Advertisement
E-Paper

‘টাকা আর নামের পিছনে কখনও ছুটবে না’, বাবা শিখিয়ে গিয়েছিলেন

আজও বাবাকে নতুন করে জেনে চলেছি। এই জানা ফুরোবার নয়। এই নাচ সবাইকে একটা সূত্রে বেঁধে রাখে। আমাদের মনকে শুদ্ধ করে, ভাল একজন মানুষ হয়ে উঠতে সাহায্য করে, অনুপ্রেরণা জোগায়।

মমতা শঙ্কর

শেষ আপডেট: ০৮ ডিসেম্বর ২০২৫ ০৯:৫৯
উদয়শঙ্করের ১২৫তম জন্মবার্ষিকীতে মমতাশঙ্কর।

উদয়শঙ্করের ১২৫তম জন্মবার্ষিকীতে মমতাশঙ্কর। গ্রাফিক: আনন্দবাজার ডট কম।

আজ বাবার জন্মদিন। বড় হওয়ার পরে বাবাকে উদয়শঙ্কর হিসাবে চিনেছি। কিন্তু শৈশবে তাঁকে বাবা ছাড়া অন্য কিছুই মনে হত না। দেখতাম, অজস্র মানুষ ভিড় করে বাবাকে দেখতে আসতেন। আমি ভাবতাম, সকলের বাবাদেরই হয়তো মানুষ ভিড় করে দেখতে আসেন। বাবাকে আলাদা করে কখনও তারকা মনেই হত না। তার কারণ, তারকাসুলভ কোনও আচরণই ছিল না বাবার মধ্যে। বাবা-মা দু’জনেই খুব সাধারণ ভাবে আমাদের মানুষ করেছেন। বলা ভাল, অন্য ছেলেমেয়েদের চেয়েও আমরা সাধারণ ভাবে মানুষ হয়েছি।

আমার দাদা হস্টেলে পড়াশোনা করেছেন। কিন্তু আমি তো বরাবর বাবা-মায়ের সঙ্গেই থেকেছি। যাযাবরের মতো ঘুরে বেরিয়েছি ওঁদের সঙ্গে। এতে আমার পড়াশোনার কিছু ক্ষতি হয়েছে ঠিকই। কিন্তু তার বদলে আমি এত কিছু পেয়েছি, সমৃদ্ধ হয়েছি, নানা মানুষের সঙ্গে মিশেছি, তাতে আমি লাভবানই হয়েছি। আমার বাবা-মা কিন্তু আমার জন্য বাড়ি, গাড়ি, টাকাপয়সা কিছু রেখে যাননি। শুধু মূল্যবোধ রেখে গিয়েছেন। ওঁরা একটাই পরামর্শ দিয়ে গিয়েছেন, ভাল মানুষ হতে হবে। বাবা সব সময়ে বলতেন, “কখনও খ্যাতি ও টাকার পিছনে ছুটবে না। ভাল মানুষ হলে, সব এমনিতেই তোমার কাছে আসবে। টাকা ও খ্যাতির পিছনে ছুটলে, তা তোমার থেকে দূরেই সরে যাবে।”

কখনও বাবার পর পর অনেক অনুষ্ঠান থাকত। আবার এমন দিনও দেখেছি, বেশ অনেক দিন বাবার কোনও অনুষ্ঠান নেই। তখন আর্থিক অনটনও এসেছে। কারণ, বাবাকে পুরো নাচের ট্রুপ দেখতে হত। কিন্তু আমাদের আর্থিক অনটন টের পেতে দেননি কখনও। আর্থিক সচ্ছলতাও আমরা আলাদা করে বুঝিনি। সাধারণ একটা সমতা রাখা হত সব সময়। এই ভাবে ওঁরা বড় করেছেন বলেই, আজ আমার কোনও চাহিদাই নেই। আমার চারপাশের মানুষ জানেন, আমি কতটা সাধারণ ভাবে থাকি।

বাবা মারা যাওয়ার ঠিক আগে আমার মাথার উপর হাত রেখে বলে গিয়েছিলেন, “জীবনে যা হয়ে যাক, নাচটা ছাড়িস না। টাকা আসুক বা না আসুক, নাচ ছেড়ে দিস না।” অভিনয়টাও আমি বাবার থেকেই পেয়েছি। তাই নাচ ও অভিনয়ের মধ্যে থাকলে আমি সবচেয়ে আনন্দে থাকি। কখনও কাজ থেকে সামান্য বিরতি পেলেও, জানি, আবার নাচ ও অভিনয়ে ফিরব। দুটোই আমার কাছে খুব প্রিয়। আমার দুই ছেলের মতোই নাচ ও অভিনয় আমার খুব কাছের। সন্তানদের প্রসঙ্গে বলি, আমাদের ভাইবোনদের মধ্যে কিন্তু কোনও পার্থক্য তৈরি করেননি বাবা-মা। সমান ভাবে বড় করেছেন। শুধুই ভাল মানুষ হওয়ার কথা বলা হয়েছে। সেই একই শিক্ষা আমার সন্তানদের দিয়েছি। ছেলেদের সব সময়ে বলে এসেছি, মহিলাদের শ্রদ্ধার চোখে দেখবে। আমার যদি কন্যা থাকত, তাকেও বলতাম, পুরুষকে শ্রদ্ধা কোরো।

বাবার জন্মদিন উপলক্ষে শান্তিনিকেতনের সৃজনী শিল্পগ্রামে হয়ে গেল উদয়শঙ্কর নৃত্য উৎসব। রাজ্যের নানা প্রান্ত থেকে মোট বাইশটি নাচের দল এই বিশেষ উৎসবে যোগ দিয়েছিলেন। বাবা সব সময় বলতেন, নাচ, গান বা যে কোনও শিল্পে সবার আগে প্রাণ প্রয়োজন। নাচের মধ্যে দিয়ে নিয়মকানুন কত কী শেখা যায়! বাবার নৃত্যশৈলী শেখাতে গিয়ে বুঝি, এই নাচ জীবনের সঙ্গে কত ওতপ্রোত ভাবে জড়িত। আমি জীবনে যা করব, আমার নাচেও তা প্রযোজ্য। আমি নাচে যা করব না, তা আমার জীবনেও বাদ রাখব। আমারও উদয়শঙ্করের নৃত্যশৈলী বুঝতে অনেক সময় লেগেছে। আর আমার বিশ্বাস, এই নৃত্যশৈলী আমার ছাত্রীরা এগিয়ে নিয়ে যাবেন। বলা ভাল, ঈশ্বর আমার মাধ্যমে ওদের শিখিয়ে নিচ্ছেন। আমাদের নাচের স্কুলের ছাত্রীরা আজ নাচের শিক্ষিকা হয়ে গিয়েছেন। তাঁরা এই নৃত্যশৈলী এগিয়ে নিয়ে যাবেন। তা ছাড়া, আমার দুই পুত্রবধূও আগামী দিনে এই ধারা বজায় রাখবে। ওরা দু’জনই আমার ছাত্রী। ওরা প্রত্যেকেই এই নৃত্যশৈলী বহন করে নিয়ে যাবেন।

তবে বাবার বিষয়ে বলব, আজও ওঁকে নতুন করে জেনে চলেছি। এই জানা ফুরোবার নয়। এই নাচ সবাইকে একটা সূত্রে বেঁধে রাখে। আমাদের মনকে শুদ্ধ করে, ভাল একজন মানুষ হয়ে উঠতে সাহায্য করে, অনুপ্রেরণা জোগায়।

Uday Shankar Mamata Shankar
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy