কলেজবেলার ছবি। পারিবারিক অ্যালবাম থেকে।
এত এগিয়ে সম্পর্কের ছোট ছোট বুনটে চরিত্র তৈরি করতে পারত কী করে? আমি কোনও তুলনায় যাব না। কিন্তু আমার মনে হয়, ঋতুর ছবি আলাদা করে মুড তৈরি করতে পারত। মানে এ রকম বহু বার হয়েছে হয়তো পুরো ছবিটা না দেখে ছবির কোনও একটা অংশ বার বার দেখছি। এতে মনে হয়, সত্যজিতের স্কুলিং ছাড়িয়ে ঋতু অনেক সময় ঋত্বিকের প্যাশনকে ছবিতে এনে ভাংচুর করত। বাঙালির মধ্যবিত্ততা, মধ্যচিত্ততা, তার অনেক বাঁক বদল, মানব সম্পর্কের গূঢ় অতলস্পর্শী রহস্যময় ইঙ্গিত, পরিবারের একক (ইউনিট) বদলে ভেঙেচুরে একক (অ্যালোন) মানুষের আবেগ ও আর্তনাদ বার বার ধরা পড়েছে তাঁর ছবিতে।
সব কিছুর মধ্যে ওর আলাদা চোখ, আলাদা খোঁজার কারণ হয়তো ঋতু তৃতীয় লিঙ্গের মানুষ ছিল! এ নিয়ে দীর্ঘ আড্ডা হত আমাদের! আমি জানতাম, ভালবাসার সন্ধানে ও নিজের সুখেই আগুন দিয়ে বেড়াবে। বলেছিলাম, “তুই বিদেশে চলে যা। এখানে কাজ করে থাকতে পারবি না!” মনে আছে আমার, বেশ ভেজা গলায় বলেছিল, “আমি যে বাংলা ছবি করব! আমি কলকাতা ছাড়তে পারব না।”
পঞ্চাশ পেরিয়ে আমার মনে হয়, ঋতু নিশ্চয়ই ‘মহাভারত’ বা ‘রাধাকৃষ্ণ’কে নিয়ে ছবি করার কাজে হাত দিত। একটা কথা আজ বলি, ছবি করার ক্ষেত্রে যা যা করার, ওর ইচ্ছে অনুসারে সব করে গিয়েছে। তবে ‘মহাভারত’ করতে চেয়েছিল। জনশ্রুতিকে ইতিহাস বানানোর ক্ষমতা ওর মধ্যে ছিল!
আরও পড়ুন
ও তো মেয়ে, সায়েন্স পড়বে কী
রাগ হয় আমার! কলকাতা ওকে তো নিতে পারল না!
খুব জেদ ছিল ওর। মনে ঠাঁই দিয়েছিল— যাই হোক না কেন পৃথিবীকে আমি দেখিয়ে দেব, এই ভাবনাকে। কেউ আমার চেহারা, কথা, পোশাক নিয়ে হাসবে না, বরং নতজানু হবে! এ যেন ঈশ্বরের বিরুদ্ধে জেহাদ ঘোষণা। এই জেদের দাম ঋতুকে দিতে হয়েছিল। ভালবাসা খুঁজতে খুঁজতে একের পর এক মানুষ ওকে আরও একা করে দিয়ে চলে যেত! ঋতু মানেই একা এক সত্তা! ওর আলোয় যখন ক্ষমতার বৃত্ত তৈরি হল, তখন ওকে ব্যবহার করার জন্য মানুষ ভালবাসার ভান করত। ওর দুর্বলতা নিয়ে খেলত। আচ্ছা, শুধু ভালবাসার জন্য কেউ ওর কাছে থেকে যেতে পারত না? আমি ওর এত কালের বন্ধু বলে কি এ রকম ভাবছি? জানি না! ওর ভালবাসতে চাওয়াটার মধ্যে কী অস্বাভাবিক কিছু ছিল?
আসলে সে দিনগুলো যে কী যন্ত্রণার! ভুলতে পারি না। ওই যন্ত্রণা দিয়েই মেয়েমনের ভেতরটা দেখতে পেত ঋতু! ও কোনও দিন ছবিতে ইমোশন দেব বা ক্লাইম্যাক্স তৈরি করব বলে ছবি করেনি। অথচ ছোট ছোট করে মানুষের মনের কাটাছেঁড়াগুলো অবলীলায় দেখিয়ে গিয়েছে।