Advertisement
E-Paper

বিজয়া না হলে সত্যজিৎ হয় না

সদ্য প্রয়াত শাশুড়ি বিজয়া রায়-কে নিয়ে লিখছেন পুত্রবধূ ললিতা রায়দিনটা খুব এলোমেলো লাগছে। মায়ের মুখটা ভেসে বেড়াচ্ছে সারা বাড়িতে। আজ যেন মা বড্ড বেশি মনের ভেতর আনাগোনা করছেন। মনে পড়ে যাচ্ছে বাবার কথা। এ বাড়িতে বিয়ে হয়ে আসার পর খুব কম সময়ই একসঙ্গে ওঁদের দু’জনকে দেখেছি। বাবা তত দিনে বেশ অসুস্থ, আর মাও বাবার রুটিনে নিজের জীবনটাকে বইয়ে দিয়েছিলেন। কী অসম্ভব বন্ডিং ছিল দু’জনের। আজ তো মনে হচ্ছে, বাবার বেস্ট ফ্রেন্ড ছিলেন মা। চিত্রনাট্য লেখা থেকে বাবাকে সময় মতো ওষুধ খাওয়ানো, সবেতেই মায়ের ভূমিকা ছিল অনিবার্য।

শেষ আপডেট: ০৫ জুন ২০১৫ ০০:০১

দিনটা খুব এলোমেলো লাগছে। মায়ের মুখটা ভেসে বেড়াচ্ছে সারা বাড়িতে। আজ যেন মা বড্ড বেশি মনের ভেতর আনাগোনা করছেন। মনে পড়ে যাচ্ছে বাবার কথা। এ বাড়িতে বিয়ে হয়ে আসার পর খুব কম সময়ই একসঙ্গে ওঁদের দু’জনকে দেখেছি। বাবা তত দিনে বেশ অসুস্থ, আর মাও বাবার রুটিনে নিজের জীবনটাকে বইয়ে দিয়েছিলেন। কী অসম্ভব বন্ডিং ছিল দু’জনের। আজ তো মনে হচ্ছে, বাবার বেস্ট ফ্রেন্ড ছিলেন মা। চিত্রনাট্য লেখা থেকে বাবাকে সময় মতো ওষুধ খাওয়ানো, সবেতেই মায়ের ভূমিকা ছিল অনিবার্য।

মায়ের পরামর্শে ফেলুদার গল্পে বদল

আসলে ওই রকম বিদুষী, দেশি বিদেশি সাহিত্যানুরাগী মহিলা আমি খুব কম দেখেছি। ইংরেজি-বাংলা দুই ভাষার গোয়েন্দা গল্পের ছিলেন একনিষ্ঠ পাঠক। সেই কারণে শুধু চিত্রনাট্যই নয়, ফেলুদা লেখার সময় মায়ের মতামতের ওপর বাবা পুরোপুরি নির্ভরশীল ছিলেন। মা ছিলেন এক দিকে প্রচণ্ড মাতৃসুলভ, কিন্তু নিজের বিশ্বাস থেকে, পড়াশোনা থেকে যখন কোনও মতামত দিতেন, সেই মতামতেই নিজে অটুট থাকতেন। এবং সত্যজিৎ রায়ের মতো মানুষও ফেলুদার লেখা বা গোয়েন্দা গল্প নিয়ে ‘মঙ্কু’ কোনও মতামত দিলে সেটা দ্বিতীয়বার ভাবতেন। এমনও হয়েছে মায়ের জন্য বাবা বহু গল্প পাল্টেছেন।

মা না পড়লে বাবার চিত্রনাট্য ফাইনাল হত না

যত দূর মনে পড়ছে ‘আগন্তুক’ ছবিতে একটি দৃশ্য ছিল, যেখানে মমতাশঙ্করের হাতে বাবা আগাথা ক্রিস্টির এমন একটা বই ধরাতে চেয়েছিলেন যাতে উইল নিয়ে নানা কথাবার্তা আছে। বাবা তো ভেবেই পাচ্ছেন না কোন বইটা ধরাবেন। এই রকম একটা সময়ে মায়ের শরণাপন্ন হলেন বাবা। মাকে জিজ্ঞাসা করাতে মা ফস করে বলে দিলেন ‘পেরিল অ্যাট এন্ড হাউস’ বইয়ের নামটা। আগাথা ক্রিস্টির পুরো সিরিজটাই মায়ের মুখস্থ ছিল। বাবাকে এই রকম নানা ছোটোখাটো বিপদ থেকে মা বহুবার বাঁচিয়েছেন।

ভুলে যাওয়া সুর মনে করিয়ে দিতেন মা

একটা ঘটনার কথা বলি। বেশ রাত হয়েছে। দেখলাম বাবা বেডরুমে শুয়ে কোনও একটা ছবির সুর করছেন, খুব সম্ভবত সেটা ‘গুপী বাঘা ফিরে এলো’। বাবা হামিং করে সুরটা মাকে শুনিয়েছিলেন। কিন্তু পরের দিন সকালে উঠে দেখলেন সেই সুরটা তিনি কিছুতেই মনে করতে পারছেন না। বাবা তো পড়লেন বেজায় সমস্যায়। ব্যস আবার মায়ের ডাক পড়ল। মাকে বলতেই মা গেয়ে দিলেন সেই সুর—‘মোরা আসি ধেয়ে ধেয়ে’। এতটাই প্রখর স্মৃতি ছিল মায়ের। আর কণ্ঠস্বরে তো মধু ঢালা ছিল। বাবাও তাঁর মিউজিকের যাবতীয় কাজে মায়ের ওপর নির্ভর করতেন। বাবুর(সন্দীপ রায়) কাছে শুনেছি ‘চারুলতা’য় কিশোরকুমারকে দিয়ে বাবা যখন রবীন্দ্রসঙ্গীত রেকর্ড করার কথা ভাবেন তখন কিশোরকুমার চেয়েছিলেন গানটি মুম্বইতে যেন তাঁকে আগে রেকর্ড করে পাঠানো হয়, যাতে গানের গায়কি ও সুর সম্পর্কে তাঁর একটি ধারণা জন্মায়। এই অবস্থায় মাকে দিয়ে বাবা গানটি রেকর্ড করান। মা কিন্তু নিজের গান রেকর্ড করতে একটুও পছন্দ করতেন না। হিন্দুস্তান থেকে মায়ের রেকর্ডও বেরিয়েছিল। কিন্তু আশ্চর্য! মা সেই রেকর্ড কোনও দিন শোনেননি। এত যে সুন্দর গানের গলা, বাবার কোনও ছবিতেই মায়ের গান নেই কিন্তু। নিজের কোনও গুণকেই প্রকাশ্যে আনেননি কখনও। বাবাও সেটা চাননি। দু’ জনের এই অসম্ভব পরিমিতি বোধ আজও আমায় অবাক করে।

বাবার ওষুধের জন্য রুপোর কৌটো

বেশ কয়েক বছর ধরে টানা অসুস্থ ছিলেন মা। বলতে গেলে বিছানাতেই কাটাতেন সারা দিন। কিন্তু এই অসুস্থতা নিয়ে কোনও দিন ওঁকে বিরক্ত হতে দেখিনি। অথচ এই মানুষটাই বাবার অসুস্থতার সময়ে, বাবা যাতে একটুও বিরক্ত না হন সেই কথা ভেবে ওষুধ খাওয়ানো থেকে স্নান করানো সব দায়িত্ব নিজের হাতে তুলে নিয়েছিলেন। আমরা সচরাচর ওষুধটসুধ ছড়িয়ে ছিটিয়ে রাখতেই অভ্যস্ত। অথচ মা এমন শৌখিন ছিলেন বাবার সাত দিনের ওষুধ সাতটা আলাদা রুপোর কৌটোয় রাখতেন। এ দিক ও দিক গেলেই রুপোর কৌটো কিনে ফেলতেন। কোনও নার্স বা আয়া ছিল না। বাবাও বেশি দিন নার্সিং হোমে থাকতে হলে ছটফট করতেন, থেকে থেকেই মাকে বলতেন, ‘‘তুমি আমায় বাড়ি নিয়ে চলো’’। শেষ বয়সে ওঁদের দু’জনের মধ্যে ছিল আশ্চর্য বন্ধন।

বিমলার জন্য ঢাকাই শাড়ি

শৌখিন ব্রাহ্ম মহিলা বলেই হয়তো মায়ের রুচির ওপর বাবার ছিল অগাধ আস্থা। নিজে অসুস্থ হলেও বাড়িতে কোনও দিন অগোছালো পোশাকে মাকে দেখিনি। বাবার অধিকাংশ ছবিরই সাজপোশাকের দিকটা মা-ই দেখতেন। ‘ঘরে বাইরে’ ছবির শ্যুটিংয়ের সময় মা নিজের লোভনীয় ওয়ার্ড্রোব থেকে স্বাতীলেখা সেনগুপ্তকে একটি চমৎকার ঢাকাই শাড়ি পরিয়ে দিয়েছিলেন। চারুলতা থেকে বিমলা— সকলের লুকেই মায়ের পরামর্শ ছিল খুব বেশি।
আমার তো মনে হয় মা যে ভাবে বিশপ লেফ্রয় রোডের এই বাড়িটাকে নিজের হাতে বাবার ইচ্ছেমতো সাজিয়েছিলেন, বাবাও তেমনই নিজের ছবির আর্ট ডিজাইনে মায়ের রুচির ছোঁয়া রাখতেন।

বাবার প্রিয় মায়ের হাতের বেকিং

বাড়িতে থাকলে মায়ের হাতের বেকড করা যে কোনও রান্না খেতে বাবা খুব ভালবাসতেন। মায়ের বেকিংয়ে একটা জাদু ছিল। শত চেষ্টা করেও একই রেসিপির ওই স্বাদ আমি আনতে পারি না। অসম্ভব ভাল রান্না করতেন। রান্নার মধ্যে মায়ের মায়া মাখানো থাকত।

বাবার লেখা উদ্ধার হল মায়ের জন্য

আসলে অসম্ভবকে সম্ভব করতে জানতেন মা। ‘মাই ডেট উইথ অপু’, বাবার এই লেখাটা আমরা পেতামই না যদি না মা সেটা উদ্ধার করতেন। বাবা চলে যাওয়ার পর লেখাটা কোথাও খুঁজে পাওয়া যাচ্ছিল না। আমাদের খোলামেলা বাড়িতে কোন লেখা যে কোথায় গিয়ে পড়ে... ভাগ্যিস মায়ের কাছে এই লেখার একটা রাফ কপি ছিল। বাবার হাতের লেখা অসম্ভব স্টাইলিশ এবং ক্যালিগ্রাফিক। মা কি অনায়াসে সেটা পড়ে ফ্রেশ কপি করে দিলেন। মনে হল, এই লেখাটার সঙ্গে মা পুরোটাই পরিচিত। বললেই হুবহু বাবার লেখাটা আবার লিখে ফেলতে পারতেন।

বাবাকে লুকিয়ে মায়ের শপিং

বাবা বাড়িতে থাকলে দিনের বেশির ভাগ সময়ই স্টাডি রুমে কাটাতেন। আর মা, নিজের ঘরে বারান্দার গাছেদের সঙ্গে, কখনও বা রান্নাঘরে। সামনে থেকে দেখলে এই বন্ডিংটার মধ্যে খুব বাড়াবাড়ি কিছু খুঁজে পাওয়া যেত না। তবে আমরা একসঙ্গে প্রচুর বেড়াতে যেতাম। আর মা বেড়াতে গেলে সকলের জন্য মনে করে আলাদা আলাদা উপহার কিনতেন। উপহারের তালিকায় নামের সংখ্যা কখনও কখনও পঞ্চাশ ছাড়িয়ে যেত।
এই পুরো কেনাকাটাটা বাবাকে সম্পূর্ণ লুকিয়ে আমি আর মা সারতাম। বাবা এই সব পছন্দ করতেন না। আমার মনে আছে হোটেলের ঘরে বাবা ওপাশ ফিরে ঘুমোচ্ছেন, আমি আর মা পা টিপে টিপে কত জিনিস ঝটপট স্যুটকেসের মধ্যে পুরে ফেলছি। তখন কখনও মনে হয়নি উনি আমার শাশুড়ি, আমি ছেলের বৌ। মনে হত আমরা যেন খেলার সাথি।

বাবা চলে যাওয়ার পর অনেক সময় মায়েরও মনে হত হঠাৎ করে তিনিও একদিন আমাদের ছেড়ে চলে যাবেন। সন্ধ্যায় হয়তো কোথাও বেরিয়েছি আমরা। রাতে মা ডেকে পাঠালেন। আমরা তিনজন ঘরে ঢুকলাম। বাবার স্মৃতি জড়ানো ওই খাটে শুয়ে আমাদের দিকে
তাকিয়ে বললেন, ‘একটু কাছে আয়। তোদের একটু আদর করে নিই। বলা তো যায় না সকালে উঠে দেখলি আমি আর নেই।’

Satyajit Ray Bijoya Ray Lalita Ray sandip ray tollywood film
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy