ঋতুপর্ণ ঘোষ মানেই একা এক সত্তা! অলঙ্করণ: শৌভিক দেবনাথ।
পাঁচ বছর আগে আজকের দিনে আচমকাই চলে গিয়েছিলেন ঋতুপর্ণ ঘোষ। মেঘপিওনের সেই সব দিন নিয়ে স্মৃতির গন্ধে মনখারাপের সুর ধরলেন কলেজবেলায় তাঁর সবচেয়ে কাছের বন্ধু এবং সম্পর্কে ভ্রাতৃবধূ দীপান্বিতা ঘোষ মুখোপাধ্যায়।
ছবিটায় আর কেউ নেই। ঋতু আর আমি। কলেজবেলার সেই ছবিটার দিকে আজ সকালে উঠেই কেন যে চোখ গেল! অনেক ক্ষণ টানা তাকিয়েছিলাম। মাথা ভর্তি কোঁকড়ানো চুল, চোখ ভর্তি মেধা আর মন ভর্তি নানান গল্প!
নাহ্, দেখতে ইচ্ছে করে না ওর ছবি। ওকে নিয়ে কথা বলতে গেলেও মনটা কেমন বড্ড শক্ত হয়ে যায়!
আজ ওর এই ছবিটা কোথাও আমার ভেতরের মনের কথায় ঝাপটা মারতে লাগল, এক্ষুনি বেরিয়ে পড়ার জন্য।
ঝলমলে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের খোলা প্রান্তর। আমাদের মনও তাই। বিপ্লব, বিশ্ব, তত্ত্ব— এ সব নিয়েই তখন স্বপ্ন দেখতে চায়। কিন্তু ঋতু? ‘তিতলি’ গল্পটা লিখে শুনিয়েছিল আমাকে। তখন খুব বন্ধু আমরা। আজ আর বলতে দ্বিধা নেই, আলাপের বেশ কিছু দিন পরে ঋতু এসে বলেছিল আমাকে, “আমার এক পুরুষ প্রেমিক আছে। তার সঙ্গে আমার শরীরের সম্পর্ক। এটা জানার পর কি আমার সঙ্গে বন্ধুত্ব রাখবি?” আশির দশকের মাঝ সময়ে এই কথাটা বলা এবং শোনাটা সহজ ছিল না একেবারেই। তবু, আমার মনে হয়েছিল, ‘তাতে আমার কী’! ঋতু নিশ্চিন্ত হয়েছিল সেই দিন। আর সেই বন্ধুতার জায়গা থেকেই ‘তিতলি’ পড়ে শুনিয়েছিল। আমি বলেছিলাম, “তুই শুধু প্রেমের গল্প না লিখে বিশ্বের প্রেক্ষিতে একটা ছবি বানা।”
আরও পড়ুন
তিনি ছিলেন ভারতের পাবলো নেরুদা
আমরা জানতাম ঋতু ফিল্মমেকার হবেই। আর অন্য কিছু হতে পারে না! ‘তিতলি’ নিয়ে তর্ক শুরু হল আমাদের। ও বলেছিল, “এক জন সেলিব্রিটি, যাকে সব জায়গায় সব সময় দেখা যায়, তাঁকে যদি কখনও তোর দেখতে ইচ্ছে না করে, দেখবি তা-ও আমাদের তাঁকে দেখতে ইচ্ছে হয়! এটা যে কী যন্ত্রণার! এটা হয়তো বুঝবি!”
সে দিন বুঝিনি। কিন্তু ঋতু চলে যাওয়ার বেশ কিছু দিন পরে আমি আমার দু’জন সহকর্মীর সঙ্গে কলেজ থেকে ট্যাক্সিতে ফিরছি। এফএম-এ বাজছে, ‘সখী হাম মোহন অভিসারে’... আমার এক সহকর্মী জানতে চেয়েছিলেন, ‘‘এই গানটা ঋতুপর্ণের লেখা কি?’’ আমি সম্মতি দেওয়ার পর দেখি, অন্য এক সহকর্মী নেট থেকে সেই গানটা আবার চালালেন। আর হট করে ঋতুর ছবিটা মোবাইলে ভেসে ওঠে। উফ্ফ! তখন এক দম ঋতুকে দেখতে চাইছিলাম না আমি। কিছুতেই না! কিন্তু উপায় নেই, ওদের কি আর বলতে পারি গানটা থামাও এক্ষুনি!
সে দিন বুঝেছিলাম ঋতু কেন বলেছিল, সেলিব্রিটিকে দেখতে না চাইলে সারা ক্ষণ দেখার যন্ত্রণা কী!
কলেজবেলার ছবি। পারিবারিক অ্যালবাম থেকে।
এত এগিয়ে সম্পর্কের ছোট ছোট বুনটে চরিত্র তৈরি করতে পারত কী করে? আমি কোনও তুলনায় যাব না। কিন্তু আমার মনে হয়, ঋতুর ছবি আলাদা করে মুড তৈরি করতে পারত। মানে এ রকম বহু বার হয়েছে হয়তো পুরো ছবিটা না দেখে ছবির কোনও একটা অংশ বার বার দেখছি। এতে মনে হয়, সত্যজিতের স্কুলিং ছাড়িয়ে ঋতু অনেক সময় ঋত্বিকের প্যাশনকে ছবিতে এনে ভাংচুর করত। বাঙালির মধ্যবিত্ততা, মধ্যচিত্ততা, তার অনেক বাঁক বদল, মানব সম্পর্কের গূঢ় অতলস্পর্শী রহস্যময় ইঙ্গিত, পরিবারের একক (ইউনিট) বদলে ভেঙেচুরে একক (অ্যালোন) মানুষের আবেগ ও আর্তনাদ বার বার ধরা পড়েছে তাঁর ছবিতে।
সব কিছুর মধ্যে ওর আলাদা চোখ, আলাদা খোঁজার কারণ হয়তো ঋতু তৃতীয় লিঙ্গের মানুষ ছিল! এ নিয়ে দীর্ঘ আড্ডা হত আমাদের! আমি জানতাম, ভালবাসার সন্ধানে ও নিজের সুখেই আগুন দিয়ে বেড়াবে। বলেছিলাম, “তুই বিদেশে চলে যা। এখানে কাজ করে থাকতে পারবি না!” মনে আছে আমার, বেশ ভেজা গলায় বলেছিল, “আমি যে বাংলা ছবি করব! আমি কলকাতা ছাড়তে পারব না।”
পঞ্চাশ পেরিয়ে আমার মনে হয়, ঋতু নিশ্চয়ই ‘মহাভারত’ বা ‘রাধাকৃষ্ণ’কে নিয়ে ছবি করার কাজে হাত দিত। একটা কথা আজ বলি, ছবি করার ক্ষেত্রে যা যা করার, ওর ইচ্ছে অনুসারে সব করে গিয়েছে। তবে ‘মহাভারত’ করতে চেয়েছিল। জনশ্রুতিকে ইতিহাস বানানোর ক্ষমতা ওর মধ্যে ছিল!
আরও পড়ুন
ও তো মেয়ে, সায়েন্স পড়বে কী
রাগ হয় আমার! কলকাতা ওকে তো নিতে পারল না!
খুব জেদ ছিল ওর। মনে ঠাঁই দিয়েছিল— যাই হোক না কেন পৃথিবীকে আমি দেখিয়ে দেব, এই ভাবনাকে। কেউ আমার চেহারা, কথা, পোশাক নিয়ে হাসবে না, বরং নতজানু হবে! এ যেন ঈশ্বরের বিরুদ্ধে জেহাদ ঘোষণা। এই জেদের দাম ঋতুকে দিতে হয়েছিল। ভালবাসা খুঁজতে খুঁজতে একের পর এক মানুষ ওকে আরও একা করে দিয়ে চলে যেত! ঋতু মানেই একা এক সত্তা! ওর আলোয় যখন ক্ষমতার বৃত্ত তৈরি হল, তখন ওকে ব্যবহার করার জন্য মানুষ ভালবাসার ভান করত। ওর দুর্বলতা নিয়ে খেলত। আচ্ছা, শুধু ভালবাসার জন্য কেউ ওর কাছে থেকে যেতে পারত না? আমি ওর এত কালের বন্ধু বলে কি এ রকম ভাবছি? জানি না! ওর ভালবাসতে চাওয়াটার মধ্যে কী অস্বাভাবিক কিছু ছিল?
আসলে সে দিনগুলো যে কী যন্ত্রণার! ভুলতে পারি না। ওই যন্ত্রণা দিয়েই মেয়েমনের ভেতরটা দেখতে পেত ঋতু! ও কোনও দিন ছবিতে ইমোশন দেব বা ক্লাইম্যাক্স তৈরি করব বলে ছবি করেনি। অথচ ছোট ছোট করে মানুষের মনের কাটাছেঁড়াগুলো অবলীলায় দেখিয়ে গিয়েছে।
যন্ত্রণা দিয়েই মেয়েমনের ভেতরটা দেখতে পেত ঋতু! —ফাইল চিত্র।
আমি বরাবর ঋতুর সঙ্গে তর্ক করেছি। আমি সোজা কথা বলতাম। আর পাঁচজন স্তাবকের মতো বানিয়ে প্রশংসা করতাম না। সেটা ও জানত। আর প্রয়োজনে মুখোমুখি হত না আমার! সেই জায়গা থেকে এক বার বলেছিলাম, ‘‘আবহমান-এ মমতাশঙ্করের চরিত্রটা বড্ড সাজানো লেগেছে আমার। এত কাছের এক জন মানুষ চলে গিয়েছে আর ওই চরিত্র এত সুন্দর হয়ে সকলের সঙ্গে থাকছেন!’’ ঋতু বলেছিল, ‘‘এ রকম হয়। শোক সবটা করিয়ে নেয়।’’ তখন বুঝিনি। কিন্তু ঋতু যে দিন চলে গেল, সব সেরে রাতে বাড়ি ফিরে হঠাৎ ওর কথা মনে হল! আমিও তো আজ সব সুন্দর করে করলাম, সারা দিনে ঋতুর কথা তো সে ভাবে মনে হয়নি! শোক করিয়ে নিল? নাকি ঋতু? ও তো নিজের জীবনে কখনও কখনও শোক হয়ে ফিরেছে!
ওর অপারেশনের কথা যখন বলেছিল, আমি না করিনি। শুধু বলেছিলাম, বিদেশ বা নিদেনপক্ষে মুম্বই গিয়ে করাতে। কারণ কলকাতার ডাক্তাররা তো ওকে পেশেন্ট নয় সেলিব্রিটি, ঋতুপর্ণ হিসেবে দেখবে! এই তর্কে ও যেতে চায়নি। তাই আমায় না জানিয়ে অপারেশন করে ফেলল!
এই যে ওর না পাওয়া, অন্য রকম জন্ম নেওয়ার লড়াই, ওকে আমার কাছ থেকে দূরের করে দিয়েছিল। ওর চলে যাওয়ার আগে প্রায় এক বছর আমাদের সেই লম্বা আড্ডাটা আর হয়নি। ব্যস্ততা? নাকি একটু দূরে থাকা? জানি না।
তবে ওর চলে যাওয়ার আগে একটি ম্যাগাজিনে ‘বিনয়’ নামে ওর একটি শেষ লেখা পড়ে ধন্দে পড়েছিলাম। মেসেজ করব, নাকি ফোন? নাকি চলে যাব ওর কাছে? অনেক কিছু ভেবেছিলাম সেই রবিবারের সকালটায়। কথা বা দেখা হয়নি। ঋতু চলে গিয়েছে।
সেই বরাবরের এক অভ্যেস! কিছুতেই কথা বলতে দিল না আমায়!
অথচ নিজেও থেমে গেল!
ছবিটার দিকে এখনও তাকিয়েই বসে আছি। মাথা ভর্তি কোঁকড়ানো চুল, চোখ ভর্তি মেধা আর মন ভর্তি নানান গল্প!
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy