র, কিছু কৃষ্ণবর্ণ, কিছু পাহাড়ি মানুষের একার সংসার, কিছু ‘হিন্দিভাষীবাঙালি’-র একে অপরকে না-চেনা, ভুল বানান লেখা দেওয়াল, মাথামোটা টিভি ধারাবাহিকের আকাশজোড়া কারসাজি আর মনোরোগ বিশেষজ্ঞদের ভরা বাজার ... সব সব আছে। এই কলকাতার ভাবখানা এমন যেন, ‘প্রাণে খুব বেঁচে আছি’ ... তাই হয়তো গরু-শুয়োর-অক্টোপাস-রিকশাওয়ালা যা পায় সব প্রাণ পেটের মধ্যে পুড়ে গিলে নেবার একটা লাগাতার প্রচেষ্টা করে যায়। ভড়কে যাওয়ার আগের মুহূর্তে বইমেলা ফেরত কোনও নতুন বন্ধুকে ‘চোখের বালি’ কিনে ফিরতে দেখে বুঝলাম সদ্য ঋতুপর্ণ ঘোষের ফিল্ম মুক্তি পেয়েছে বা বিভুতিভূষণ নামের কোনও লেখক পরিচিতি পেলেন দেবের ক্যারিশ্মায়। অবাক রে বাবা! খেলাটা ধরে ফেলতে সুবিধা হোল। দ্রুত ঢুকে পড়া গেল শপিং মলে কারণ মানুষ হবার কারখানা ওগুলোই। তারপর একটা প্রোডাক্ট সেজে বাজারে নিজের দর হাঁকার কাজটা সেরে ফেলতে পারলেই কেল্লাফতে।


সৌমিত্র চট্টপাধ্যায়ের সঙ্গে।

যখন এসব ভেবে বড় বঁটির সামনে কাতলামাছের মতো ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে আছি খদ্দেরের অপেক্ষায় এই ভেবে যে কেউ এসে কচ করে কেটে থলেতে পুরে নিয়ে আমার দাম দেবে, ঠিক তখনই কেউ কেউ আমাকে আঁশ থেকে তুলে এনে একুরিয়ামে রাখল। কেউ চৌবাচ্চায়, কেউ পুকুরে। বুঝলাম প্রাণ দেওয়ার মানুষেরও অভাব নেই। কিন্তু আধার আর পাত্র অনুযায়ী বিভেদ আছে। তাদেরও বিক্রি হয়ে যাবার ইতিহাস আছে। কিন্তু ট্রাম লাইনে রক্তের দাগ আর মহিনের ঘোড়াগুলির ক্ষুরের শব্দ তাদের আজও মাতিয়ে রাখে। অন্য এক পথ চলা শুরু করলাম। নিজের নখ কেটে কলম ধরলাম। পরজীবী ভাব ছেড়ে নিজেই পরিচালনায় এলাম। অভিনেতার দাবি টুকু বিক্রি করলাম না। দেখলাম সেই সব জ্যোৎস্না খোঁজা মুখগুলো জোনাকির মতো জ্বলতে জ্বলতে (বা ওগুলো হয়তো মোবাইলের এলসিডির আলো, আমি ভুল দেখে থাকতেও পারি) মঞ্চের চারিপাশে আমার তালে মাথা নাড়াচ্ছে। ওদের খিদে বাড়িয়ে দেবার সঙ্গে সঙ্গেই আমার কলকাতাকে ভালবেসে ফেলাটা শুরু হয়ে গেল।

এখন ভাল লাগে শহর জুড়ে নিজের নাটকের বা ফিল্মের পোস্টারে নিজের মুখ আর নাম দেখলে। আর ভাললাগার পাশাপাশি রাস্তায় আচমকা মোটরগাড়ি ব্রেক কষলে যে পোড়া গন্ধ আর তীক্ষ্ণ শব্দ হয় সেগুলোও টের পাই। বুঝি সেই অসুস্থ মস্তিষ্কগুলো কিছুতেই শান্তি পাচ্ছে না, যতক্ষণ না আমি চিনা মিউজিক শুনে কাঁধ নাচাচ্ছি।

চাওয়া পাওয়ার হিসাবটা এতটাই আপেক্ষিক যে কলকাতায় একটা টের পেতে না পেতেই আর একটা এসে পড়ে। একটা ছবির পোস্টারের আঠা শুকোতে না শুকোতেই আর একটা পোস্টার পড়ে। লাল বাড়িগুলো নীল-সাদা হয়ে যায়। গেরুয়া রঙ উঁকি মারে আসন্ন সময়ের ঘন্টা বাজিয়ে। বিজ্ঞাপনে ঘোষিত হয় পৃথিবী গোল নয়, চারকোনা-ছোট্ট। এক সময় দেখি সেই সব মুখ ঢেকে যাওয়া পোস্টার-বিজ্ঞাপন-সেলফোনের মাঝে আমিও একটি নেটওয়ার্ক এর একটি বিন্দুস্থান যেন- মাকড়সার জালের বাঁকের একটি অংশ। ভারী ব্যাগ কাঁধে করে কলকাতায় প্রথম আসা কোনও যুবক ওই হুইসল আর বৈদ্যুতিক তারের বেড়াজালের মাঝখান দিয়ে আমাকে দেখে দম নিয়ে নিচ্ছে যার বুকে এখনও ধানক্ষেতের গন্ধ লেগে আছে। একদিন সেও আমার মুখে একগাল সিগারেটের ধোঁয়া ছেড়ে বলবে ‘এই তো জীবন কালীদা’।

কোনটা জীবন তা বুঝে ওঠার অবকাশ কলকাতা আমায় দেয় না। কারণ যেখানে জীবন ছিল পর মুহূর্তেই সেখানে বালি সিমেন্টের স্তূপ। শহর গ্রাস করে নিচ্ছে গ্রাম গুলোকে। দেখি নিউটাউন, দেখি পলতা। হাজার হাজার মানুষ গুলো বিবর্তনবাদের নিয়ম অনুযায়ী কোথায় হারিয়ে যাচ্ছে। পরগণার ইতিহাস কলকাতার গর্ভে তলিয়ে যাচ্ছে। আর সাদা ফ্যাকাশে জড়বুদ্ধি সম্পন্ন লোকগুলো লে লে করে সেই সব দখল নিচ্ছে। ব্যস্ত কলকাতা, বিপন্ন কলকাতা।

এর মাঝেও কলম চালাচ্ছি থিয়েটার গড়ব বলে। নানা চাওয়া পাওয়ার হিসাবে আমি আর নেই। একটা লম্বা পথ চলা শুধু। হিসাব ইতিহাস করবে। বা হয়তো করবে না। বিক্রির বাজারে মাল্টিপ্লেক্স। এই বাজার ড্রিম সিটি। এই বাজার বিকিয়ে দেওয়া সভ্যতার বাজার।এখানে বন্ধু আছে কর্মক্ষেত্রের, প্রেমিকা আছে যৌনজীবনের, অভিভাবক আছে অণুশাসনের, দর্শন আছে বিস্ময়ের।

তবুও কলকাতাকে ভাল না বেসে থাকা যায় না। আসলে খারাপ-বাসাটা এমন ভাবে পেয়ে বসেছে যে দেখতে ভাল লাগে নাকতলা মিনির শেষ বাসটায় বিয়ারবার-ফেরত টলমল পায়ে একশো রাজাদের। অ্যালকোহলের ম্যাজিকে এই দমবন্ধ মানুষগুলো মধ্যরাতে বাড়ি ফেরে যখন, তখন এক গুচ্ছ রাজার আক্ষেপ বা আস্ফালন ভাল লাগায়। স্বপ্নগুলোতো ওদের বুকের ভিতরেই আছে আর ওই বুকগুলো থাকে কলকাতাতেই। আর মুখ! সে না হয় অন্য লেখাতেই বলব। যেখানে গৌরচন্দ্রিকার মুখোশের ভূমিকা থাকবে অনেকখানি।

Kaushik Kar Soumitra Chatterjee Entertainment
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy