Advertisement
E-Paper

গৃহপ্রবেশ: প্রেম, পরিচয় আর হারিয়ে যাওয়া সম্পর্কের এক মর্মস্পর্শী অনুরণন

ঋতুপর্ণ ঘোষের সিনেমাকে শ্রদ্ধা জানিয়ে ইন্দ্রদীপ দাশগুপ্তের এই ছবিতে শুভশ্রী গঙ্গোপাধ্যায়, জিতু কমল, কৌশিক গঙ্গোপাধ্যায় আর সোহিনী সেনগুপ্তের অভিনয় অনবদ্য।

নিজস্ব প্রতিবেদন

শেষ আপডেট: ১৪ জুন ২০২৫ ১৭:৫৬
‘গৃহপ্রবেশ’ ছবির দৃশ্যে শুভশ্রী গঙ্গোপাধ্যায়, জীতু কমল।

‘গৃহপ্রবেশ’ ছবির দৃশ্যে শুভশ্রী গঙ্গোপাধ্যায়, জীতু কমল। ছবি: সংগৃহীত।

ইন্দ্রদীপ দাশগুপ্তের ‘গৃহপ্রবেশ’ প্রেম, আত্মপরিচয় আর সম্পর্কের টানাপড়েন নিয়ে এমন এক আবেগে মোড়া ছবি যে মনে দাগ কাটে নিজের অজান্তেই। ঋতুপর্ণ ঘোষের ছবির নিজস্ব ভাষা ও লিঙ্গ-পরিচয়ের বিষয়বস্তু এ ছবির অনুপ্রেরণা, তবে সে নিজগুণে অনন্য।

‘গৃহপ্রবেশ’ ছবির কেন্দ্রে রয়েছে উত্তর কলকাতায় বসবাস করা একটি পরিবার, একটি বিয়ে, না-বলা অনেক কথা আর কিছু আক্ষেপ। ছবি শুরু হয় দৈনন্দিন জীবনের আটপৌরে দৃশ্য দিয়ে, আর ধীরে ধীরে উঠে আসে একটা জটিল প্রশ্ন: আমরা আসলে কী আঁকড়ে ধরে বাঁচি? সম্পর্ক? স্মৃতি? না সমাজের দৃষ্টিভঙ্গি দিয়ে গড়ে ওঠা আত্মপরিচয়? উত্তর কলকাতার এই পুরনো বাড়িটা শুধু গল্পের পটভূমি নয়, সে নিজেই যেন এক চরিত্র। তার আনাচকানাচে হাত ধরাধরি করে থাকে নিরাপত্তা আর নিঃসঙ্গতা। গৃহপ্রবেশ, যা সাধারণত নতুন যাত্রা শুরুর প্রতীক, এখানে পরিণত হয় এক নির্মম ব্যঙ্গ-ইঙ্গিতে।

তিতলি (শুভশ্রী গঙ্গোপাধ্যায়) এ বাড়ির গৃহবধূ। বিয়ের মাত্র কয়েক দিনের মাথায় তার স্বামী শাওন (সুপ্রভ ঠাকুর) চলে যায় তার কর্মস্থানে, তিতলিকে ফেলে রেখে। আর ফেরে না। তবে তিতলি শ্বশুরবাড়ি ছাড়ে না। সে ঘরের কাজে ব্যস্ত থাকে, সব রীতি-রেওয়াজ মানে। মায়া-মমতার সম্পর্ক গড়ে তোলে ওই বাড়ির বাকি মানুষগুলোর সঙ্গে— যেন কিছুই ভাঙেনি। তার মধ্যেই এক নিঃশব্দ অপেক্ষা আর নানা না-পাওয়ার ভার জমতে থাকে ক্রমশ। স্বামীর প্রত্যাখ্যানের অস্বীকারেই যেন রয়েছে তার অস্তিত্বের মূল। সেই না-বলা যন্ত্রণা পরতে পরতে ফুটে ওঠে শুভশ্রীর চোখ আর শরীরী ভাষায়।

সোহিনী সেনগুপ্ত, কৌশিক গঙ্গোপাধ্যায় ‘গৃহপ্রবেশ’ ছবিতে।

সোহিনী সেনগুপ্ত, কৌশিক গঙ্গোপাধ্যায় ‘গৃহপ্রবেশ’ ছবিতে। ছবি: সংগৃহীত।

এই নৈঃশব্দের মধ্যে এসে পড়ে মেঘদূত (জীতু কামাল), বাড়ির হোমস্টের পেইং গেস্ট। শুরু থেকেই বোঝা যায়, মেঘদূতের উপস্থিতি শুধুই কাকতালীয় নয়। ওর চোখে কোথাও লুকিয়ে আছে এক গভীর বিষাদ, এক অতীতের ক্ষত। আস্তে আস্তে বোঝা যায় তিতলি আর মেঘদূত দু’জনেই শাওনের শিকার। শাওন তার সমকামী পরিচয়কে অস্বীকার করে যে জীবনধারা বেছে নিয়েছে তাতে ক্ষতবিক্ষত হয়েছে এই দু’টি জীবন। ছবির অন্যতম মর্মস্পর্শী মুহূর্ত তৈরি হয় যখন মেঘদূত সত্যিটা আবিষ্কার করে। শুধু প্রেম নয়, বিশ্বাস আর ভরসা ভেঙে যাওয়ারও মুহূর্ত এটা। জীতু কমলের সংযত অথচ আবেগঘন অভিনয় মেঘদূতের তীব্র ব্যথা বাঙ্ময় করে তোলে।

তিতলি চরিত্র শুভশ্রীর এক অন্যতম পারফরম্যান্স। কৌশিক গঙ্গোপাধ্যায় আর সোহিনী সেনগুপ্ত তিতলির শ্বশুর-শাশুড়ি হিসেবে অসামান্য। তাঁদের অভিনয়ে কোথাও দায়িত্ববোধ, কোথাও অনুশোচনা, কোথাও নীরব সহানুভূতি সবই ওঠে-নামে ঢেউয়ের মতো। সম্পর্কের ঘেরাটোপে তাঁদের ভূমিকা ছবিটিকে আরও বাস্তব, আরও অস্পষ্ট করে তোলে।

প্রতীপ মুখোপাধ্যায়ের ক্যামেরা ছবির আবহ তৈরি করে আলো-ছায়ায়। বন্ধ জানালায় এসে পড়া রোদ, ফাঁকা সিঁড়ি, থমথমে বসার ঘর মনে করিয়ে দেয় মূল চরিত্রগুলোর মনের অবস্থা। ইন্দ্রদীপের সঙ্গীতে এই বিষণ্ণ আবহ আরও ঘনীভূত হয়।

‘গৃহপ্রবেশ’ ছবিটির প্রধান দুর্বলতা শাওন। যে চরিত্রের চারপাশে এত কিছু গড়ে ওঠে, সে নিজে বেশ একমাত্রিক। তার মধ্যে নেই কোনও দ্বিধা, কোন গভীর মানসিক সংঘাত। সুপ্রভ ঠাকুরের অভিনয়ও বেশ নিস্তেজ।

কৌশিক গঙ্গোপাধ্যায়, সোহিনী সেনগুপ্ত, শুভশ্রী গঙ্গোপাধ্যায়।

কৌশিক গঙ্গোপাধ্যায়, সোহিনী সেনগুপ্ত, শুভশ্রী গঙ্গোপাধ্যায়। ছবি: সংগৃহীত।

ছবিটির সার্থকতা এটাই যে এখানে কিছুই সহজ নয়। কেউ সাদা নয়, কেউ কালো নয়। সব চরিত্রই ধূসর। সমাজের আচারবিচার, আত্মসম্মান বোধ আর ব্যক্তিগত জীবনের টানাপড়েনে জর্জরিত। প্রেমই হোক, যৌন পরিচয়ই হোক বা নিঃসঙ্গতাই হোক — সব কিছুই পরিচালক ইন্দ্রদীপ ছুঁয়ে গেছেন পরম যত্নে আর সংযমে। চার দেওয়ালের মধ্যে লুকিয়ে থাকা গোপন কথা আর গোপন থাকে না, কিন্তু রয়ে যায় সম্পর্কের বাঁধনগুলো মনের অলিগলিতে।

Subhashree Ganguly Indraadip Dasgupta Jeetu Kamal Kaushik Ganguly Sohini Sengupta Rudranil Ghosh
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy