গৌরী ঘোষ।
একটা সময় বাঙালির রান্নাঘরে ভিনিগার অচল ছিল।জিরে-হলুদের গন্ধমাখা দুপুরে অথবা শাঁখ-বাজানো সন্ধ্যাবেলায় রেডিয়োতে ভেসে আসত নদীর মত এক কন্ঠ,"আকাশবাণী কলকাতা"..
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় ভোর চারটেয় ওঁকে নিতে আসত অল ইন্ডিয়া রেডিয়োর গাড়ি। শাশুড়ি মা ওই কাকভোরে উঠে বানিয়ে দিতেন চা।চোখে কাজল,তাঁতের শাড়ি আর দৃঢ় মাইক্রোফোনের সামনে গিয়ে দাঁড়াতেন সেই নদীর মত কন্ঠ।গেরস্থবাড়ির দিন শুরু হত। দাদা অভিনেতা -গায়ক রবীন মজুমদার। বাড়িতে আসতেন ছবি বিশ্বাস ,পাহাড়ী স্যন্যাল ,বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র এবং আরো সব দিকপালেরা। কবিতা বড় ভাল লাগত মেয়েটির। আর ভাল লেগেছিল শিশির ভাদুড়ির কন্ঠের মায়া।
আবৃত্তিকার হওয়ার কথা জম্মেও ভাবেনি মেয়েটি। সে তার কাকার কথা ভাবত এক মনে। কাকা শ্রীশ্রীমা সারদার টানে ঘর ছেড়ে সন্ন্যাসী। স্বামী সারদেশানন্দ। এই যে উত্তরকালের বাচিক জগতের নক্ষত্র গৌরী ঘোষ ,শুধু কন্ঠ তাঁকে আগের উজ্জ্বলতায় সঙ্গ দেয় না বলে,অনেক আর্থিক ক্ষতি হবে জেনেও এক পলকেই ছেড়ে দিতে পারেন রেডিয়োয় অত ভাল চাকরি,তার আড়ালে ওই গভীর ত্যাগের ইশারা ছিল বলে বিশ্বাস হয়।
আমাদের সংষ্কৃতির ইতিহাসে গৌরী ঘোষ যখন আবৃত্তি করতে শুরু করেন,১৯৬১ সালে এম এ ক্লাসে পড়ার সময় রবীন্দ্রশতবর্ষ উপলক্ষে ,তখন তিনিই প্রথম মহিলা আবৃত্তিকার যিনি অন্য কোনো শিল্পমাধ্যম থেকে আসেননি।পূর্বজ ছিলেন তৃপ্তি মিত্র। আর চারপাশেই তখন দিকপাল পুরুষ কন্ঠের রমরমা। অথচ কোনও নাটকীয়তা ছাড়া নৈর্ব্যক্তিক অনুচ্চ গভীর উচ্চারণে
কবিতাকে এক অলৌকিক মায়ায় আমাদের কানে পৌঁছে দিলেন গৌরী।
কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায় বলতেন,চিত্রাঙ্গদার সেই ‘এমনি শিশিরের কণা’ গৌরী ছাড়া কেউ বললে আমি গাইব না। মাঝে মাঝে শুধু গলার আওয়াজটা শুনবেন বলে ফোন করতেন হেমন্ত মুখোপাধ্যায়।
সেই অলৌকিক স্বর কি শুধু ভোকাল কর্ড থেকে আসত? না। এক আবহমানের রোম্যান্টিক মানবী,এক আকুলহদয় মা ,প্রেমিকা ,দিদি সব মিলেমিশে সে এক গভীর আন্তরিক মানুষীর স্বর। সেই স্বর আজ সবার চোখের আড়াল হয়ে বেজে উঠবে পরমের একান্ত আসরে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy