Advertisement
E-Paper

নদীর ওই পারে কোথাও একটা তার বাড়ি ছিল...

যত বার বর্ডার পার হবে মানুষ, তত বার ‘দোহাই আলি-দোহাই আলি’ ধ্বনির সঙ্গে ঋত্বিকের ক্যামেরা এসে ধাক্কা মারবে দেশভাগের বিয়োগচিহ্নের উপর! লিখছেন কৌশিক সেনযত বার বর্ডার পার হবে মানুষ, তত বার ‘দোহাই আলি-দোহাই আলি’ ধ্বনির সঙ্গে ঋত্বিকের ক্যামেরা এসে ধাক্কা মারবে দেশভাগের বিয়োগচিহ্নের উপর! লিখছেন কৌশিক সেন

শেষ আপডেট: ০৪ নভেম্বর ২০১৪ ১২:০০

জানা যায়, ঋত্বিকের জন্মের আগেই, তার মা ‘বেরিবেরি’ রোগে আক্রান্ত হয়ে ঢাকার হাসপাতালে ছিলেন। যমজ শিশু জন্মগ্রহণ করেছিল— তারা সময়ের আগেই পৃথিবীতে এসেছিল, দু’জনেই ছিল অসুস্থ এবং খানিক অপরিণত। এক পুত্র ও এক কন্যা। নামকরণ করা হয়েছিল ‘ভবা’ ও ‘ভবি’। কার্তিক ও অঘ্রাণ মাসে যখন দু’-এক ফোঁটা বৃষ্টিতেই কনকনে শীত লাফ দিয়ে পড়ত— ‘ভবা’ তখন তুলোর বাক্সে বন্দি হয়ে থাকতে চাইত না। ‘কন্যা’টি কাঁদত, কিন্তু ‘ভবা’ নিঃশব্দে হাত-পা ছুড়ে জানান দিত নিজেকে।

তার পর বহু কষ্টে ও যত্নে, নানান ঘুমপাড়ানি গান, দিদি ও বৌদিদের শাড়ির গন্ধ আর মায়ের শরীরের তাপে ও মমতায় শেষ পর্যন্ত বড় হল তারা...এতটাই বড় হলেন ঋত্বিক ঘটক ওরফে ‘ভবা’ যে সাধারণের চোখে তিনি হলেন ‘খ্যাপাটে’ এক মানুষ। কাজ নিয়ে, সৃষ্টি নিয়ে মত্ত থাকা এই শিল্পী অতঃপর হয়ে উঠলেন নানান গল্প-রূপকথা-উপকথার নায়ক। কত সত্যি-মিথ্যে মিলিয়ে চলচ্চিত্রপ্রেমী বাঙালি তাঁর কত রকমের মূল্যায়ণ করেছে। তাঁর সৃষ্টি আজ নানান গবেষণার বিষয়। ঋত্বিকের চলচ্চিত্র নিয়ে আলোচনা, বিচার-বিশ্লেষণ যে কোনও সময় হতে পারে। হচ্ছেও। বলা বাহুল্য, আমি তার জন্য যোগ্য ব্যক্তি নই। ঋত্বিকের সৃষ্টির কথা আরও এক বার মনে পড়ল অতি সম্প্রতি বর্ধমান বিস্ফোরণ কাণ্ডে যে শব্দটি বহু জনকে নাড়িয়ে দিয়ে গিয়েছে, তর্কে লিপ্ত করেছে— সেই ‘অনুপ্রবেশ’ শব্দটি দেখে।

প্রখ্যাত ফরাসি চলচ্চিত্র পরিচালক রেনোয়া তখন ভারতবর্ষে ‘দ্য রিভার’ ছবিটির শ্যুটিং করছেন। এই বঙ্গেও কাজ হয়েছিল একটা গুরুত্বপূর্ণ অংশের। এক দিন দক্ষিণেশ্বরের দিকে রেল স্টেশনের কাছে শ্যুটিং ছিল। সেখানে রেনোয়া দেখেছিলেন রেলে করে কাতারে কাতারে শরণার্থী আসছে। ঋত্বিক ঘটককে ক্যামেরাম্যান রামানন্দ সেনগুপ্ত বলেছিলেন, সেই দৃশ্য দেখে রেনোয়া তীব্র প্রতিক্রিয়া জানিয়েছিলেন। রেনোয়ার মতো বিদেশি পরিচালকের ওই কষ্ট পাওয়ার অনুভূতি গভীর ভাবে স্পর্শ করেছিল ঋত্বিককে। কারণ, ‘দেশভাগ’ কী? কেমন সে যন্ত্রণা তা তো জানেন ঋত্বিক! তিনি বলেছিলেন, “জাতীয় মুক্তি আন্দোলনের পিঠে ছুরি মেরে আপোষের স্বাধীনতা এল...।”

পদ্মার নির্জন চরে, বাঁশের সেতু পেরিয়ে লাল কৌপিন পরা, ডুগডুগি বাজানো যে বহুরূপীর সঙ্গে দেখা হয়েছিল ঋত্বিকের, সে বলেছিল, “খোকাবাবু, ভয়কে জয় করতে শেখ।” ঋত্বিক এবং এই পার-ওই পারের কত সহস্র মানুষ যে সেই সময়ে ‘ভয়’ কে ‘জয়’ করে লড়াই করেছেন তার ইয়ত্তা নেই। ১৯৪৮ সালে ঋত্বিকের পিতা কলকাতায় চলে আসেন। রাজশাহি জেলার ও পারে, মুর্শিদাবাদ জেলার বহরমপুরে তখন তাঁদের ঠিকানা। বাসে করে লালগোলাতে গিয়ে পদ্মার তীরে দাঁড়িয়ে থাকত সে। এ পারে দাঁড়িয়ে দেখত ও পারের আকাশ, ঘর, বাড়ি। মনে মনে বুঝত, কোনও দিন ও পারে আর যাওয়া হবে না। দেশভাগের বেইমানি কোনও দিন ভুলতে পারেননি ঋত্বিক। সেই কষ্ট বুকে নিয়েই ‘গণনাট্য’ সঙ্ঘের সঙ্গে এসে মেলা, ‘নবান্ন’ নাটকে অভিনয়, সেই সূত্রেই বিজন ভট্টাচার্য, কালী বন্দ্যোপাধ্যায়, শোভা সেন, হেমাঙ্গ বিশ্বাস, সলিল চৌধুরী, উৎপল দত্ত, প্রভা দেবী, তৃপ্তি মিত্র, মমতাজ আহমেদ, সাধনা রায়চৌধুরী এবং অবশ্যই শম্ভু মিত্র— ‘দুঃসময়’ কখনও কখনও মহাপ্রতিভাবানদের একত্রিত করে।

আজও হাজরা মোড়ে, ওই ‘প্যারাডাইস কাফে’র দিকে অবাক হয়ে চেয়ে থাকি। ওইখানে মৃণাল সেন, ঋত্বিক ঘটক, হৃষিকেশ মুখোপাধ্যায়, নবেন্দু ঘোষ, তাপস সেনরা আড্ডা দিতেন! সিনেমা-নাটক-সাহিত্য নিয়ে চলত তুমুল আলোচনা! ঋত্বিকের ‘দলিল’ নাটকের সেই বয়োজ্যেষ্ঠ মানুষটির কথা মনে পড়ে— যে চিৎকার করে বলে, ‘পদ্মামারে ছাইড়্যা ক্যান যামু?’

সত্যি— কেন যায় মানুষ? কেন ভিটে-মাটি ছাড়তে হয়? কেন হয় সে অনুপ্রবেশকারী? এবং তার পর বেআইনি ভাবে ঢুকে পড়ার পর কোন মন্ত্রবলে, কারা ‘তাদের’ করে দেয় ‘ভোটার’? সেই ভোট-যাদুতে যাদুকরের টুপি থেকে বার হয় কত রকমের তাস... কখনও তাদের জন্য রাজনৈতিক বাবুদের চোখে বান ডাকে, কখনও আগুন ঝরে। গল্পটা পাল্টায়নি। তাই ঋত্বিককে ভোলা শক্ত। নানান তর্কে-বিতর্কে, নানান আবেগে ও যুক্তিতে, নানান সুকথা-কুকথায় ঋত্বিক মিশে থাকবেন এই মাটিতে, এই নদীর জলে।

যত বার বর্ডার পার হবে মানুষ, তত বার ‘দোহাই আলি-দোহাই আলি’ ধ্বনির সঙ্গে ঋত্বিকের ক্যামেরা এসে ধাক্কা মারবে দেশভাগের বিয়োগচিহ্নের উপর! ‘কোমলগান্ধার’ চলচ্চিত্রের নায়ক-নায়িকা ভৃগু আর অনসূয়া হাতে হাত ধরে দাঁড়িয়ে থাকবে পদ্মার পাড়ে— ভৃগু হাত তুলে অনসূয়াকে দেখানোর চেষ্টা করবে— নদীর ওই পারে কোথাও একটা তার বাড়ি ছিল, সে বাড়িতে শাঁখ বাজত, সন্ধ্যাপ্রদীপ জ্বলত— গাছতলায় মা দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করত...অপেক্ষা করত...অপেক্ষা করত...

ritwik ghatak ritwikkumar ghatak kaushik sen ritwikghatak
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy