Advertisement
১৯ এপ্রিল ২০২৪

বিয়ের ফাঁদে আর নয়

এমনটাই মনে করছেন আজকের তরুণ প্রজন্মের কেউ কেউ। কেন বিয়েতে এই অনীহা? উত্তর খুঁজলেন স্রবন্তী বন্দ্যোপাধ্যায়‘ম্যারেজ ইজ নট মাই কাপ অব টি।’ ‘আঠাশ বছর বয়স কেবল একমাত্র পুরুষের কাছে ফেরার সময় নয়।’ ‘আইনের চোখে বিয়েটা যত সহজ, বিয়ে থেকে বেরিয়ে আসার হ্যাপা ঠিক ততটাই কঠিন! কে চাপ নেবে?’ অবাক হচ্ছেন তো? অবাক হওয়ার কিছু নেই। খোঁপায় সোনার চিরুনি, লাল বেনারসির কনে সাজের ফ্যান্টাসি, প্রথম দেখা থেকে মালা বদল থেকে বেরিয়ে আজকের প্রজন্ম বিয়ের অস্তিত্বকেই তাদের জীবন থেকে চিরতরে ঘুচিয়ে দিতে চাইছে।

শেষ আপডেট: ১১ জুন ২০১৫ ০০:০৩
Share: Save:

‘ম্যারেজ ইজ নট মাই কাপ অব টি।’
‘আঠাশ বছর বয়স কেবল একমাত্র পুরুষের কাছে ফেরার সময় নয়।’
‘আইনের চোখে বিয়েটা যত সহজ, বিয়ে থেকে বেরিয়ে আসার হ্যাপা ঠিক ততটাই কঠিন! কে চাপ নেবে?’
অবাক হচ্ছেন তো? অবাক হওয়ার কিছু নেই। খোঁপায় সোনার চিরুনি, লাল বেনারসির কনে সাজের ফ্যান্টাসি, প্রথম দেখা থেকে মালা বদল থেকে বেরিয়ে আজকের প্রজন্ম বিয়ের অস্তিত্বকেই তাদের জীবন থেকে চিরতরে ঘুচিয়ে দিতে চাইছে। ফেসবুকে তৈরি হয়েছে অ্যান্টি-ম্যারেজ কমিউনিটি। সেখানে নিয়মিত কার ডিভোর্স হল, বিয়ে করে কে কোথায় কেমন করে যন্ত্রণায় কাতর, তার আপডেট দেওয়া হচ্ছে। ইন্টারনেটের অজস্র সাইটে দেওয়া হচ্ছে বিয়ে করার কুফল আর বিয়ে না করে ফুর্তিতে বাঁচার টিপস্ দেওয়া হচ্ছে। আর বিয়েহীন এই জ্বরে পুড়ে ছারখার কলকাতার প্রকাশ্যে চুমু খাওয়া প্রজন্মও।

• শুধু প্রেম, প্রেম চাই

বিয়ের সঙ্গে সঙ্গে প্রেমটাও কি এ বার খরচের খাতায়?

সেক্টর ফাইভে মোটা মাইনের চাকরি পাওয়া অরুণিমা খোলাখুলি বললেন, “দেখুন প্রেমে যাতে মজে থাকতে পারি, তার জন্যই তো বিয়ে করছি না। সময়টা বদলেছে সেটা তো সকলকেই মানতে হবে। কেবল একজনের সঙ্গেই প্রেম হবে? শুনতে খারাপ লাগলেও আমি বলতে বাধ্য হচ্ছি যে এটা ডাহা মিথ্যে কথা! এ রকম বলা হয়ে থাকে। এ বার বলুন আমার বিয়ে করা স্বামী কি কোনও দিন মেনে নেবেন যে ডিনারে বা ছুটি কাটাতে গিয়ে আমি আমার অন্য পুরুষ বন্ধুকে প্রেফার করছি? জানলেই তো অশান্তি শুরু। জেনেবুঝে এর পরেও কেউ বিয়ের কথা ভাবে না কি?” তা হলে কি কেবল অগুন্তি পুরুষ বা নারী বন্ধু রাখার লোভে বিয়ে ব্যাপারটাই এড়িয়ে চলছে আজকের প্রজন্ম?

• কোথায় মনের মতো তুমি?

আঠাশ বছরের রিসেপশনিস্ট অনন্যার গল্প কিন্তু সে কথা বলছে না। অনন্যার বাবা রিটায়ার করে যাওয়ায় মধ্যবিত্ত পরিবারে তাঁর বিয়ে নিয়ে সকলে তাড়া মারতে আরম্ভ করেছিল। সম্বন্ধও এল অনেক। কারণ তাঁর রং ফর্সা, মোটামুটি একটা চাকরিও আছে। কিন্তু সবটাই আটকে থাকল কফির চুমুকে! মনে হল অনেক দায়িত্ব আসছে! ছেলে নয়, ছেলের মাকে খুশি করতে হবে। কেউ আবার খুব নাক উঁচু, খুব ডমিনেটিং। কেউ আবার ধ্যাবড়া মোটা। অনন্যা বললেন, “মা গো! এক বিছানায় শোব কেমন করে! বাপরে....থাক এ সব।” অনন্যার মতো তিরিশ পেরনো ব্যাঙ্ক ম্যানেজার অরিন্দমেরও একই হাল। চাকুরিরতা শিক্ষিতা মেয়ে, তো দেখতে বেশ বাজে, মোটা। দেখতে ভাল তো, ইংরেজি উচ্চারণে হোঁচট খায়। নয়তো খুব ন্যাকা। অরিন্দম আফশোসের সঙ্গে বলেই বসলেন,

“সুন্দরী, বুদ্ধিমতী, চাকরি করা, মনের মতো হবে তার কোনও মানে নেই। দিব্যি আছি আমার ব্যাচেলর জীবনে।” কমিটমেন্টের কথায় পিছিয়ে আসা, বিয়ে নামের দায়িত্ব-প্যাকেজ এড়াতে সম্পর্কটাকেই ভেঙেচুরে ফেলা কিংবা পজেসিভ, ইমোশনাল, সেন্টিমেন্টাল গার্লফ্রেন্ড বা বয়ফ্রেন্ড স্ত্রী বা স্বামীরূপে অবতীর্ণ হলে আরও কী কী ঘটিয়ে ফেলতে পারে, সেই আশঙ্কায় নতুন প্রজন্ম বিয়ের দরজা বন্ধই রেখেছেন। তাঁরা জানেন ইচ্ছের বিরুদ্ধে বিয়েটা করে ফেললে সম্পর্কটাই তেতো হয়ে যাবে। তার চেয়ে বরং প্রেমটাই থাকুক। কিংবা কমিটমেন্টহীন লিভ-ইন। সিঙ্গল থাকলেই বা ক্ষতি কী? ভরপুর স্বাধীনতা তো!

• হঠাত্ কেন এমন?

মনোবিদ অনুত্তমা বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতে, বিয়ের মধ্যে নতুন প্রজন্ম আজ আর একসঙ্গে থাকার আনন্দ খুঁজে পাচ্ছেন না। আসলে বিয়ের চেয়ে বিয়ের আনুষঙ্গিক দায়িত্ব এখন এত বড় করে দেখা হয়, যেমন পরিবারের সঙ্গে পরিবারের বোঝাপড়া। বিয়ের মধ্যে যখন আরও পাঁচটা মানুষ চলে আসে, তখন সমস্যা বাড়তে থাকে। বিশেষ করে এখনকার দিনে যেখানে দিনের অধিকাংশ প্রোডাক্টিভ সময়টা আমাদের কাজকে ঘিরেই থাকে, সেখানে বিয়ে সূত্রে শাশুড়ি, শ্বশুর এই ধরনের সম্পর্ককে সময় দেওয়া বা স্বামীর আবেগকে প্যাম্পার করে চলা সম্ভব হয় না। তার চেয়ে বরং অফিস ফেরত রাতে পছন্দের বন্ধুর সঙ্গে নির্ভেজাল আড্ডায় যদি ক্লান্তি ঘুচে মনটা ফুরফুরে হয়ে যায়, সেটাই যথেষ্ট বলে মনে করছে আজকের প্রজন্ম। প্রেমের মধ্যে একটা রিল্যাক্সিং মুড থাকে। বিয়ে করে বাড়ি ফিরে যদি রাতের ডিনার বা শ্বশুরবাড়ির নেমন্তন্নর কথা ভাবতে হয়, সেখানে ফুর্তি আর থাকে না। দায়িত্ব নেওয়ার ভয়, আত্মবিশ্বাসের অভাব থেকেই বিয়ের বাজারে এখন মন্দা।

• আমাকে আমার মতো থাকতে দাও

কলেজের অধ্যাপিকা নীলাঞ্জনা দত্ত বিয়ের চেয়ে লিভ ইনকে গুরুত্ব দিচ্ছেন। কনট্র্যাকচুয়াল ম্যারেজে বিশ্বাসী নন তিনি। জানালেন, ভালবাসলে, ইচ্ছে হলে একসঙ্গে থাকব। সই করার তো কিছু নেই। তবে হ্যাঁ শ্বশুরবাড়িতে থাকা তাঁর পক্ষে সম্ভব নয়। ছেলে-মেয়ে দু’জনকেই বাড়ি থেকে বেরিয়ে আলাদা থাকতে হবে বলেই মনে করেন তিনি। বিয়ের পথে হাঁটা তাঁর পক্ষে সম্ভব নয়, কারণ জানেন তিনি কোনও দিন ‘বউ’ হতে পারবেন না। মোদ্দা কথা হল বিয়ে নয়, জাস্ট লিভ ইন। এটাও এক ধরনের কমিটমেন্ট ফোবিয়া বটে। কিন্তু বিয়েকে ঘিরে যে নিরাপত্তার কথা বলা হয় সেই নিরাপত্তাও কি আজকের প্রজন্মের মন টানে না? গলায় একটা আলগা ঝাঁঝ নিয়ে এসআরএফটিআই-এর এডিটিং-এর ছাত্রী অন্নপূর্ণা বসু বললেন, “পঁয়তাল্লিশ বা পঞ্চাশে গিয়ে আমার নিরাপত্তা হয়তো দরকার পড়বে। তো সেই কারণে আঠাশ বছরে আমি একজন পুরুষ নিয়ে একটা সম্পর্ক তৈরি করে বিয়ে করে ফেলব? আমি কি পাগল নাকি? একের পর এক সম্পর্কে গিয়ে আমি বুঝেছি স্টেবিলিটি আর রোম্যান্স একসঙ্গে পাওয়া যায় না। আমি আপাতত রোম্যান্স চাই।” আর বাবা, মা... তাঁরা কি মেয়ের বিয়ে নিয়ে চিন্তিত নন? মুচকি হেসে অন্নপূর্ণার সাফ জবাব, “হুঁ, বাবা, মা তো বলেই যাচ্ছে। আমি ভাবছি হঠাত্ যদি কাউকে আমার ভাল লেগে যায় তখন তার সঙ্গে খুব বেশি মিশব না। মানে পরিবার কেমন? শিক্ষা কী? রুচি কেমন? তার আগেই বিয়ে করে নেব। তার পর প্রেম করব। বাবা-মা ও খুশ!”

রিলেশনশিপ এক্সপার্ট প্রভা অজয় বলছেন, আজকের প্রজন্মের কমিটমেন্ট যা আছে তা কেরিয়ারের প্রতি, নিজের প্লেজার বা উপভোগের প্রতি। অর্থনৈতিক স্বাধীনতায়, ইন্টারনেটের খোলা উঠোনে ছেলে-মেয়ে উভয়ই অগুনতি সম্পর্কে জড়িয়ে পড়ছে এখন। তাঁদের ভয় হচ্ছে, শ্বশুরবাড়ি সামলাতে হলে, বাচ্চা চলে এলে, তাঁর কেরিয়ার, তাঁর নিজের মতো করে বাঁচাটা কোথাও থমকে যেতে পারে। এমন সম্পর্কের দিকে ঝোঁক বাড়ছে যা থেকে ইচ্ছে মতো অন্য সম্পর্কে চলে যাওয়া যায়।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE