Advertisement
২৫ এপ্রিল ২০২৪
Movie Review

মুভি রিভিউ ‘উড়োজাহাজ’: স্বপ্ন যেখানে প্রতিবাদে মেশে, সেখানেই উড়ান শুরু হয়

এরোপ্লেনের যেমন দুটো ডানা, সেই সম্পর্কেরও তাই। একটার নাম স্পর্শ আর দ্বিতীয়টা কল্পনা। মোটর মেকানিক বাচ্চু মণ্ডলের জীবনেও এই স্পর্শ আর কল্পনা— ডানার মতো খুলে যায়।

পার্নো মিত্র এবং চন্দন রায় সান্যাল। নিজস্ব চিত্র।

পার্নো মিত্র এবং চন্দন রায় সান্যাল। নিজস্ব চিত্র।

বিনায়ক বন্দ্যোপাধ্যায়
কলকাতা শেষ আপডেট: ১৪ ডিসেম্বর ২০১৯ ১৩:৪৩
Share: Save:

মাঝেমাঝে মাঝরাস্তায় স্বপ্নের সঙ্গে দেখা হয়ে যায় মানুষের। প্রথম প্রথম একটু অচেনা লাগে। কিন্তু, তারপর কখন যেন স্বপ্ন একটা চেনা মানুষের চেহারা নেয়। পলকেই স্বপ্ন এবং সেই স্বপ্নকে যে দেখছে তাদের দু’জনের মধ্যে একটা বন্ধুত্বের সম্পর্ক জন্ম নেয়।ঠিক যেমন গর্ভে থাকা অজাতকের সঙ্গে বন্ধুত্ব হয় মায়ের। সেই বন্ধুত্বের জায়গা থেকে দু’জন বন্ধু নিজেদের মধ্যে কথা বলতে শুরু করে। আর সেই কথোপকথনে একজন চুপ করে থাকলেও কিছু আসে যায় না, কারণ, মন হারিয়ে যাওয়ার পরেও নাড়িতে স্পন্দন খুঁজে পাওয়ার নামই হয়তো সম্পর্ক।

এরোপ্লেনের যেমন দুটো ডানা, সেই সম্পর্কেরও তাই। একটার নাম স্পর্শ আর দ্বিতীয়টা কল্পনা। মোটর মেকানিক বাচ্চু মণ্ডলের জীবনেও এই স্পর্শ আর কল্পনা— ডানার মতো খুলে যায়। বাচ্চু তার স্ত্রীকে(পার্নো মিত্র) ভালবাসে।নিজের ছোট ছেলেটাকে ইংরেজিতে কথা বলতে শুনে খুব মেঠো একটা গর্ব হয় তার। একেবারে ডাল-ভাত-আদরের মধ্যে প্রতিটি মুহূর্ত জড়িয়ে থাকে সে যতদিন না একটি উড়োজাহাজ তার দেহাতি জীবনে আন্তর্জাতিক মেঘকে টেনে আনে।

গ্রাম লাগোয়া জঙ্গলে একটি প্লেনকে পড়ে থাকতে দেখে বাচ্চু। নদী পেরিয়ে শুকনো পাতা মাড়িয়ে সে সেই প্লেনটার কাছে গিয়ে পৌঁছেছিল। শুকনো পাতায় জুতোর মশমশ শব্দে শতাব্দীর পর শতাব্দী মানুষের উপর মানুষের অত্যাচার আর ঔদ্ধত্যের গল্পই লেখা হয়েছে, তাই হয়তো বাচ্চু পায়ের জুতো খুলে প্লেনটার কাছে পৌঁছয়। আর প্লেনটাকে দেখার মুহূর্ত থেকে একটাই কথা পাক খায় তার মাথায়, কীভাবে সে প্লেনটাকে ওড়াবে। ভাঙা লজঝড়ে একটা প্লেনকে রং দিয়ে নতুন করে তোলে বাচ্চু। তার গ্যারাজের এক দাদাকে নিয়ে এসে প্লেনটা দেখিয়ে জানতে চায়, কীভাবে এই সেটার একটা ইঞ্জিন বানানো যায়।

ওই জঙ্গলের ভিতরেই অনেক অশরীরীর সঙ্গে দেখা হয়ে যায় বাচ্চুর। এরা কেউ গলায় ফলিডল ঢেলে মারা গেছে, কারও বা মুখে বালিশ চেপে ধরা হয়েছিল।কিন্তু তবু এরা কেউ ‘ভূত’নয়!মানুষ পরিচয় খারিজ হয়ে যাওয়ার পরেও মানুষ যেমন মানুষই থাকে, এরাও শরীর হারিয়ে ফেলে একটা শরীর হয়েই আসছে পর্দায়। একটা শরীর, যার কোনও প্রাণ নেই। ঠিক যেমন ইঞ্জিন নেই প্লেনটার। বাচ্চু কী তাহলে মৃত মানুষের প্রাণের মতো করেই ওই মৃত প্লেনের ইঞ্জিন খোঁজে, খুঁজে বেড়ায়?

আরও পড়ুন-মারা গেলেন মৌসুমি চট্টোপাধ্যায়ের মেয়ে পায়েল, শোকবার্তা বলিউডের

সেই খোঁজ তাকে শহরে নিয়ে যায়।শহুরে বাবু তাকে মাথার ডাক্তার দেখাতে বলেন।গ্যারাজের মালিক তার চাকরি খেয়ে নেওয়ার হুমকি দেয়।অবশেষে স্থিতাবস্থার পাহারাদার পুলিশ আসে তার বাড়িতে। বাচ্চুর বউ তাকে লুকিয়ে রাখতে চায়।ঠিক যেমন মা তার গর্ভের ভ্রূণকে।কিন্তু এই মাল্টিমিডিয়ার পৃথিবীতে কেউ আর কিছু লুকিয়ে রাখার জায়গায় নেই। যুদ্ধবিমানকে রোম্যান্সের বিমানে পাল্টে দেওয়ার যে স্বপ্ন বাচ্চু দেখছিল তা, একটা দুঃস্বপ্ন হয়ে তার কাছেই ফিরে আসে। কারণ, তার কল্পনাকেই পুলিশ-প্রশাসন রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে যুদ্ধ হিসেবে দাগিয়ে দিয়েছে।

ছবির একটি দৃশ্য

এই পৃথিবীতেভিন্নমত মাত্রেই যখন শত্রু, তখন বাতিল উড়োজাহাজকে ওড়াবার স্বপ্নে বাচ্চু নিজেই কি বাতিল হয়ে যায়? উড়ে যায়? কিন্তু যা বাতিল তা উড়তে পারে কীভাবে? নাকি এই খাঁচার ভিতর থেকে একমাত্র বাতিলেরই ওড়বার স্বপ্ন এবং স্পর্ধা আছে?

বুদ্ধদেব দাশগুপ্তর ছবি কোনও একরৈখিক গল্প বলে না কখনও।‘উড়োজাহাজ’ও তার ব্যতিক্রম নয়। কান কিংবা ভেনিসে যে ছবি নিয়ে অনেক চর্চা হবে আগামীতে, সেই ছবি কলকাতার হলে বসে দেখতে দেখতে পরিচালককে কুর্নিশ জানাতেই হয়, ভীষণ অসুস্থতার মধ্যেও এমন একটা সিনেমা তৈরি করার জন্য।যেখানে স্বপ্ন কোনও অচেনা আগন্তুক নয়।স্বপ্ন আসলে বন্ধ চোখের উপর এসে পড়া একটি চুমু কিংবা খোলা গলার একটি প্রশ্ন।

আরও পড়ুন-প্রেগন্যান্সির সাড়ে সাত মাস পর্যন্তও শুটিং করেছি: পায়েল

অভিনয়ে চন্দন রায় সান্যাল অনবদ্য। একজন মোটর মেকানিকের প্রাণের ইঞ্জিনের শব্দটাকে স্পষ্ট শোনা যায় তাঁর অভিনয়ে। পার্নো যথাসাধ্য সঙ্গত করেছেন তাঁর।

শিশুশিল্পী হরশিল দাস নজর কাড়ে। সামান্য উপস্থিতিতেও ছাপ ফেলেন সিদ্ধার্থ চট্টোপাধ্যায়। অসীম বসুর ক্যামেরা কিংবা অলোকানন্দা দাশগুপ্তের সঙ্গীত, বুদ্ধদেবের ছবির চরিত্র অনুসারে পরিমিত; চন্দনের বালিগঞ্জীয় উচ্চারণ মাঝেমাঝে কানে একটু ঠেকে বটে, কিন্তু এই ছবি তো উচ্চারণের অসাম্য নয়, স্বপ্নের সাম্যের কথা বলে। সেই স্বপ্নই হয়তো শেষ দৃশ্যে আতঙ্কের মধ্যেও জাগিয়ে তোলে উল্লাস, কথার মধ্যে থেকে কবিতা, মুখ থুবড়ে পড়ার আখ্যানে সেই বুনে দেয় স্বপ্নের উড়ান। বুদ্ধদেব দাশগুপ্তের ম্যাজিক সেখানেই।

(মুভি ট্রেলার থেকে টাটকা মুভি রিভিউ - রুপোলি পর্দার সব খবর জানতে পড়ুন আমাদের বিনোদন বিভাগ।)

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE