Advertisement
০৭ মে ২০২৪
যুগে যুগে সুরস্রষ্টারা দুরূহতম সৃষ্টি লতা মঙ্গেশকরকেই দিয়ে গিয়েছেন
lata mangeshkar

Lata Mangeshkar Death: সুরের সমুদ্র মন্থন

সত্তর বছর ধরে সিনেমার অভিনেতা, নির্মাতা, সুরকার, এমনকি দর্শকও বদলেছে। থেকে গিয়েছে একমেবাদ্বিতীয়ম সেই স্বর্গকণ্ঠ।

লতা মঙ্গেশকর।

লতা মঙ্গেশকর।

চিরশ্রী মজুমদার 
কলকাতা শেষ আপডেট: ০৭ ফেব্রুয়ারি ২০২২ ০৯:২২
Share: Save:

লতা মঙ্গেশকরের বিস্তারকে শব্দে বর্ণনা দুঃসাধ্য। গণসংস্কৃতিতে সবচেয়ে প্রভাবশালী কে— সেই সমীক্ষায় অমিতাভ, কিশোর, সত্যজিতের চেয়েও এগিয়ে গিয়েছেন কিন্নরকণ্ঠী। গুলজ়ার এই ভাবনাতেই লতার পরিচিতিসঙ্গীত তৈরি করেছেন— “চেহরা ইয়ে বদল যায়েগা। মেরি আওয়াজ় হি পহেচান হ্যায়।”

সত্তর বছর ধরে সিনেমার অভিনেতা, নির্মাতা, সুরকার, এমনকি দর্শকও বদলেছে। থেকে গিয়েছে একমেবাদ্বিতীয়ম সেই স্বর্গকণ্ঠ। প্রতি প্রজন্মের নায়িকার থিম সং তাঁরই। নার্গিস (পেয়ার হুয়া), মধুবালা (পেয়ার কিয়া তো), মীনাকুমারী (চলতে চলতে), মালা সিনহা (আপকি নজ়রোঁনে), ওয়াহিদা (আজ ফির), বৈজয়ন্তীমালা (হোঁটো মে অ্যায়সি বাত), শর্মিলা (অবকে সাজন), জয়া (ম্যায়নে কাঁহা ফুলোসে), রেখা (পরদেশিয়া) শ্রীদেবী (ম্যায় নাগিন), মাধুরী (দিদি তেরা), কাজল (তুঝে দেখা), ঐশ্বর্য (হামকো হামিসে)... নায়িকার রূপ বদলেছে, কিন্তু একই স্বর নদী হয়ে সুরে প্লাবিত করেছে কাশ্মীর থেকে কন্যাকুমারি।

লতা যখন গাইতে এসেছেন তখনও ভারতের সিনেমা-সংস্কৃতির গায়ে কিছুটা মেহফিলের আঁশটে ছাপ। ছবিতে কাজ করলে, ভাল ঘরের মেয়ে মনে করা হয় না। সাদাত হাসান মান্টোর বাড়ির মেয়েরা নার্গিসের সঙ্গে বন্ধুত্বের কথা লোকলজ্জার ভয়ে গোপন রাখতেন। এই বিন্দুতে দাঁড়িয়ে স্বাধীন ভারতের সঙ্গীত ও সভ্যতার গতিপথটাই ঘুরিয়ে দিয়েছেন দীননাথ-দুহিতা। ভারতীয় গান ‘বাজ়ারু’— এই ধারণাটারই শুদ্ধিকরণ তাঁর ধ্রুপদী বেসের ‘ইনোসেন্ট ভয়েস’।

অভিনেতার চরিত্র ও বৈশিষ্ট্যের সঙ্গে মেলানো গায়কির প্রচলন করে প্লেব্যাককে শিল্পে পরিণত করেছেন তিনিই। প্রথম জমানায় গীতা দত্ত, জ়োহরাবাই অম্বালেওয়ালি, শমশাদ বেগম, নুরজাহানরা প্লেব্যাক করতেন। এঁদের ভরাট গায়কির পাশে লতার ফিনফিনে আওয়াজ অচল— বলেছিলেন শশধর মুখোপাধ্যায়। গুলাম হায়দারের চেষ্টায় লতা বম্বে টকিজ়ে গাইলেন। ‘জ়িদ্দি’-তে নজর কাড়ল তাঁর পবিত্র স্বর! অনিল বিশ্বাস মাইক্রোফোনে শ্বাস নেওয়ার কৌশল বাতলালেন, সঙ্গে দিলেন মহামন্ত্র। চিত্রনাট্য সিচুয়েশন জেনে, কথার মানে বুঝে শিল্পীর চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য গানে এনে সুর ধরার।

গানকে নিজের সুবিধামতো পাল্টে নেওয়ার প্রবণতাও ভাঙলেন লতা। সেই জাদু প্রথম ছড়ালো ‘মহল’-এর ‘আয়েগা আনেওয়ালা’য়। সুরে অশরীরী এফেক্ট আনতে গানের শুরুতে ‘খামোশ হ্যায় জ়মানা’ অংশে মাইক্রোফোনের কিছু দূরে দাঁড়িয়ে লতা কণ্ঠ ভাসিয়ে দিলেন। আস্তে আস্তে মাউথপিসের দিকে এগোতে এগোতে গাইলেন ‘আয়েগা..আয়েগা’। ভারত এমনই উত্তাল, গণআবেদনে গায়িকার নাম দিয়ে সিনেমার গানের রেকর্ড আবার বেরোল। এখান থেকেই নেপথ্যশিল্পীকে ‘ক্রেডিট’ দেওয়ার শুরু। গানের রয়্যালটির প্রচলন, নেপথ্যশিল্পীর পুরস্কার চালুর মূলেও তিনি। আর এই গান হন্টিং মেলোডির নতুন ধারা তৈরি করল। ‘আ জা রে পরদেশি’, ‘কহিঁ দীপ জ্বলে কহিঁ দিল’ (বিষক্রিয়ায় মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরে প্রথম যা গেয়েছেন), ‘আ জা রে পুকারে’ থেকে ‘মোরনি বাগা মা’ সব এই অলৌকিক-গোত্রের গান।

সুঅভিনেত্রী লতা মিমিক্রিতে ওস্তাদ। এই গুণই তাঁর প্লেব্যাকের সম্পদ। মীনাকুমারীর হালকা নাসিক্য স্বর মেশাচ্ছেন গানে (অজীব দস্তান)। নূতনের গলায় আর্দ্র ‘টেক্সচার’ তুলে আনছেন ‘বন্দিনী’তে। জয়ার কিশোরী-ইমেজ ধরে আধোস্বরে গাইছেন ‘বাহো মেঁ চলে আও’। জয়ারই প্রৌঢ়াবস্থার আবেগমথিত ‘কভি খুশি কভি গম’-এ গলাটা কাঁপিয়ে দিচ্ছেন! হেমার কথা বলার ছন্দ অক্ষত ‘শোলে’-র গানে। ডিম্পলের ‘ধূসর’ আওয়াজেই গাইছেন ‘দিল হুমহুম’। ষাটের লতা শ্রীদেবীর ছেলেমানুষি ফুটিয়েছেন ‘মেরে হাতোমেঁ’-তে। করিশ্মা-কাজল যুগেও তারুণ্যের ঝঙ্কার তাঁর কণ্ঠবীণায়। এ কাজে তিনি এতটাই পটু যে, ‘সত্যম শিবম সুন্দরম’-এ নায়িকার শৈশব ও যৌবনের কণ্ঠে তিনিই একা কুম্ভ। ‘কভি কভি’-তে একই গানে দু’জন অভিনেত্রীর কণ্ঠ। মহিলা সঙ্গীতশিল্পীদের সুর নাকি খুব উঁচু পর্দায় ওঠে না। সেই অসাধ্যসাধনও বালসুব্রহ্মণ্যমের সঙ্গে ‘দিল দিওয়ানা’, কিশোরের পাশাপাশি ‘মেরে নয়না শাওন ভাদো’-য়।

সুর ধরেছেন সূক্ষ্মতম বিন্দু থেকে। সঙ্গে নিখুঁত উচ্চারণ ও শব্দের সঙ্গে চমৎকার বোঝাপড়া। যেন এক পৃথিবী বেদনা পুরে রেখেছেন ‘তেরে বিনা জ়িন্দেগি’তে। অনুভবের জোরে দুটো পঙ্‌ক্তির খেলায় মাত করেছেন— ‘আজ ফির জীনে কি তমন্না হ্যায়, আজ ফির মরনে কা ইরাদা হ্যায়।’

কিশোরকুমার জীবনের প্রতিটা মুহূর্তকে সঙ্গীত বানিয়ে নিতেন। লতা নিজের জীবনকে উৎসর্গ করেছেন সঙ্গীতে। অতৃপ্ত শৈশব, অপূর্ণ সম্পর্ক, অভিযোগ, কুৎসা— কিছুই তাঁকে সাধনাভ্রষ্ট করেনি। যে লক্ষ্যে স্থির না থেকে ঝরে গিয়েছেন গীতা দত্ত। সুরসম্রাজ্ঞী জীবনের বিষপান করে তুলে এনেছেন সুরের অমৃতকলস, তাই ছড়িয়ে গিয়েছেন আট দশক।

সঙ্গীতের তো মৃত্যু নেই, তাই যুগাবসানও হয়নি। শুধু সরস্বতী বিসর্জনের দিনে দেশ থেকে কোহিনুরটা আবার হারিয়ে গিয়েছে!

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

lata mangeshkar Celebrity
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE