Advertisement
২৫ এপ্রিল ২০২৪
আনন্দplus এক্সক্লুসিভ

সে দিন দু’জনে

তিনি নায়ক। ঘড়ির কাঁটায় দুপুর তিনটেয় হাজির। তিনি নায়িকা। যথারীতি লেট এবং লম্বা লেট। এ বার নায়িকা এসে যখন ফোটোশ্যুটের জন্য সিঁড়ির ধারে দাঁড়ালেন, তখন নায়কের খোঁজ নেই। তাঁকে ডাকতে ডাকতে নিয়ে আসার মাঝে আবার নায়িকা নিজের ঘরে ঢুকে গিয়েছেন। তাঁর নাকি আর একটু প্রসাধন বাকি। ক্রমেই উদ্বিগ্ন আর ধ্বস্ত হয়ে পড়ছেন বেচারি পরিচালক। পাঁচ তারা হোটেলের সেন্ট্রালি এয়ারকন্ডিশনড কামরাতেও ঘামছেন। এমন অনন্য, অবাস্তব প্রেক্ষাপটে কোনার স্যুইটে শুরু হল বিশেষ আনন্দplus আড্ডা। পনেরো বছর পর প্রত্যাবর্তনকারী জুটি প্রসেনজিৎ-ঋতুপর্ণা আর তাঁদের বহুপ্রতীক্ষিত কামব্যাক ছবির পরিচালক শিবপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়। সাক্ষাৎকার নেওয়া শেষ করে গৌতম ভট্টাচার্য-র মনে হল, এই ফিল্মের নেপথ্যে আগামী ক’মাসে যা যা ঘটবে সেটা নিয়েও একটা ফিল্ম তুলে রাখা উচিত...তিনি নায়ক। ঘড়ির কাঁটায় দুপুর তিনটেয় হাজির। তিনি নায়িকা। যথারীতি লেট এবং লম্বা লেট। এ বার নায়িকা এসে যখন ফোটোশ্যুটের জন্য সিঁড়ির ধারে দাঁড়ালেন, তখন নায়কের খোঁজ নেই। তাঁকে ডাকতে ডাকতে নিয়ে আসার মাঝে আবার নায়িকা নিজের ঘরে ঢুকে গিয়েছেন। তাঁর নাকি আর একটু প্রসাধন বাকি। ক্রমেই উদ্বিগ্ন আর ধ্বস্ত হয়ে পড়ছেন বেচারি পরিচালক। পাঁচ তারা হোটেলের সেন্ট্রালি এয়ারকন্ডিশনড কামরাতেও ঘামছেন। এমন অনন্য, অবাস্তব প্রেক্ষাপটে কোনার স্যুইটে শুরু হল বিশেষ আনন্দplus আড্ডা। পনেরো বছর পর প্রত্যাবর্তনকারী জুটি প্রসেনজিৎ-ঋতুপর্ণা আর তাঁদের বহুপ্রতীক্ষিত কামব্যাক ছবির পরিচালক শিবপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়। সাক্ষাৎকার নেওয়া শেষ করে গৌতম ভট্টাচার্য-র মনে হল, এই ফিল্মের নেপথ্যে আগামী ক’মাসে যা যা ঘটবে সেটা নিয়েও একটা ফিল্ম তুলে রাখা উচিত...

হিন্দিতেও কি এই জুটিকেই দেখবেন দর্শক? ছবি: কৌশিক সরকার।

হিন্দিতেও কি এই জুটিকেই দেখবেন দর্শক? ছবি: কৌশিক সরকার।

শেষ আপডেট: ১৪ অগস্ট ২০১৫ ০০:০১
Share: Save:

আপনারা আবার একসঙ্গে কাজ করছেন শুনে আনন্দplus-এর জ্যোতিষীকে দিয়ে আমরা আপনাদের কোষ্ঠী বিচার করালাম।

প্রসেনজিৎ: হোয়াট!

ইয়েস। আর জ্যোতিষী বলছেন জাতক আর জাতিকার বৈশিষ্ট্য হল:

এঁরা দু’জনেই সেল্ফ মেড।

দু’জনেরই মান-অপমান বোধ প্রখর।

দু’জনেই অসম্ভব উচ্চাকাঙ্ক্ষী।

দু’জনেরই ইন্ডাস্ট্রিতে নিজস্ব পাওয়ার গ্রুপ।

দু’জনের প্রবল ইগো।

তো উনি সব দিক ভেবে বলছেন ২০১৭-র মধ্যে আবার সংঘাত অনিবার্য।

(কয়েক মিনিট চুপ। তার পর সমবেত হাসি।)

প্রসেনজিৎ: সংঘাত হতে পারে।

ঋতুপর্ণা: হতে পারে?

প্রসেনজিৎ: হতেই পারে। নাথিং নিউ। ২০১৭তে হতে পারে। ২০১৮তে হতে পারে। আবার না-ও হতে পারে।

জ্যোতিষী বলছেন জাতিকার সময়জ্ঞানের অভাব হেতু সম্পর্কে সঙ্কট ঘনাতে পারে।

শিবপ্রসাদ: এইটা ভাল বলেছে।

প্রসেনজিৎ: সে দিন আমাদের পরের প্রজন্মের খুব বিখ্যাত নায়ক আমায় জিজ্ঞেস করেছিল যে, ঋতুদির পাংচুয়ালিটির অভাব নিয়ে এত কথা শুনেছি। তা হলে তোমরা এতগুলো ছবির পর ছবি করলে কী করে? এমনিতে যারা যারা আমাদের একসঙ্গে কাজ করার কথা শুনেছে, সবাই খুব খুশি। কিন্তু এই কথাটা থেকেই গেছে।

ঋতুপর্ণা: তুমি তাকে বললেটা কী?

প্রসেনজিৎ: এটাই বললাম যে ওই দেরি করে আসা-টাসাতে আমার এখন আর কিছু আসে যায় না। আমার ধৈর্য এখন অনেক বেড়ে গেছে। আরে বাবা, আমি ‘দ্য লাস্ট লিয়র’‌য়ের শ্যুটিংয়ে মিস্টার বচ্চনকে দেখেছি প্রীতি জিন্টার জন্য সারা দিন বসে ওয়েট করছেন। একটুও মাথা গরম করছেন না। ঋতুর লেট করাটাও এখন আমরা মজা হিসেবে ধরে নিয়েছি। ওটা এখন পার্ট অব দ্য প্রোডাকশন ডিজাইন। সংঘাত আগে যখন লেট করা নিয়ে হয়নি, তখন আজ নতুন করে হবে কেন? ঋতুর স্টুডিয়োতে আসা নিয়ে কত সব কাহিনি। ওর নাকি রোজ লেক গার্ডেন্স ফ্লাইওভারের কাছে এসে গাড়ি জ্যামে পড়ে যেত। তখন তো মোবাইলও ছিল না যে, কোথায় ঠিক জানা যাবে। একদিন আমি বললাম, ওরে গল্পটা চেঞ্জ কর। একবার স্টুডিয়ো থেকে ফোন গিয়েছে। নিজেই ফোন ধরে বলল, ঋতুদি তো বেরিয়ে গেলেন। আর একবার গোটা টেকনিশিয়ান্স ওর জন্য রেডি। ওকে ঘন ঘন ফোন করা হচ্ছে। ঋতু বলল এক ঘণ্টা ম্যাক্সিমাম, পৌঁছে যাচ্ছি। আসে না আসে না। তার পর আবার ফোন। শেষমেশ বলল, এই পৌঁছব। বোম্বে থেকে ফ্লাইটে বোর্ড করছি। ভাবা যায়।

ঋতুপর্ণা: বাহ! ভাল তো। আরে কাজটা যে কী স্পিডে তুলে দিই সেটা বললে না!

প্রসেনজিৎ: হ্যাঁ, সেটা ঠিক। প্রথমত, ঋতু রেডি হয় স্পুটনিকের মতো। সুপার স্পিডে। তার পর ফ্লোরে এসে যাকে যা করার, ছোটদের ছোটদের মতো, যাকে জড়িয়ে ধরার তাকে জড়িয়ে ধরে। কাউকে প্রণাম করে এমন ম্যানেজ করে দেবে— যে কেউ কিছু বলবে না। তার পর কাজটাও তুলে দেয় দারুণ স্পিডে। অন্যদের যেটা করতে ছ’-আট ঘণ্টা লাগবে, সেটা ও তুলে দেবে চার ঘণ্টায়। এটাই ঋতুর আসল ইউএসপি।

জাতিকার এ ব্যাপারে কোনও বক্তব্য আছে?

ঋতুপর্ণা: এই বিষয়টা নিয়ে অনেক রকম কনসেপশন আছে। যে যার মতো ভাবুক।

প্রসেনজিৎ: তার মানে কী? যে বলল দুনিয়া বদলে যাক আমি বদলাব না। এই শিবু, আমি কিন্তু টাইমে ঢুকব। আমি ‘২২শে শ্রাবণ’‌য়ে পরমকে বলে দিয়েছিলাম আমাকে বাবা ওয়েট করাস না। তোকেও তাই বলে রাখছি।

শিবু: হুঁ হুঁ...

হুঁ হুঁ কী? এঁদের নিয়ে ফিল্মটা শুরুর আগে আপনার প্রেশার মাপুন। ছবি শেষ হওয়ার পর আবার মেপে নেবেন।

শিবু: আমার এমনিতেই ট্রাইগ্লিসারাইড হাই। কোলেস্টেরলটাও বেশি। ডাক্তার বলেছিল বেশি স্ট্রেস না নিতে। এই ছবিটায় তো মনে হচ্ছে ভালই স্ট্রেস হবে।

প্রসেনজিৎ-ঋতুপর্ণা: (মিলিত হাসি) ট্রাইগ্লিসারাইড আগেই বেশি...

শিবু, আপনার নতুন ফিল্মের নাম শুনছি ‘প্রাক্তন’?

শিবপ্রসাদ: ইয়েস। প্রাক্তন প্রেমিক-প্রেমিকের আচমকা দেখায় জীবনে তাদের সম্পর্ক নতুন করে ফেরত আসা।

তার মানে তো ‘বেলাশেষে ২’?

শিবপ্রসাদ: কেন?

সেই গল্পেরই তো নতুন অধ্যায়। গোল্ডেন সেপারেশনের পর একটা কাপলের সম্পর্ক নতুন করে ফেরত।

ঋতুপর্ণা: ভেরি ইন্টারেস্টিং। এ ভাবে তো ভাবিনি।

শিবপ্রসাদ: দেখুন, আমার ছবিতে সব সময় শিল্পীদের কামব্যাক হয়েছে। সোহিনী বলুন। সৌমিত্রদা-স্বাতীলেখা জুড়িই বলুন। এমনকী নাইজেল। সে দিক থেকে...

প্রসেনজিৎ: এটা একটা জুটির জীবনে ফেরা।

শিবপ্রসাদ: আমার তো মনে হয় এটাই গ্রেটেস্ট কামব্যাক।

নায়ক-নায়িকা দু’জনকেই জিজ্ঞেস করছি এই যে পনেরোটা বছর একসঙ্গে কাজ না করে কেটে গেল। ভাবতে কেমন লাগে? যে সময়ের মধ্যে এই রাজ্য তিনজন মুখ্যমন্ত্রী দেখেছে। ইন্ডিয়ান ক্রিকেট টিমে পাঁচজন নতুন ক্যাপ্টেন দেখা গেছে। ইন্টারনেট এসেছে। ফেসবুক, টুইটার, ইন্সটাগ্রাম চালু হয়েছে! কলকাতার রং লাল থেকে নীল হয়ে গেছে!

ঋতুপর্ণা: আমি আগে উত্তরটা দিচ্ছি। প্রথমত, পনেরো বছর কেটে গিয়েছে মনেই হয় না। আমার ধারণা ছিল বারো। কেমন হু হু করে কেটে গেল। এই সময়ের মধ্যে আমার জার্নিটা ভীষণ ঘটনাবহুল। নানা ভাবে নিজেকে চ্যালেঞ্জ করেছি। নিজেকে নতুন চিনেছি। কত রকম এক্সপেরিমেন্ট করেছি। যার কিছু হয়তো ভুল ছিল। কিছু ঠিক। কিন্তু একটাই রাস্তা ধরে চলেছি। দৌড় কখনও থামিয়ে দিইনি। একটু আগে উনি বলছিলেন, হিরো ডমিনেটেড ইন্ডাস্ট্রি। তো ওঁকে মনে করিয়ে দিতে চাই সেই ইন্ডাস্ট্রিতে হিরোইনদের সলিড জায়গাটা বোধহয় লড়াই করে তৈরি করতে পেরেছি। আননোটিসড জায়গাগুলো নিজের কাজ দিয়ে নোটিস করিয়েছি। দেখি উনি কী বলেন...

প্রসেনজিৎ: (বক্তব্যের শেষ দিকটা গুরুত্ব না দিয়ে খানিকটা স্বগতোক্তির মতো) এক ধারায় ছবি করতাম। তার পর নিজেকে বদলে ফেললাম। এমন সব ছবি যেখানে নায়িকা ইম্পর্ট্যান্ট নয়। ‘অটোগ্রাফ’, ‘২২শে শ্রাবণ’, ‘জাতিস্মর’। নিজেকে বদলাতে বদলাতে নিয়ে গিয়েছি। ঋতুর সঙ্গে কাজ করব ভেবেই রেখেছিলাম। তবে বারবার মনে হত, সেটা এমন কিছু ইম্পর্ট্যান্ট কাজ হতে হবে যা দর্শকদের দীর্ঘ প্রতীক্ষাকে সম্মান জানানোর উপযুক্ত।

ঋতুপর্ণা: আমি এগ্রি করি। আমিও বারবার নিজেকে বলেছি জুটি ফেরত আসতে হলে বিশাল স্কেলে কিছু ভাবতে হবে।

প্রসেনজিৎ: এই জুটির সম্পর্কে ইমেজারিটা একটা মিথের পর্যায়ে চলে গিয়েছে। আজকের যে প্রজন্ম আমাদের সেই রমরমার সময় তাদের কত বয়স হবে? বড়জোর ছয় কী সাত! কেউ কেউ হয়তো জন্মায়ইনি। তাদের সামনে মিথের গাছটা ভেঙে পড়ুক, একেবারেই চাই না। আর তার জন্য কামব্যাকটা বিফিটিং হওয়া চাই।

আচ্ছা, একটা কথা বলুন। পনেরো বছর আগে আপনারা কমার্শিয়াল ছবির লিড পেয়ার ছিলেন। আজ যারা জেনারেশন ওয়াই তাদের কী দায় পড়েছে আপনাদের দেখতে যাওয়ার! তাদের প্রিয় জুটিরা নিশ্চয় আরও কম বয়সি...

ঋতুপর্ণা: আই বেগ টু ডিফার। হ্যালো, এটা মানলাম না। যত জেনারেশন আসুক তারা তো আমাদের কাজ ছুড়ে ফেলে দেয়নি। যখন ‘মুক্তধারা’ করেছি। ‘আলো’ করেছি। ‘অলীক সুখ’ করেছি। এরাই তো ভিড় করে সিনেমাগুলো দেখেছে। কীসের নতুন জেনারেশন? নতুন টেস্ট? আমার তো মনে হয়, আমরা তাল মিলিয়ে আছি। স্টার হিসেবে উই হ্যাভ ওয়ার্কড থ্রু জেনারেশনস। তাই না? আরে কিছু বলবে তো... (হিরোর দিকে তাকিয়ে)

প্রসেনজিৎ: তা ছাড়া আমরা যাদের সঙ্গে কাজ করছি সে ডিরেক্টররা তো এখনকার প্রজন্মেরই। তাদের স্টাইল আলাদা, ভাষা আলাদা, প্রেজেন্টেশন আলাদা। এরাই তো আমাদের নতুন সব কাজ নতুন দর্শকের কাছে পৌঁছে দিচ্ছে। জেনারেশন গ্যাপটা হবে কোত্থেকে?

অনেক প্রাইভেট বাসের পিছনে লেখা থাকে, ‘দেখবি আর জ্বলবি, লুচির মতো ফুলবি’। তা আপনাদের বিচ্ছেদের সময় যখন কোয়েল-জিৎ জুড়ি পরপর হিট দিচ্ছে তখন কি ঈর্ষায় ফুলতেন?

ঋতুপর্ণা: হ্যালো, কীসের ঈর্ষা? ক’টা ছবি করেছে কোয়েল-জিৎ? সাত-আটটা? দশটা? আমরা একসঙ্গে বাহান্নটা ফিল্ম করেছি। তুমি চুপ করে আছ কেন?

সরি, শুধু জিৎ-কোয়েল কেন? দেব-শ্রাবন্তী, দেব-শুভশ্রী...

প্রসেনজিৎ: না, না এ সব কী প্রশ্ন। এরা সব আমার ছোটছোট ভাইবোনের মতো। খুব স্নেহ করি ওদের। এ ভাবে আমি আলোচনাই করব না। আমি উঠে যাচ্ছি। (উঠে গেলেনও)

ঋতুপর্ণা: কর্পোরেট কর্পোরেট উত্তর দিও না তো। মন খুলে কথা বলো। আমিও জিৎ-কোয়েলকে কোথাও কোনও ভাবে ছোট করতে চাই না। কিন্তু ওরা কি সেই সব ভয়ঙ্কর দিনে আমাদের মতো পরীক্ষা দিয়েছে? না কি কল্পনা করতে পেরেছে? (প্রসেনজিৎ আবার ফিরে এলেন)

এসি মেকআপ ভ্যান বলে কোনও বস্তু ছিল না। মাল্টিপ্লেক্স ছিল না। সিনেমার স্যাটেলাইট বিক্রি হত না। এমনও হয়েছে পাহাড়ের উপর ড্রেস চেঞ্জ করছি। আউটডোরে এক দিনে চার বার ড্রেস চেঞ্জ হলে গাছের ডালে কাপড় টাঙিয়ে তা করেছি। ধাবাতে শ্যুটিংয়ের মাঝে রাত কাটিয়েছি। আজকের এরা সবাই ট্যালেন্টেড। ওদের হেয় করে কিছু বলতে চাই না। কিন্তু এরা কী পরিমাণ ব্যাকিং পায়। প্যাকেজিং কত ভাল। আমরা তো কলকাতা শহরে ভাল হোর্ডিংই পাইনি। তার পর মিডিয়া! আমাদের সময় মিডিয়া কোথায় ছিল আজকের মতো?

প্রসেনজিৎ: এটা ঠিক। মিডিয়া বলতে তখন আনন্দবাজারের শনিবারের পত্রিকা, শুক্রবারে একটা দায়সারা রিভিউ। বাংলার হিরো-হিরোইনদের কোনও স্টেটাসই ছিল না। হিরোদের বলত ওই যে ছাই ফেলতে ভাঙা কুলো। আর নায়িকাদের বলত এয়ারহোস্টেস এসেছে। ইংলিশ কাগজে আজ টালিগঞ্জ নিয়ে পাতার পর পাতা লেখা। তখন একটা লাইনও বেরোত না। চারিদিকে তাচ্ছিল্য আর অবজ্ঞা। ঋতু আর আমি সেই সময়টা স্ট্রাগল করে উঠে এসেছি। এখনও ভুলতে পারি না, রঞ্জিত মল্লিকের মতো ভদ্রলোক একটা নামী ফিল্ম ম্যাগাজিনকে কী ভাবে ছবি দেবেন না বলেছিলেন। বলেছিলেন, ‘‘ওই রেখার পায়ের তলায় ছবি ছাপার দরকার নেই আমার।’’

একটা কথা বলুন। এই পনেরো বছর বনবাসটা হঠাৎ করে শেষ হয়ে গেল কী করে?

প্রসেনজিৎ: উত্তরটা দেব। লিখতে হবে কিন্তু। কেটে দিলে হবে না। তা হলে আমি এখানেই ইন্টারভিউ বন্ধ করে দেব। আজ যখন মন খুলে কথা বলছি পুরোটাই রাখঢাক না রেখে হোক।

নিশ্চয়ই।

প্রসেনজিৎ: এটা সম্ভব হল আপনার আর আপনাদের এবিপি টিমের জন্য। আমাদের এই ভুল বোঝাবুঝি বা তথাকথিত বিরোধের সময়ে এবিপি-র মিটিয়ে দেওয়ার ইনিশিয়েটিভটা আমি কখনও ভুলব না। গল্ফ ক্লাবে যে দিন আমাদের জড়াজড়ি করে ছবি তোলানো হল, সেটাই বোধহয় মিটমাটের দিকে একটা বড় স্টেপ ছিল।

এই সময়ের মধ্যে আপনারা একমাত্র এবিপি-র জন্য ফোটোশ্যুট করেছেন। যত দূর মনে পড়েছে তিনবার...

ঋতুপর্ণা: ইয়েস তিন বার।

কিন্তু সেগুলো খুব ‘অড’ হত। আপনারা পাশাপাশি জড়িয়ে ধরে পরের পর ছবি তুলতেন। অথচ নিজেরা কোনও কথা বলতেন না। শ্যুট করাতে গিয়ে প্রতিবার আমাদের টিমের মনে হত নির্বাক ছবি দেখছে। সৃজিত একবার আমাদের পুজোশ্যুটের ডিরেকশন দিয়ে আপনাদের অনেকগুলো ছবি তোলায়।

প্রসেনজিৎ: ইয়েস, খুব ভাল মনে আছে।

কিন্তু সেটাও ছিল সেই সায়লেন্ট মুভি।

প্রসেনজিৎ: হতে পারে। কিন্তু ওটা যে একটা সায়লেন্ট ফিল্ম ছিল সেটা কি কেউ ছবি বেরোবার পর বুঝতে পেরেছে? আমাদের কেমিস্ট্রিটাই এমন যে, পনেরো বছর কথা না বললেও পাশে দাঁড়ালেই এমন এক্সপ্রেশন দেব যে তিরিশটা ছবি একসঙ্গে করছে এ রকম পেয়ারও ধুয়ে যাবে।

এটা কী করে সম্ভব হয়? পেশাদারিত্ব?

ঋতুপর্ণা: একটা কিছু হয়ে যায়। ইট জাস্ট হ্যাপেনস।

প্রসেনজিৎ: পেশাদারিত্ব কিছুটা তো নিশ্চয়। আমরা হার্ডকোর প্রোফেশনাল। এই যখন আমি আর ঋতু একসঙ্গে ছবি করব না সিদ্ধান্ত নিলাম, একটা ছবির কাজ আমাদের কিছু বাকি পড়ে ছিল। আমি ভাবলাম বেচারি প্রোডিউসর এতটুকু অল্প কাজের জন্য সাফার করবে। করেই দিই। তো সে দিনও তো শ্যুটে গিয়ে ঋতুর জন্য আমায় বসে থাকতে হল। আমি তো কিছু বলিনি।

ঋতুপর্ণা: উফ্! আবার শুরু করেছে। কোথাকার কথা কোথায় নিয়ে গেল!

না, আমি জানতে চাইছি যে, এই একসঙ্গে পোজ দিয়ে আপনারা চলে যেতেন। কী মনে হত?

প্রসেনজিৎ: আরসিজিসি-তে যেদিন আমাদের নিয়ে প্রথম শনিবারের পত্রিকার শ্যুটটা হল, সে দিন শ্যুটের জন্য আমি ওর চুলটা ঠিক করে দিয়েছিলাম। সে দিনই তো আমি ঠিক করে ফেলি একসঙ্গে কাজ করব। তবে ইন্ডাস্ট্রির জন্য যখন প্রয়োজন হয়েছে আমি সরাসরি ওকে ফোন করেছি। ফিকির মঞ্চে যখন ইন্ডাস্ট্রির জন্য আমাদের একসঙ্গে দাঁড়ানোর দরকার ছিল, আমি তো ফোন করেছি। কী ঋতু, বলো সেটা!

ঋতুপর্ণা: সেটা তো অনেক পরে।

প্রসেনজিৎ: আরে করেছি তো?

এতই পেশাদার যখন আপনারা। বন্ধুত্বের বনবাসটা এমন দীর্ঘস্থায়ী হল কেন?

প্রসেনজিৎ: ওই যে শুরুতেই কোষ্ঠী বিচার শোনালেন না— কারণ সেটাই। আমরা দু’জনেই সেল্ফমেড। দু’জনেই অসম্ভব অভিমানী। দু’জনেরই জেদ। দু’জনেরই মারাত্মক ইগো।

আশ্চর্য লাগছে এত কমন বন্ধু আপনাদের, একজন কাউকে বললেই তো যে কেউ কথা বলিয়ে দিতে পারত। মান অভিমান মিটে যেত।

ঋতু: জীবনে সব কিছু কমন ফ্রেন্ডদের মাধ্যমে বোধহয় হয় না। ওর ফোনটা সেই এল। কিন্তু এগারো বছর বাদে। ফিকির জন্য।

আপনাদের এই বিচ্ছেদ কতটা যন্ত্রণাদায়ক ছিল?

(ইতিমধ্যে যুগ্ম পরিচালক নন্দিতা রায় এসে পড়েছেন আর অবাক হয়ে দেখছেন প্রশ্নটার উত্তর না দিয়ে দুজনেই নিস্তব্ধ।)

বলছিলাম এই ব্রেক আপটা কতটা পেনফুল ছিল?

ঋতুপর্ণা: (নিচু গলায়) যে কোনও ছাড়াছাড়িতেই খারাপ লাগা একটা থাকেই।

প্রসেনজিতের উত্তরটা পেলাম না

প্রসেনজিৎ: আপনাকে বলতে যাব কেন? যেটা মনে আসে লিখুন।

ঋতুপর্ণা, একটা সময় আপনি প্রসেনজিতের উপর নিয়মিত রেগে যেতেন। আপনার মনে হত বিচ্ছেদের পর যাবতীয় কাজ প্রসেনজিৎ নিজের দিকে আত্মসাৎ করে নিচ্ছেন। আপনি কার্যত বয়কট। আজ সে সব নিয়ে রাগ আছে?

ঋতুপর্ণা: আরে না না। আই হ্যাভ নো অ্যাঙ্গার। নো রিগ্রেটস। অনেক পেয়েছি আমি এই ক’বছরে। তরুণ মজুমদার, অনিরুদ্ধ রায় চৌধুরী, শিবু-শিবুর মতো ডিরেক্টর। এরা ভরিয়ে দিয়েছে আমাকে। হ্যাঁ, তখনকার মতো আমায় খুব স্ট্রাগল করতে হয়েছিল ঠিকই। একা একা নিঃসঙ্গ ভাবে রাস্তা চলেছি। কিন্তু আজ মনে হয়, সেই লড়াইটা আমাকে সমৃদ্ধই করেছে।

প্রসেনজিৎ, এই যে শোনা যায় আপনি আড়ালে কলকাঠি নেড়ে সব কাজ ঋতুর থেকে সরিয়ে নিতেন, এটা কতটা সত্যি?

প্রসেনজিৎ: ঠিক উল্টো। আমি কখনও ব্যক্তিগত সম্পর্ক নয়, সিনেমাকে ব্যক্তিস্বার্থের উপরে গুরুত্ব দিয়েছি।

কিন্তু একটা সময় তো কাগজে- টাগজে আপনারা পরস্পরের বিরুদ্ধে নানা কথা বলেছেন।

প্রসেনজিৎ: আমি একটা কথাও বলিনি গৌতম। কেউ কোথাও দেখাতে পারবে না। কেউ যদি প্রমাণ করতে পারে আমি শিবুর ছবি করব না। এখনই বেরিয়ে যাব।

(শিবু পাশের চেয়ার থেকে এতক্ষণে উল্টো দিকের খাটে আধশোয়া হয়ে আড্ডা শুনছিলেন। প্রসেনজিতের হুমকি শুনে তড়াক করে উঠে পড়লেন।)

শিবু: আরে আমার ছবি নিয়ে আবার বেট লড়া কেন? ছবিটা থাক না।

প্রসেনজিৎ: না, না, আমি শুনব না। একটা প্রমাণ দেখাতে পারলেই ছবিটা আমি করব না।

ঋতুপর্ণা: আরে এটা নিয়ে আবার থ্রেট করার কী হল? তুমি বলোনি বলছ। আমিও তো তেমন কিছু বলিনি।

প্রসেনজিৎ: তোমার সঙ্গে আমার তফাত হল, আমি সব সময় ভাল সিনেমার পাশে দাঁড়িয়েছি। তুমি ভুলভাল কাজ করছ দেখলে অনেক সময় কমন বন্ধুদের বলেছি। আমার তো আর তখন সরাসরি কথা হত না। আমি তো শিবুর ছবি কোনও দিন করিনি। তাও ‘ইচ্ছে’ থেকে শুরু করে ওর সব ক’টা ছবি দেখেছি। তাও তো ‘অলীক সুখ’‌য়ের প্রিমিয়ারে আমি গিয়েছি। তোমার ছবির পাশে দাঁড়িয়ে ছবি তুলেছি। অনেকে অবাক হয়ে বলেছে, এ কী বুম্বাদা। আপনি ঋতুপর্ণার ছবির পাশে পোজ দিচ্ছেন! আমি বলেছি তাতে কী? আমি তো সিনেমার সাপোর্টার। তোমার আমাকে দেখা এটা শেখা উচিত। সিনেমার জন্য অনর্গল ভালবাসার উপর কিছু নেই। তুমি সব সময় ব্যক্তিগত জিনিসকে সিনেমার সঙ্গে মিশিয়ে দাও। আমি কখনও করি না। আমার কাছে সিনেমা সব সময় আগে। একেই বলে কনসিসটেন্সি।

ঋতুপর্ণা: আমি যথেষ্ট কনসিসটেন্ট। আমি অনেকের মতো দ্রুত বদলাই না। আমিও তো ‘অটোগ্রাফ’ দেখে সৃজিতকে ফোন করেছিলাম।

সে তো অনেক পরে।

ঋতুপর্ণা: পরে হলেও করেছি তো।

প্রসেনজিৎ: সে তো আমি ‘অনুরণন’‌য়ের সময়ও টোনির পাশে দাঁড়িয়েছি। আজও টোনি বলে, বুম্বাদা ইউ আর রিয়েলি স্পোর্টিং।

ঋতুপর্ণা: ‘অনুরণন’ দেখেছিলে তুমি?

প্রসেনজিৎ: হ্যাঁ, ল্যাপটপে দেখেছি।

আপনারা কি জানেন, এত ডিরেক্টরকে ছেড়ে যাঁকে বাছলেন সেই ভদ্রলোক আনন্দplus বায়োস্কোপে বাজিমাতে আপনাদের জুটিকে চ্যাম্পিয়ন হতে দেখেও কনগ্র্যাচুলেট না করে কেটে পড়েছিলেন।

প্রসেনজিৎ: সে কি রে শিবু। জানতাম না তো।

শিবু: (প্রচণ্ড অপ্রস্তুত) আমার একটা কাজ ছিল। বাধ্য হয়ে বেরোতে হয়েছিল।

ঋতুপর্ণা: শিবুটা এ রকমই বদমায়েশ। (হাসি) এই জন্যই তো সারাক্ষণ ওর সঙ্গে আমার ঝামেলা লাগে। এমনিতে ও আমার বেস্ট ফ্রেন্ড, কিন্তু কাজের জায়গায় ওর সঙ্গে কথা বলতেই আমার ইচ্ছে করে না।

সে কী! এই ফিল্মটার শ্যুটিংয়ের সেটে আপনার দেরি দেখে শিবু যদি ফোন করেন।

ঋতুপর্ণা: ধরব না তো। শিবুর ফোন ধরার প্রশ্নই নেই। আমি নন্দিতাদির ফোন ধরব। যেটা একটা মিষ্টি মেসেজ সহ আসবে। ওটার উত্তর দেব। কোন লোকেশনে আছি সেটাও জানিয়ে দেব।

প্রসেনজিৎ: এই শিবু। আমায় যেন এসে বসে থাকতে না হয়। আমায় একজ্যাক্ট টাইমটা দিবি। নইলে কিন্তু তোর প্রবলেম আছে।

শিবু: কী হচ্ছে আমি কিছু বুঝতে পারছি না। কিছুই বুঝছি না।

আচ্ছা ঋতুপর্ণা, আপনাকে বলছি প্রসেনজিৎ চট্টোপাধ্যায়কে একটা সেনটেন্সে ব্যাখ্যা করুন। একবার বলবেন ২০০০ সালের লোকটাকে নিয়ে। একবার ২০১৫-র মানুষটা সম্পর্কে। কিন্তু একটা সেনটেন্সের বেশি নেওয়া যাবে না।

ঋতুপর্ণা: ২০০০ সালের লোকটা হেড স্ট্রং, খানিকটা ইমম্যাচিওর, কেয়ারিং, পরিশ্রমী। ২০১৫-র লোকটা অনেক ম্যাচিওর্ড এবং যার মধ্যে একটা টলটলে শান্ত ভাব এসেছে।

এ বার প্রসেনজিৎ।

প্রসেনজিৎ: ঋতু ২০০০ সালের তুলনায় অভিনেত্রী হিসেবে অনেক ভাল আর ম্যাচিওর্ড।

ঋতুপর্ণা: ধুর, এটা কোনও উত্তর হল! অভিনয় আমি আগেও ভাল করতাম।

প্রসেনজিৎ: বললাম তো, আমি কনসিসটেন্ট। আমি বরাবর কি এটা বলিনি যে আমার কেরিয়ারের প্রথম দিকে যদি বেস্ট অ্যাকট্রেস দেবশ্রী রায় হয়ে থাকে, তা হলে নতুন সময়ে সেটা ঋতু।

ঋতুপর্ণা: আমি কত মন থেকে ভাল করে বললাম। এর উত্তরগুলো দেখো!

কর্পোরেট উত্তর।

ঋতুপর্ণা: হ্যাঁ, কর্পোরেটই বলুন বা ডিপ্লোম্যাটিক বলুন। ভেতর থেকে বলছে কোথায়?

শিবু, এঁদের ইন্টারভিউ নিতে গিয়ে যা দেখলাম, আপনার ছবির উদ্দেশে দুগ্গা, দুগ্গা।

শিবু: (দু’হাত কপালে ঠেকিয়ে চোখ বোজা) দুগ্গা, দুগ্গা।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE